মেসি না রোনালদো— পেনাল্টি মিসে কে এগিয়ে

একটা সময় ছিল, যখন ইউরোপিয়ান ম্যাচ ডে মানেই মেসি-রোনালদোর দ্বৈরথ। আজ লিওনেল মেসি ২ গোল করে বার্সেলোনাকে জেতাচ্ছেন, তো তার জবাব রোনালদো দিচ্ছেন দিচ্ছেন হ্যাটট্রিক করে। এক দশকের বেশি সময় ধরে ইউরোপের ক্লাব ফুটবলের মূল কেন্দ্রবিন্দুই ছিল মেসি-রোনালদোর দ্বৈরথ। বয়সের ভারে মেসি-রোনালদো কেউই আর ইউরোপীয়ান ফুটবলের মহারথী নন। ইউরোপ থেকে বহুদূরে সৌদি আর যুক্তরাষ্ট্রে ঘাঁটি গেড়েছেন দুজন। কিন্তু ভক্তদের দ্বৈরথ তো আর কমেনি। নিজেদের খুব সম্ভবত শেষ আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে এসেও ঠিকই বজায় আছে তাঁদের লড়াই। তবে সময়ের পরিক্রমায় গল্পটা সামান্য বদলে গেছে।

পৃথিবীর দুই প্রান্তে একইসঙ্গে চলছে দুই মহাদেশীয় টুর্নামেন্ট। ২৪ দল নিয়ে ইউরো আর ১৬ দল নিয়ে কোপা আমেরিকা। ফরম্যাট থেকে শুরু করে নিয়মকানুন, খেলার ধরণ, সবকিছুতেই যোজন যোজন পার্থক্য। আট হাজার কিলোমিটারের ব্যবধানে অনুষ্ঠিত দুই মহাদেশীয় টুর্নামেন্টকে একই সূত্রে বেঁধেছেন দুই মহাতারকা। ক্যারিয়ারের শেষবেলায় এসে গোলের লড়াইয়ে নয়, দুই তারকার লড়াইটা পেনাল্টি মিসের।

পেনাল্টি মিসের সূচনা করেছিলেন রোনালদোই। ইউরোর শেষ ষোলোতে পর্তুগালের প্রতিপক্ষ ছিল স্লোভেনিয়া। নির্দিষ্ট সময় গোলশূন্য ড্র হওয়ায় ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। অতিরিক্ত সময়ের ১০৫ মিনিটে স্লোভানিয়ার বিপক্ষে পেনাল্টি পায় পর্তুগাল। দক্ষ সেনার মতো এগিয়ে যান রোনালদো। নার্ভ ধরে রেখে পেনাল্টি নিতে সিদ্ধহস্ত রোনালদো আটকে যান ইয়ান অবলাকের ডেরায়। সর্বশক্তি দিয়ে নেওয়া শট অনায়াসে থামিয়ে দেন স্লোভানিয়ার গোলরক্ষক। ম্যাচ হারার শঙ্কা ভর করে রোনালদোর মনে। সে ম্যাচ গড়িয়েছে টাইব্রেকারে, ডিয়েগো কস্তার অসাধারণ গোলকিপিংয়ে কোয়ার্টার ফাইনালের টিকিট কেটেছে পর্তুগাল। আজীবন ৫ নম্বর পেনাল্টি নেওয়া রোনালদো এসেছিলেন প্রথম পেনাল্টি নিতে। লক্ষ্যভেদ করেছেন, করে ক্ষমাও চেয়েছেন সমর্থকদের কাছে। কিন্তু ততক্ষণে নতুন এক রোনালদোকে দেখেছে বিশ্ববাসী। আজীবন শক্ত মানসিকতার রোনালদো ম্যাচের মাঝেই ভেঙে পড়েন আচমকা। অশ্রুসজল ভঙ্গুর রোনালদোকে মাঠে দেখে সেদিন অবাকই হয়েছিলেন অনেকে। ম্যাচ শেষে গোলরক্ষক ডিয়েগো কস্তাকে জড়িয়ে ধরার গল্পটাই বলে দেয় কতটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন তিনি।

গোলকিপারকে বোকা বানালেও জালে জড়ায়নি বল, পোস্টে লেগে চলে গেছে মাঠের বাইরে
ছবি: গেটি ইমেজ

গত তিন দিন ধরে এই রোনালদোকে নিয়ে তোলপাড় হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ট্রল, মিম থেকে শুরু করে নিন্দুকের দুয়ো সবটাই শুনতে হয়েছে তাঁকে। এমনকি ‘বিবিসি’র মতো চ্যানেলে রোনালদোর নাম বিকৃত করে লেখা হয়েছে ‘মিস্টিয়ানো পেনলাদো’! কিন্তু দুদিন যেতে না যেতেই মুদ্রার উল্টোপিঠ দেখল বিশ্ব। আটলান্টিকের এই পারে লিওনেল মেসিও হাঁটলেন একই পথে।

কোপা আমেরিকার কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনা মুখোমুখি হয়েছিল ইকুয়েডরের। প্রথমে গোল দিয়ে এগিয়ে গেলেও শেষ মুহূর্তের গোলে সমতায় ফেরে ইকুয়েডর। কোপা আমেরিকার এবারের আসরে অতিরিক্ত সময়ের নিয়ম না থাকায় সরাসরি ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে। গোলকিপারের ওপর দিয়ে ‘পানেনকা’ পেনাল্টি নিতে চেয়েছিলেন মেসি। গোলকিপারকে বোকা বানালেও জালে জড়ায়নি বল, পোস্টে লেগে চলে গেছে মাঠের বাইরে। মেসি মিস করলেও আর্জেন্টিনার বাকি খেলোয়াড়েরা ঠিকই টেনে তুলেছেন দলকে। এমি মার্টিনেজের অসাধারণ গোলকিপিং দলকে নিয়ে গিয়েছে সেমিতে।

রোনালদোর ব্যাপারটা একটু আলাদা। শট গোলে পরিণত করার দিক দিয়ে মেসি-রোনালদো সমান্তরালে থাকলেও রোনালদো পিছিয়ে আছেন জয়ের দিক দিয়ে। এখন পর্যন্ত টাইব্রেকারে নেওয়া ১২ শটের মধ্যে ১০টি গোল করেছেন রোনালদো। কিন্তু লিওনেল মেসি যেখানে ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই প্রথম পেনাল্টি নিয়ে অভ্যস্ত, রোনালদো সেখানে আজীবন দলের শেষ পেনাল্টি নিয়ে এসেছেন।

এক সপ্তাহের মধ্যেই মুদ্রার উল্টোপিঠ দেখা হয়ে গিয়েছে দুই মহারথীর। সময়টাও খুব যে একটা ভালো যাচ্ছে তা নয়। এখন পর্যন্ত মেসি-রোনালদো কেউই কোনো গোলের দেখা পাননি। নামের পাশে একটিমাত্র অ্যাসিস্ট। এক সপ্তাহের মধ্যে দুই বড় তারকার পেনাল্টি মিস আরেকটা বড় প্রশ্ন জাগিয়েছে মানুষের মনে। ১২ গজ দূর থেকে কে বেশি সফল? মেসি না রোনালদো?

যদি শুধু পেনাল্টির কথায় আসি, মেসির চেয়ে রোনালদো এগিয়ে আছেন যোজন যোজন। রোনালদোর ১৬৪ গোলের বিপরীতে মেসির গোল ১০৯। ২ বছরের বড় রোনালদো অবশ্য শটও নিয়েছেন বেশি। পুরো ক্যারিয়ারে মেসি পেনাল্টি মিস করেছেন ৩১ টি। অন্যদিকে রোনালদো ৩০টি। রোনালদোর নেওয়া ৮৪.৫% পেনাল্টি পরিণত হয়েছে গোলে। অন্যদিকে মেসির সফলতার হার ৭৭.৯%। পেনাল্টি স্পট থেকে সুয়ারেজকে অ্যাসিস্ট করা গোলের কথা মনে আছে? সেটাকে কিন্তু মিস হিসেবেই ধরা হয়েছে। এমনকি গোলকিপার থামিয়ে দেওয়ার পর যদি তা গোলে পরিণত হয়, সেটাও ধরা হয়েছে মিস হিসেবেই। এক নজরে মেসি-রোনালদোর পেনাল্টির পরিসংখ্যান:

পেনাল্টি যতটা না বেশি স্কিলের, তার চেয় বেশি স্নায়ুর চাপ ধরে রাখার । আর সেটা যদি হয় টাইব্রেকারে, তবে তো কথাই নেই। টাইব্রেকারের লড়াইতে মেসি কিছুটা এগিয়ে আছেন রোনালদোর চেয়ে। গতকালের ম্যাচসহ এখন পর্যন্ত টাইব্রেকারে ১৩টি শট নিয়েছেন মেসি। এরমধ্যে গোল পেয়েছেন ১১টিতে। ১৩ ম্যাচের মধ্যে জয় পেয়েছেন ৯টিতে। হেরেছেন ৫ বার। ২০১৬ কোপা আমেরিকার ফাইনালে মেসির সেই মিস এখনও কাঁদায় কোটি মেসির ভক্তদের।

সর্বশক্তি দিয়ে নেওয়া শট অনায়াসে থামিয়ে দেন স্লোভানিয়ার গোলরক্ষক
ছবি: দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট

অন্যদিকে রোনালদোর ব্যাপারটা একটু আলাদা। শট গোলে পরিণত করার দিক দিয়ে মেসি-রোনালদো সমান্তরালে থাকলেও রোনালদো পিছিয়ে আছেন জয়ের দিক দিয়ে। এখন পর্যন্ত টাইব্রেকারে নেওয়া ১২ শটের মধ্যে ১০টি গোল করেছেন রোনালদো। কিন্তু লিওনেল মেসি যেখানে ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই প্রথম পেনাল্টি নিয়ে অভ্যস্ত, রোনালদো সেখানে আজীবন দলের শেষ পেনাল্টি নিয়ে এসেছেন। এবারের ইউরোতে প্রথমবারের মতো টাইব্রেকারে প্রথম শট নিয়েছেন। টানা দুই ম্যাচেই এসেছেন সবার আগে। যে কারণে তার শট নেওয়ার আগেই ফলাফল এসে গিয়েছে এমন রেকর্ডও আছে। এখন পর্যন্ত ১৭টি শ্যুটআউটে দাঁড়িয়েছেন রোনালদো। এর মধ্যে জয়ের থেকে পরাজয় বেশি। ৮ জয়ের বিপরীতে ৯ হার! এর মধ্যে ৪টি শ্যুটআউটে শটই নিতে পারেননি তিনি। সেগুলো বাদ দিলে ৭ জয়ের বিপরীতে আছে ৬ পরাজয়। তবে রোনালদোর মিসের কারণে দল হেরেছে, এমন রেকর্ড একটিই। ২০১২ সালে বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে টাইব্রেকার। সেদিনের সেই হারের পর নিজেকে নতুন করে গড়েছেন রোনালদো। যার প্রতিচ্ছবি দেখা যায় এখনো।

তবে শ্যুটআউটের বাইরেও বড় ম্যাচে মিস করার রেকর্ড আছে দুজনেরই। ২০১২ চ্যাম্পিয়নস লিগ সেমি ফাইনালে চেলসির বিপক্ষে পেনাল্টি মিস করেছিলেন মেসি। যার খেসারত দিতে হয়েছিল ম্যাচ হেরে। রোনালদো ২০০৮ চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমি ও ফাইনালে পরপর মিস করলেও তাঁকে তেমন খেসারত দিতে হয়নি। সতীর্থদের কাঁধে ভর করে ম্যাচ বের করে এনেছেন ঠিকই।

তথ্যসূত্র: মেসি ভার্সেস রোনালদো ডট কম