মিলানের সান সিরোর স্টেডিয়াম তখন কানায় কানায় পূর্ণ। প্রায় ৭০ হাজারেরও বেশি দর্শক চিৎকার করে যাচ্ছেন ‘ইব্রাহিমোভিচ ইব্রাহিমোভিচ’ বলে। ডাগআউটের সিঁড়িতে দাঁড়ানো ইব্রাহিমোভিচ সেই ডাকে সাড়া দিয়ে ঢুকলেন মাঠে। পায়ের নিচে লালগালিচা, দুই পাশে দাঁড়ানো সতীর্থ খেলোয়াড়-স্টাফরা জানাচ্ছেন গার্ড অব অনার। ক্যামেরার চোখ গেল ভক্তদের চেহারায়—কারও চোখে জল, কান্না আটকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে কেউ কেউ। প্রিয় খেলোয়াড়কে বিদায় জানানোর কষ্ট যে বুক ভাঙার মতোই
গুঞ্জন উঠেছিল, আবারও মিলান ছাড়বেন ইব্রাহিমোভিচ। চুক্তি নবায়ন না করায় ক্লাবের পক্ষ থেকে মৌসুমের শেষ ম্যাচে তাই আয়োজন করা হয় তাঁর বিদায় অনুষ্ঠানের। কিন্তু সেই অনুষ্ঠানে গিয়ে ফুটবলকেই বিদায় জানানোর ঘোষণা দিলেন ইব্রা! মিলানের লাল-কালো জার্সিই তাঁর শেষ রং হয়ে থাকবে। ভক্তদের আবেগ তাই আর বাঁধ মানেনি। স্বয়ং ইব্রাহিমোভিচও আবেগাপ্লুত হয়েছেন। নিজেকে ‘ঈশ্বর’ দাবি করা এই ফুটবলারের চোখের কোণে জল আর চোয়াল শক্ত করে নিজেকে সামলানো দেখে শান্ত থাকতে পারেননি মিলানের খেলোয়াড়েরাও।
৩৯ বছর বয়সে প্রায় অসম্ভব এক চ্যালেঞ্জ কাঁধে নিয়ে মিলানে দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু করেন ইব্রাহিমোভিচ। অতীত গৌরব হারিয়ে ফেলা এসি মিলান তখন নখদন্তহীন এক নাম। ইব্রার প্রভাবে যেন রাতারাতি বদলে গেল তারা। অসম্ভব দৃঢ় আত্মবিশ্বাসী ইব্রার মন্ত্র মিলানের সব খেলোয়াড়কে প্রভাবিত করেছে। এই বুড়ো বয়সেও ইউরোপের শীর্ষ লিগগুলোর একটিতে এসে প্রায় ভঙ্গুর এক দলকে টেনে তুলে সিরি ‘আ’ চ্যাম্পিয়ন করলেন, ফেরালেন চ্যাম্পিয়নস লিগে। বারবার এভাবেই ফুটবল–বিশ্বকে মুগ্ধ করে গেছেন এই কিংবদন্তি।
মেসি-রোনালদোর দ্বৈরথে যাঁদের নাম পাদপ্রদীপের ছায়ায় পড়ে যায়, তাঁদের একজন ইব্রাহিমোভিচ। সুইডিশ এই ফুটবলার আধুনিক ফুটবলের অন্যতম সের খেলোয়াড়। ২৪ বছরের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে ৯৮৮ ম্যাচে করেছেন ৫৭৩ গোল, যার মধ্যে সুইডেনের জার্সিতে আছে ৬২ গোল। খেলেছেন আয়াক্স, জুভেন্টাস, ইন্টার মিলান, বার্সেলোনা, এসি মিলান, প্যারিস সেন্ট জার্মেই, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মতো ইউরোপের শীর্ষ ক্লাবে। জিতেছেন মোট ৩২টি ট্রফি, যার মধ্যে ১২টি লিগ শিরোপা। ১৯৯৯ সালে সিনিয়র ফুটবলে অভিষেক হওয়ার পর থেকে কোনো বছরই গোলশূন্য থাকেননি।
তবে এসব পরিসংখ্যান দিয়ে আসলে ইব্রাহিমোভিচকে বোঝা যায় না। প্রায় সাড়ে ছয় ফুট উচ্চতার বিশালদেহী এই স্ট্রাইকার পরিচিত তাঁর হার-না-মানা মানসিকতার জন্য। বড় বড় ইনজুরিতে ভেঙে না পড়েও কঠোর পরিশ্রমে ফিরেছেন ফুটবল খেলায়। তাঁর মতো আত্মবিশ্বাস খুব কম মানুষের মধ্যেই দেখা যায়। ১৮ বছর বয়সে অভিষেকের পর থেকে ৪২ বছর বয়স পর্যন্ত একটানা ইউরোপের শীর্ষ ফুটবলে দাপটের সঙ্গে খেলে যাওয়ার মতো অবাক করা ব্যাপার তাই ইব্রার ক্ষেত্রেই দেখা যায়। লম্বা ক্যারিয়ারে যেখানেই খেলেছেন, খালি হাতে ফেরেননি। আয়াক্স থেকে প্যারিস কিংবা মিলান—সব জায়গায় ভক্তদের মনে জায়গা করে নিয়েছেন, দলকে জিতিয়েছেন শিরোপা। ইব্রাহিমোভিচের বিদায়ে তাই কেবল সান সিরোই নয়, বিশ্বের অজস্র ফুটবলভক্তের মনে বিষাদের সুর বেজেছে।