বিশ্বকাপ বা ইউরোর মতো টুর্নামেন্টগুলোয় ইংল্যান্ডের স্কোয়াড দেখলে যে কারও চোখ কপালে উঠে যায়। শুধু স্কোয়াড নয়, মূল দলে যাঁদের সুযোগ হয় না, তাঁদের নিয়ে আরেকটা দল বানালে সেটাও নাকি ইউরো বা বিশ্বকাপ জেতার যোগ্যতা রাখে। অনেকে মজা করে বলে কথাটা। কিন্তু একদম আকাশকুসুম কল্পনা নয়। কিন্তু এমন ভয়ংকর দল, ক্লাব পর্যায়ে ইউরোপ মাতানো খেলোয়াড়দের নিয়ে ইংল্যান্ডের সফলতা কতটুকু? হয়তো অনেক শিরোপা আর সাফল্যের গল্প রয়েছে তাঁদের ঝুলিতে! কিন্তু না। তোমরা শুনলে অবাক হবে—১৯৬০ সালে ফ্রান্সে প্রথমবারের মতো ইউরো আয়োজন করার পর এখন পর্যন্ত কোনো শিরোপা নেই ইংল্যান্ডের। তাঁদের সর্বোচ্চ সাফল্য ২০২০-এর ইউরোর ফাইনালে ওঠা পর্যন্তই।
এবারের ইউরোর মূল মঞ্চে আসতে বাছাইপর্বে একটা ম্যাচও হারেনি ইংল্যান্ড। ৮ ম্যাচের মধ্যে জিতেছে ৬টিতে এবং ২ ম্যাচে ড্র করে মোট ২০ পয়েন্ট নিয়ে ইউরোতে এসেছে তারা। এই ৮ ম্যাচে থ্রি লায়ন্সরা গোল করেছে ২২টি আর গোল হজম করেছে মাত্র ৮টি। এমন ফর্ম নিয়ে যে দল ইউরো শুরু করতে যাচ্ছে, তারা তো অবশ্যই অন্যতম ফেবারিট। কিন্তু এভাবেই চলছে ইংল্যান্ডের ভাগ্যের চাকা। দুর্দান্ত ফর্মে থেকে তারা ইউরো বা বিশ্বকাপে আসে, এরপর খালি হাতেই বাড়ি ফিরতে হয় তাদের।
গ্রুপের দ্বিতীয় দল ডেনমার্ক। গত বিশ্বকাপে তারা খেলেছে ডার্ক হর্সের তকমা নিয়ে। কিন্তু গ্রুপ পর্বে একটা ম্যাচও না জিতে চূড়ান্ত রকমের ব্যর্থ হয়ে ফিরতে হয়েছিল তাদের। তবে ইউরো বাছাইপর্ব খারাপ কাটেনি ডেনিশদের। গ্রুপ এইচ থেকে মোট ১০ ম্যাচ খেলে তারা জিতেছিল ৭ ম্যাচে, হার মাত্র ২টিতে।
যদিও এবার ইংল্যান্ডের ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করেছে ইউরোর মূল টুর্নামেন্ট শুরু আগে থেকেই। ইউরোপিয়ান বাছাইপর্ব শেষ করে তারা প্রীতি ম্যাচ খেলেছে ব্রাজিল, বেলজিয়াম, বসনিয়া এবং আইসল্যান্ডের সঙ্গে। ব্রাজিলের বিপক্ষে তারা হেরেছে। বেলজিয়ামের বিপক্ষে করেছে ড্র। কিন্তু সবচেয়ে চমকের বিষয় ০-১ গোলে তারা হেরে বসেছে আইসল্যান্ডের কাছে। সেই ম্যাচে হ্যারি কেইন, ফিল ফোডেন, ড্রেক্লান রাইস, ট্রিপিয়ার, কাইল ওয়াকার, বুকায়ো সাকা সবাই খেলেছেন। তাই ইউরো শুরুর আগে তুলনামূলক দুর্বল প্রতিপক্ষের বিপক্ষে এমন হার তাদের আত্মবিশ্বাসে আঘাত না হেনে বসে।
২০১৬ সাল থেকে ইংল্যান্ড জাতীয় দল সামলাচ্ছেন ৫৩ বছর বয়সী গ্যারেথ সাউথগেট। প্রায় ৯ বছর ধরে আছেন দলটার সঙ্গে। দুটি বিশ্বকাপ, একটি ইউরো, একটি নেশনস কাপে সুযোগ পেয়েও সাউথগেট দেশকে জেতাতে পারেননি কিছুই। অথচ তাঁর সময়ে ইংল্যান্ড পেয়েছে দুর্দান্ত এক প্রজন্ম, এমনকি বর্তমান এই নতুন প্রজন্মও গড়ে উঠছে তাঁর হাত দিয়ে। প্রায় প্রত্যেক বড় টুর্নামেন্টের পরই নিন্দিত হয়েছে সাউথগেটের ফুটবল কৌশল, তাঁর চোখে লাগার ভুলগুলো হয়েছে সমালোচিত। কিন্তু তিনি রয়ে গেছেন তাঁর আগের স্থানেই। বড় টুর্নামেন্টে তাঁর অধীনে দল নিয়মিত কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত যায়, শিরোপা জয়ের স্বপ্নটা মাত্র দেখতে শুরু করে। এরপর সুরটা কেটে যায় হুট করে। সুখের স্বপ্ন পরিণত হয় দুঃস্বপ্নে। তবে কি গ্যারেথ সাউথগেট ইংলিশদের জন্য শুধুই চোখের বালি?
যা-ই হোক, ইংল্যান্ডের দলটা এবার কেমন হলো? প্রথমে কারা আছেন সেটা বাদ দিয়ে, কারা নেই, তা দেখা যাক। হ্যারি ম্যাগুয়ের, রাশফোর্ড, হেন্ডারসন, জ্যাক গ্রেলিশ, জেমস ম্যাডিনসন, ওয়ান-বিশাখা, মেসন মাউন্ট, স্টারলিং, এরিক ডায়ারদের জায়গা হয়নি এই দলে। যদিও যাঁদের সাউথগেট ডেকেছেন, তাঁদের নাম শোনার পর তুমি বলবে একটু আগে যাঁদের নাম শুনলাম, ফর্ম বিবেচনায় তাঁদের এই আসরে এবারের দলে জায়গা পাওয়ার কথাও না।
ইউরোতে গোলবার সামলাবেন জর্ডান পিকফোর্ড। রক্ষণে স্টোনস, ওয়াকার, ট্রিপিয়ার, লুক শ, মার্ক গুইয়ে। মিডফিল্ডে এতগুলো জ্বলজ্বলে নক্ষত্রের মধ্য থেকে তিন থেকে চারজনকে বাছাই করাই মুশকিল। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে দুর্দান্ত এক মৌসুম কাটানো জুড বেলিংহাম অবধারিতভাবে থাকবেন সাউথগেটের একাদশে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের তরুণ তুর্কি কোবি মাইনো ইতিমধ্যেই ইংল্যান্ড দলে নিজের জায়গা পাকা করে নিয়েছেন। আছেন ডেক্লান রাইস, কোল পালমার, গ্যালাহার, ফোডেন আর বুকায়ো সাকা। স্ট্রাইকার পজিশনে হ্যারি কেইনের জায়গা তো ধরাবাঁধা। তাঁর বদলি হিসেবে আইভাব টোনি আর ওলে ওয়াটকিংসকে রাখা হয়েছে। নিউক্যাসল ইউনাইটেডের তরুণ ফরোয়ার্ড অ্যান্থনি গর্ডনও বেঞ্চ থেকে দলকে সাহায্য করতে পারবেন।
দলের একমাত্র দুর্বলতা বলতে তাদের নিয়মিত ডিফেন্ডার হ্যারি ম্যাগুয়েরকে এবার দলে রাখা হয়নি। তাই স্টোনসের সঙ্গে কে জুটি বাঁধবেন, সেটা এখনো নিশ্চিত নয়। আর তারকা তকমা ও অভিজ্ঞতার ঝুলি পূর্ণ থাকলেও লুক শ, ট্রিপিয়ার আর কাইল ওয়াকারের বয়সসংক্রান্ত জটিলতা আর ফর্ম নিয়ে কিছুটা সংশয় থেকেই যায়। তাই দিন শেষে, বিশ্বমানের দল, অভিজ্ঞ কোচ, সহজ গ্রুপ আর ফেবারিটের তকমা—তবু ইংল্যান্ড যেন ভেতর থেকে নড়বড়ে।
গ্রুপের দ্বিতীয় দল ডেনমার্ক। গত বিশ্বকাপে তারা খেলেছে ডার্ক হর্সের তকমা নিয়ে। কিন্তু গ্রুপ পর্বে একটা ম্যাচও না জিতে চূড়ান্ত রকমের ব্যর্থ হয়ে ফিরতে হয়েছিল তাদের। তবে ইউরো বাছাইপর্ব খারাপ কাটেনি ডেনিশদের। গ্রুপ এইচ থেকে মোট ১০ ম্যাচ খেলে তারা জিতেছিল ৭ ম্যাচে, হার মাত্র ২টিতে। তবে তাদের দলের বর্তমান দুর্বলতা এই গ্রুপ ম্যাচের পারফরম্যান্স থেকেই হয়তো বলে দেয়। সান মারিনো, কাজাখস্তান, ফিনল্যান্ড আর নদার্ন আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে একই গ্রুপে থেকেও তারা হজম করেছে ১০ গোল। তবে গোল হজম করলেও জয়ধারা থামেনি ডেনমার্কের। প্রীতি ম্যাচসহ শেষ ১৪ ম্যাচে তারা হেরেছে মাত্র ২টি ম্যাচে। সম্প্রতি নরওয়ে আর সুইডেনকেও হারিয়েছে স্মাইকেল-এরিকসেনরা।
ক্যাসপার হুইলমান্ডের দলের একাদশে এবারও গোলবার সামলাবেন ক্যাসপার স্মাইকেল। রক্ষণে ভরসা জোগাবেন বার্সেলোনার ডিফেন্ডার ক্রিসটেনসেন এবং এসি মিলানের সিমোন কিয়ের। এ ছাড়া জোয়াকিম অ্যান্ডারসন এবং জোয়াকিম মেইলের দেখা মিলবে ফুলব্যাক পজিশনে। মাঝমাঠের দখল এখনো ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেন, হইবেয়া এবং থমাস ডেলেইনির দখলে। তবে ক্যারিয়ারের সোনালি সময় ফেলে আসা এরিকসেন এবারের ইউরোতে দলকে কতটা উজাড় করে দিতে পারবেন, সেটা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। আক্রমণভাগে চোখ রাখা উচিত ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের স্ট্রাইকার রাসমুস হইলুনের দিকে।
গ্রুপ সি-এর অন্য দুটি দল সার্বিয়া এবং স্লোভেনিয়াও প্রস্তুত ইউরোর গ্রুপ পর্ব ছাপিয়ে পরের রাউন্ডে উঠতে। সাম্প্রতিক সময়ে তাদের ফর্মও বেশ ভালো। এ বছর প্রীতি ম্যাচে স্লোভেনিয়া হারিয়েছিল পর্তুগালকেও। স্লোভেনিয়ার মূল ভরসা তাদের গোলরক্ষক ইয়ান অবলাক। দীর্ঘদিন পর দলে ফিরেছেন জোসিপ লায়েচ। তবে বিশেষভাবে নজরে রাখবে হবে তাদের স্ট্রাইকার বেনজামিন সেসকোর প্রতি। ২১ বছর বয়সী এই স্ট্রাইকার লাইপজিগের হয়ে এবার বুন্দেসলিগায় ৩১ ম্যাচে করেছেন ১৪ গোল। দারুণ ফর্মে থাকা এই স্ট্রাইকার স্লোভাকদের হয়েও গোলধারা অব্যাহত রাখবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
এদিকে সার্বিয়া দলেও রয়েছে বেশ কিছু বিশ্বমানের খেলোয়াড়। স্ট্রাইকার পজিশনে দুসান ভ্লাহোভিচ ছাড়াও রয়েছেন মিত্রোভিচ আর ইয়োভিচ। মাঝমাঠে অভিজ্ঞতার ছোঁয়া পাওয়া যাবে দুসান তাদিচ আর মিলেনকোভিচ-স্যাভিচের কাছ থেকে। তবে দুর্বলতার কথা বললে দলের সাম্প্রতিক ফর্মে কিছুটা হলেও ভাটা পড়েছে। তা ছাড়া রক্ষণও তাদের আগাগোড়া নড়বড়ে।
মুখোমুখি লড়াইয়ে সার্বিয়া প্রথমবারের মতো খেলবে ইংল্যান্ডের সঙ্গে। গত ইউরোতে ইংল্যান্ড ডেনমার্ককে ২-১ গোলে হারালেও ২০২০ সালের নেশনস লিগে তাদের অভিজ্ঞতা খুব একটা মনে রাখার মতো হয়নি। দুই লেগেই ডেনিশদের কাছে পয়েন্ট খুইয়েছিল তারা। তা ছাড়া বিশ্বকাপ আর ইউরো মিলিয়ে স্লোভেনিয়ার সঙ্গে ছয়বারের দেখায় একবারও হারেনি সাউথগেটের শিষ্যরা।
ইউরোর বাছাইপর্বে স্লোভেনিয়ার সঙ্গে ডেনমার্কের ইতিমধ্যে সাক্ষাৎ হয়ে গেছে। দুটি ম্যাচে একটিতে জিতলেও অন্যটিতে পয়েন্ট ভাগাভাগি করে নিয়েছিল দুই পক্ষ। আর মোট তিনবারের দেখায় তারা সার্বিয়ার বিপক্ষে হারেনি কখনো। অন্যদিকে সার্বিয়া আর স্লোভেনিয়ার মুখোমুখি লড়াইয়ের ক্ষেত্রেও পরিসংখ্যান সার্বিয়ার কথা বলে সার্বিয়ার পক্ষে।
তাই গ্রুপ সি থেকে কোনো অবিশ্বাস্য অঘটন না ঘটলে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েই পরের রাউন্ডে যাওয়ার কথা ইংল্যান্ডের। আর গ্রুপে দ্বিতীয় পজিশন নিয়ে বাকি তিন দলের লড়াইটা বেশ উপভোগ্য হবেই বলে আশা করা যায়।
গ্রুপ সি এর ম্যাচগুলো:
রাউন্ড এক:
স্লোভেনিয়া বনাম ডেনমার্ক ১৬ জুন (রাত ১০টা)
সার্বিয়া বনাম ইংল্যান্ড ১৭ জুন (রাত ১টা)
রাউন্ড দুই:
স্লোভেনিয়া বনাম সার্বিয়া ২০ জুন (সন্ধ্যা ৭টা)
ডেনমার্ক বনাম ইংল্যান্ড ২০ জুন (রাত ১০টা)
রাউন্ড তিন:
ইংল্যান্ড বনাম স্লোভেনিয়া ২৬ জুন (রাত ১টা)
ডেনমার্ক বনাম সার্বিয়া ২৬ জুন (রাত ১টা)