১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫—৬ বছরে পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে বেজে উঠেছিল বিশ্বযুদ্ধের দামামা। ক্ষমতার নেশায় অন্ধ হয়ে যাওয়ার বলি হতে হয়েছিল পুরো বিশ্বকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মানুষ দেখেছিল, ক্ষমতার জন্য ঠিক কতটা নৃশংস হতে পারে মানুষ। যার প্রভাব পড়েছিল পুরো বিশ্বে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পাল্টে দিয়েছিল পৃথিবীর মানচিত্র, বদলে দিয়েছিল সবার আর্থসামাজিক অবস্থান। শেষের শুরু হয়েছিল ফ্যাসিজম আর ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের।
পৃথিবী যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ট্রমা ভুলে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে, তখনই আবার বিশ্বকাপ প্রজেক্ট সামনে নিয়ে আসে ফিফা। ফুটবলের চেয়ে বড় বিনোদনের মাধ্যম আর কী–ই বা হতে পারে? কিন্তু যেখানে খাদ্য-বাসস্থানের ব্যবস্থা করতেই মানুষের তথৈবচ অবস্থা, সেখানে বিনোদন ছিল বিলাসিতা। অর্থনৈতিক দুরবস্থায় বিশ্বকাপের মতো বিশাল দায়িত্ব নিতে রাজি হচ্ছিল না কেউই। ১৯৪৬ সালের ফিফা কংগ্রেসে একমাত্র দেশ হিসেবে আয়োজক হওয়ার প্রস্তাব দেয় ব্রাজিল। তা–ও ফিফার নির্ধারিত ১৯৪৯ সালে নয়, বরং নিজেদের সুবিধামতো, ১৯৫০ সালে। হাসিমুখে ব্রাজিলের প্রস্তাব মেনে নিল ফিফা। ২০ বছর পর আবারও বিশ্বকাপ ফিরল দক্ষিণ আমেরিকায়।
ব্রাজিলের প্রস্তাব মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ও ছিল না ফিফার কাছে। ১৯৪২ সালে বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য যে প্রস্তাব করেছিল, ঠিক একই প্রস্তাবে ১৯৫০ বিশ্বকাপ আয়োজনের সব দায়িত্ব পায় ব্রাজিল। শুরু হয় চতুর্থ বিশ্বকাপের যাত্রা। সমস্যার সূচনা হয় বিশ্বকাপের দল খুঁজে পেতে।
শেষ দুই বিশ্বকাপের জন্য দল পেতে বিন্দুমাত্র বেগ পোহাতে হয়নি ফিফাকে। ইউরোপের ভেতরে বিশ্বকাপ, ইউরোপিয়ান দলগুলো রাজি হয়েছে একবাক্যে। দক্ষিণ আমেরিকার দলগুলো ছাড়া বাদ সাধেনি কেউই। কিন্তু বেহাল ইউরোপের কারণে দক্ষিণ আমেরিকার বিশ্বকাপের জন্য দল পাওয়া মুশকিলই হয়ে পড়েছিল।
বিশ্বকাপের দল খুঁজতে আবারও মাঠে নামেন ফিফা সভাপতি জুলে রিমে। ১৬ দলের বিশ্বকাপে আগে থেকেই নিশ্চিত ছিল মাত্র দুই দল—ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ইতালি ও স্বাগতিক ব্রাজিল। তাদের বাদ দিয়ে শুরু হলো বাছাইপর্ব। ফিফার অফিশিয়াল ৬৮ দল থেকে বেছে নেওয়া হবে বাকি ১৪ দল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরাজিত দেশ জার্মানি, জাপান, অস্ট্রিয়াকে নিষিদ্ধ করা হয় বিশ্বকাপ থেকে। ইতালি ও ফিনল্যান্ড বাদে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অক্ষশক্তির প্রতিটি দেশকেই অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ করা হয় বিশ্বকাপে। এ ছাড়া ‘আয়রন কার্টেন’-এ অবস্থিত দেশগুলো যেমন সোভিয়েত ইউনিয়ন, চেকোস্লোভাকিয়া এবং হাঙ্গেরি বাছাইপর্ব থেকে প্রত্যাহার করে নেয় নিজেদের নাম। অন্যদিকে বাছাইপর্ব চলাকালীন নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নেয় দক্ষিণ আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনা, ইকুয়েডর ও পেরু। এশিয়ান অঞ্চল থেকে নাম প্রত্যাহার করে ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া এবং বার্মা। ভারতকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও বুট পরে খেলতে হবে জানতে পেরে নিজেদের সরিয়ে নেয় তারা। বলা বাহুল্য, বিশ্বযুদ্ধের আগপর্যন্ত অলিম্পিক কিংবা বিশ্বকাপ—কোনো ইভেন্টেই বুট পরে খেলতে হবে এমন নিয়ম ছিল না।
১৭ বছর স্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকার পর ফিফার সঙ্গে আবারও একজোট হয় ইংলিশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (এফএ)। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে অংশ নেয় ইংল্যান্ড। বাছাইপর্ব শেষে ১৬ দল চূড়ান্ত হলেও বাকি ছিল চমক। বাছাইপর্ব পার করেও চলতে থাকে নাম প্রত্যাহারের হিড়িক। অর্থনৈতিক কারণে নিজেদের সরিয়ে নেয় তুরস্ক। অন্যদিকে ইংল্যান্ডের সঙ্গে এক গ্রুপে খেলবে না বলে নিজেদের সরিয়ে নেয় স্কটল্যান্ড। তাদের জায়গায় আমন্ত্রণ জানানো হয় পর্তুগাল, ফ্রান্স ও আয়ারল্যান্ডকে। শুরুতেই না করে দেয় পর্তুগাল ও আয়ারল্যান্ড। প্রথমে ফ্রান্স আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেও বিশ্বকাপের আগমুহূর্তে নিজেদের সরিয়ে নেয় তারা। শেষ পর্যন্ত ১৩ দেশ নিয়ে শুরু হয় চতুর্থ বিশ্বকাপ।
পরপর দুই নকআউট বিশ্বকাপের পর চতুর্থ বিশ্বকাপে এসে বিশ্বকাপের ফরম্যাটে বদল আনে ফিফা। এবার ১৩টি দলকে ভাগ করা হয় চারটি গ্রুপে। প্রতিটি গ্রুপের জয়ী দল পৌঁছে যাবে সেমিফাইনালে। তবে সেমিফাইনালে ছিল না কোনো নকআউট পর্ব। বরং সেমিফাইনালের চার দল মুখোমুখি হবে একে-অপরের। সর্বোচ্চ পয়েন্টধারী দল জিতে নেবে বিশ্বকাপ। ১৯৫০ বিশ্বকাপ ছিল ইতিহাসের প্রথম এবং একমাত্র বিশ্বকাপ, যেখানে ছিল না কোনো নকআউট পর্ব।
চার গ্রুপের সেরা চার দল হিসেবে ফাইনাল রাউন্ডে উন্নীত হয় উরুগুয়ে, ব্রাজিল, সুইডেন ও স্পেন। এই চার দল নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় শেষ পর্বের খেলা। ফাইনাল রাউন্ডের প্রথম দুই ম্যাচ জিতে পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে ছিল স্বাগতিক ব্রাজিল। শিরোপা জয়ের ব্যাপারে ব্রাজিলিয়ানরা এতটাই নিশ্চিত ছিল যে ব্রাজিলের পত্রিকায় ব্রাজিল দলকে জয়ী ঘোষণা করে নিউজ পর্যন্ত ছাপা হয়ে গিয়েছিল। পুরো টুর্নামেন্টের ব্রাজিলের আক্রমণভাগের সামনে পাত্তা পায়নি কোনো দল। আর সেখানে দরকার মাত্র ১ পয়েন্ট। ব্রাজিলবাসী নিশ্চিত ছিল, শিরোপা তাদের দেশেই থাকছে।
ব্রাজিলের মানুষকে আনন্দে ভাসিয়ে দেন ব্রাজিলিয়ান স্ট্রাইকার ফ্রিয়াঙ্কা। ৪৭ মিনিটে তাঁর গোলে এগিয়ে যায় ব্রাজিল। কিন্তু এরপরই দুঃস্বপ্নের মতো বয়ে আসে ব্রাজিলিয়ানদের জীবনের সবচেয়ে বড় ঝড়। ১৫ মিনিটের সে ঝড়ে তোলপাড় হয়ে গেল ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্স। ৬৬ মিনিটে উরুগুয়েকে সমতায় ফেরান আলবার্তো শিয়াফিনো। আর ৭৯ মিনিটে শেষ পেরেক ঠুকে দেন আলসিদেস ঘিঘিয়া।
গোলরক্ষক মোয়াসির বারবোসার পাশ গলে বল যখন জালে জড়ায়, মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল পুরো মারাকানা স্টেডিয়াম। এমনকি গোলদাতা ঘিঘিয়া নিজেও স্বীকার করেন, তাঁর জীবনে এমন পিনপতন নীরবতার মুখোমুখি তিনি কখনো হননি। ঘিঘিয়ার গোলের প্রভাব এতটাই বেশি ছিল যে সেদিন থেকে ব্রাজিলিয়ানদের জীবন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল ঘিঘিয়ার গোলের আগে ও পরে।
ম্যাচের শেষ বাঁশি গুঁড়িয়ে দিয়েছিল প্রত্যেক ব্রাজিলিয়ানের জীবন। পরাজয়ের হতাশায় ব্রাজিলের বিখ্যাত রেডিও জকি আরি বেরেসো আর কোনো দিনও মাইক হাতে তুলে নেননি। চারজন খেলোয়াড় মাঠ থেকেই ঘোষণা দেন অবসরের। এমনকি তাদের বিখ্যাত সাদা জার্সিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় নির্বাসনে। তৈরি করা হয় ব্রাজিলের বিখ্যাত হলুদ জার্সি।
১৯৫০ বিশ্বকাপ যতটা না স্মরণীয় হয়ে আছে বিশ্বকাপজয়ী উরুগুয়ের জন্য, তার চেয়েও বেশি স্মরণীয় হয়ে আছে ‘মারাকানজো’ ট্র্যাজেডির জন্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে বিশ্বকাপ আয়োজন চাট্টিখানি কথা নয়। অর্থনৈতিক দৈন্য, বড় দেশগুলোর পিছিয়ে পড়া—সবমিলিয়ে স্রোতের বিপরীতে হেঁটেও ঠিকই বিশ্বকাপ আয়োজন করেছিলেন ফিফা প্রেসিডেন্ট জুলে রিমে। তাঁর প্রতি সম্মান দেখিয়ে বিশ্বকাপ শিরোপার নাম দেওয়া হয় ‘জুলে রিমে ট্রফি’। আর দ্বিতীয়বারের মতো সেই ট্রফি উঁচিয়ে ধরে উরুগুয়ে।
এই জুলে রিমে ট্রফি নিয়ে শুরু হয় অঘোষিত এক লড়াই ইতালি আর উরুগুয়ের মধ্যে। তিনটি শিরোপা জিতলে পাকাপাকিভাবে জুলে রিমে ট্রফি হয়ে যাবে তাদের। কিন্তু কে জানত, সেদিন মারাকানায় এক ভয়ানক দানব তৈরি করেছে তারা। যা শুধু তাদেরই নয়, গ্রাস করতে চলেছে পুরো ফুটবল–বিশ্বকে।