সবসময় স্যুট আর পায়ে চকচকে বুট গলিয়ে পাক্কা ভদ্রলোক হয়ে ডাগআউটে দাঁড়িয়ে থাকা রবার্তো মার্তিনেজকে নিশ্চয়ই তোমাদের মনে আছে। ৫০ বছর বয়সী এই স্প্যানিশ কোচ বেলজিয়ামের কোচের আসনে ছিলেন সেই ২০১৬ থেকে। বেলজিয়ামের যে সোনালি প্রজন্মকে পেয়েছিলেন, তাদেরকে নিয়ে ইউরো বা বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চে এই রবার্তো মার্তিনেজই নিয়ে গেছেন। তাঁর ফুটবল–দর্শন সম্পর্কে কারও কোনো অভিযোগ নেই। তবে আদতে তিনি কিন্তু বেলজিয়ামকে কোনো সাফল্যই এনে দিতে পারেননি। যদিও সোয়ানসি, উইগান অ্যাথলেটিক, এভারটন এবং বেলজিয়ামের হয়ে লম্বা সময় কোচ হিসেবে কাটালেও বলার মতো তেমন সাফল্য নেই তাঁর কোচিং ক্যারিয়ারে। শিরোপা জিতেছেনও মাত্র একটি। তাই যখন তিনি পর্তুগালের কোচের দায়িত্বটা নিলেন, তাঁর দিকে প্রশ্নের তির ছুড়েছিলেন অনেকেই। কারণ, ফুটবল–দর্শন বা প্লেয়িং স্টাইল ছাপিয়ে দিন শেষে সাফল্য যদি ধরা না দেয়, তাহলে ফুটবলের এত কৌশল খাটানোর দরকার কী? অথবা সেই কোচকে কোনো দলের দায়িত্ব দেওয়ারই বা কী প্রয়োজন?
যদিও রবার্তো মার্তিনেজ এসব সমালোচনা আর প্রশ্নের ঝড়ের থোড়াই কেয়ার করেন। ২০২২ সালে পর্তুগালের দায়িত্ব পাওয়ার পর দল নিয়ে একের পর এক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গেছেন। ছক পাল্টেছেন, খেলোয়াড় পাল্টেছেন, এমনকি পর্তুগিজদের মহাতারকা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকেও উপেক্ষা করে গেছেন। তবে সফলতা যে ধরা দেয়নি তা–ও নয়।
ইউরো বাছাইপর্বে পর্তুগাল দশ ম্যাচে টানা দশটিতে জিতেছে। কোনো ম্যাচে ড্র পর্যন্ত করেনি। আর এই জয়যাত্রায় তারা গোল করেছে ৩৬টি। গত ইউরো বাছাইপর্বে ৩৬ গোলের বেশি তো দূরের কথা, ধারেকাছেও নেই কোনো দেশ। গোল করার রেকর্ড যেমন তাদের আক্রমণের শক্তিমত্তার দিক তুলে ধরে, তেমনই রক্ষণের দিক থেকেও তারা কম যায় না। বাছাইপর্বে তারা হজম করেছে মাত্র দুটি গোল। যদিও টানা দশ ম্যাচ জিতে পর্তুগাল তরি ডুবিয়েছে প্রীতি ম্যাচে এসে। সদ্য খেলা পাঁচটি প্রীতি ম্যাচে তারা হেরেছে ক্রোয়েশিয়া আর স্লোভেনিয়ার বিপক্ষে।
দলের শক্তিমত্তার প্রসঙ্গে আসার আগে ইউরোতে তাদের ইতিহাসটা একবার আলোচনা করা জরুরি। ইউরোতে অন্যতম সফল দল তারা। শিরোপা ঘরে তুলেছে একবার। দুবার ফাইনাল খেলার পাশাপাশি সেমিফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছেছে তিনবার। তাই নিজেদের কোচের শিরোপাখরা তাদের ইউরো–যাত্রা কিছুটা স্মিত করে দিলেও নিজেদের রেকর্ডের ভরসায় নিজেরা মানসিকভাবে উদীপ্ত থাকা উচিত।
রবার্তো মার্তিনেজ এখন পর্যন্ত পর্তুগালকে কোনো নির্দিষ্ট কোনো ছকে খেলাননি। ৪-৩-৩ থেকে ৪-২-৩-১ এমনকি মতান্তরে ৩-৪-২-১ ও ৪-১-৪-১ ছকেও তাদের খেলতে দেখা গেছে। প্রতিপক্ষ বুঝে ছক পাল্টানোর পাশাপাশি ক্রমাগত পাল্টেছে তাঁর একাদশের খেলোয়াড়ও। এ জন্য ঠিক কোন ফরমেশন আর কী একাদশ তিনি নামাবেন, সেটা আগে থেকে আন্দাজ করা বেশ মুশকিল। গোলবারে মাঝেমধ্যে রুই প্যাট্রিসিও এবং জোসে সা খেললেও নিয়মিত মুখ হিসেবে থাকবেন দিয়েগো কস্তা। ছক পাল্টালেও মার্তিনেজ সব সময় ফোর-ম্যান ব্যাকলাইন খেলান। ফর্ম বিবেচনায় জোয়াও কানসেলো এবং দিয়েগো ডালৌর ফুলব্যাকে থাকার কথা। তবে বদলি হিসেবে নুনো মেন্দেস আর নেলসল সেমেদোও রয়েছেন। ডিফেন্ডার হিসেবে ম্যানচেস্টার সিটির রুবেন দিয়াজের স্থান নিশ্চিত। কিন্তু তাঁর সঙ্গে জুটি বাঁধবেন কে? দলের সব থেকে বয়স্ক খেলোয়াড় পেপে নাকি স্পোর্টিং সিপির তরুণ ডিফেন্ডার গনকালো ইনাসিও? প্রথম ম্যাচে মার্তিনেজ পেপের দীর্ঘ ক্যারিয়ারের অভিজ্ঞতার ওপর বেশি আস্থা রেখেছেন।
মধ্যমাঠে নাম্বার সিক্সের পজিশন পিএসজি মিডফিল্ডার ভিতিনহার জন্য তুলে রাখা। মার্তিনেজ ভিতিনহার সঙ্গে পালহিনহা এবং ব্রুনোকে নামিয়ে প্রথাগত থ্রি-ম্যান মিডফিল্ডার নামাতে পারেন। সুযোগ রয়েছে ভিতিনহা এবং রুবেন নেভেসকে ডাবল পিভট হিসেবে খেলিয়ে ব্রুনোকে প্লেমেকার হিসেবে খেলানোর। এ ক্ষেত্রে মিডফিল্ডার বের্নার্দো সিলভা চলে যাবেন উইঙ্গার পজিশনে। এ ছাড়া সম্প্রতি দানিলো পেরেইরাকে রক্ষণে দিয়ে মার্তিনেজ ৩-৪-২-১ ছকেও খেলিয়েছেন। তখন ডালৌ আর কানসেলো আরও আক্রমণাত্মক ভূমিকায় খেলার পাশাপাশি মধ্যমাঠের ক্রিয়েটিভিটিও বেশ বাড়িয়ে তোলেন।
আক্রমণভাগেও রয়েছে দারুণ কিছু অপশন। ফর্মে আছেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। সৌদি লিগে তাঁর দুর্দান্ত ফর্মের পাশাপাশি জাতীয় দলের হয়ে শেষ ম্যাচেও গোল পেয়েছেন তিনি। প্রথম ম্যাচে বেশ কয়েকটি সুযোগ পেলেও কাজে লাগাতে পারেননি তিনি। তাঁর সঙ্গে উইঙ্গার হিসেবে থাকছিলেন সিলভা এবং রাফায়েল লিয়াও। যদিও এসি মিলানের হয়ে শেষ মৌসুমটা লিয়াওয়ের তেমন ভালো কাটেনি। দ্বিতীয়ার্ধে মাঠে নেমেছিলেন জোতাও। এ ছাড়া ফলস নাইন বা আক্রমণের ডান পাশে খেলার জন্য তো জোয়াও ফেলিক্স আছেনই।
প্রথম ম্যাচে চেক প্রজাতন্ত্রের বিপক্ষে ১ গোলে পিছিয়ে পড়েছিল পর্তুগাল। শেষ পর্যন্ত ২-১ গোলে জয় পেলেও দুটি প্রশ্ন খচখচ করবে পর্তুগিজদের মনে। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো স্বয়ং পর্তুগালের জন্য কোনো সমস্যার কারণ হবেন না তো? আর সোনালি প্রজন্ম পেয়েও বেলজিয়ামকে রবার্তো মার্তিনেজ যে হতাশা উপহার দিয়েছেন, পর্তুগালকে যদি আবার সেই ভাগ্য বরণ করে নিতে হয়?
গ্রুপ এফের বাকি দল চেক প্রজাতন্ত্র বা তুরস্কের শক্তিমত্তার কাছাকাছি না হয়েও নিজেদের প্রথম ইউরো খেলতে জর্জিয়া এসেছে তাদের দলগত পারফরম্যান্সের ওপর ভরসা করেই। বাছাই পর্বে গ্রুপ এ–তে চতুর্থ হয়েছিল তারা। এরপর প্লে-অফে গ্রিস আর লুক্সেমবার্গকে হারিয়ে একরকম ইতিহাসই রচনা করেছে। সম্প্রতি প্রীতি ম্যাচে মন্টেনেগ্রোর সঙ্গেও জয় পেয়েছে উইলি স্যানিওলের শিষ্যরা। প্লে-অফে লুক্সেমবার্গকে টাইব্রেকারে হারানোর পেছনের নায়ক ভ্যালেসিয়ার গোলরক্ষক জিওর্গি মামারদাশভিলি। ইউরোতে নজর রাখতে পারো এই তরুণ গোলরক্ষকের প্রতি। তবে ছোট্ট এই দেশের ফুটবলের সবচেয়ে বড় নায়কের হচ্ছেন নাপোলির উইঙ্গার খভিচা কাভারাটস্খেলিয়া। ২০২২–২৩ মৌসুমে নাপোলিকে লিগ শিরোপার স্বাদ এনে দেওয়ার নায়ক জর্জিয়ার হয়ে স্মরণীয় কিছু মুহূর্ত উপহার দেবেন বলেই ফুটবলবোদ্ধাদের বিশ্বাস। যদিও প্রথম ম্যাচে তুরস্কের কাছে ৩-১ গোলে হেরেছে জর্জিয়া।
এই গ্রুপ থেকে চমক দেখাতে পারেন ভিনসেঞ্জো মন্তেয়ার তুর্কি। বাছাইপর্বে ক্রোয়েশিয়াকে দ্বিতীয় করে, আট ম্যাচের মধ্যে মাত্র একটি ম্যাচে হেরে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে ইউরোতে এসেছে তারা। কিন্তু বাছাইপর্ব শেষ করার পরে প্রীতি ম্যাচে তাদের পারফরম্যান্স ভীষণ হতাশাজনক। শেষ পাঁচ ম্যাচে ইতালির সঙ্গে ড্র করলেও বাকিগুলো তারা হেরেছে। কিছুটা রক্ষণাত্মক ফুটবল খেললেও তাদের আক্রমণে আছেন দারুণ কিছু খেলোয়াড়। জুভেন্টাসের মিডফিল্ডার কেনান ইলদিজ আছেন। প্রথম ম্যাচেই নিজের জাত চিনিয়েছেন রিয়াল মাদ্রিদের তরুণ আরদা গুলের। ক্লাবের হয়ে শেষ কয়েক ম্যাচে নিয়মিত গোল করা গুলের দুর্দান্ত এক গোল করে রাঙিয়েছেন ইউরোর মঞ্চ। এ ছাড়া হাকান চালানোগ্লুর পাশাপাশি মধ্যমাঠে আছেন ওরকুন কোকচু এবং সালিহ ওজকান।
একসময়ের পরাশক্তি চেক রিপাবলিক এখন শক্তি হারিয়ে অনেকটাই দৃশ্যপট থেকে সরে গেছে। তবে ইউরোর মঞ্চে বরাবরই নিয়মিত ছিল তারা। খেলেছে ১৯৯৬ সালের ফাইনাল। আর ২০০৪ সালের ইউরোতে তারা পৌঁছেছিল সেমিফাইনাল পর্যন্ত।
ইউরোর বাছাইপর্বে গ্রুপ এফে এবার দ্বিতীয় হয়েছে তারা। ৮ ম্যাচ খেলে জয় পেয়েছে মাত্র ৪টিতে। একমাত্র হার শুধু গ্রুপ চ্যাম্পিয়ান আলবেনিয়ার কাছে। তবে ইউরোর আগে প্রীতি ম্যাচে দারুণ ফর্মের আভাস দিয়েছেন ইভান হাসেকের শিষ্যরা। চার ম্যাচের সব কটিতেই জয় তুলে নিয়েছে তারা। এমনকি হারিয়েছে হালান্ডের নরওয়েকেও।
নতুন কোচ ইভান হাসেক সাধারণত ৪-২-৩-১ মতান্তরে ৩-৪-১-২ ছকে ডাবল পিভটে খেলাতে পছন্দ করেন। তাঁর মাঝ মাঠের মূল শক্তির চাবিকাঠি হিসেবে থাকবেন দলের ক্যাপ্টেন টমাস সুচেক। তা ছাড়া প্যাট্রিক শিক আর অ্যাডাম হিলজেকের মতো দুজন দারুণ স্ট্রাইকার আছেন তাঁর দলে। তাই চাইলে এই দুজন স্ট্রাইকারকে রেখেই স্কোয়াড সাজাতে পারেন তিনি।
হেড টু হেডের লড়াইয়ে কিছুদিন আগেই পর্তুগালের বিপক্ষে টানা দুবার তারা নেশনস লিগে হেরেছে। মোট পাঁচবারের দেখায় পর্তুগিজরাই জিতেছে চারটিতে। গ্রুপের বাকি দুই দলের মধ্যে ইউরোতে এই প্রথমবার জর্জিয়ার মুখোমুখি হবে তারা। তা ছাড়া তুরস্কের বিপক্ষে চেক প্রজাতন্ত্রের পরিসংখ্যানও কোনো আশার বাণী শোনায় না। কারণ, সাতবারের দেখায় পাঁচবারই জিতেছে তুরস্ক। অন্যদিকে তুরস্কের বিপক্ষে ইউরোর মঞ্চে প্রত্যেকবার জয় পেয়েছে পর্তুগাল। মুখোমুখি দেখায় মোট পাঁচবারের ভেতর তাদের জয় চার ম্যাচে। এ ছাড়া প্রীতি ম্যাচে দুবার জর্জিয়ার মুখোমুখি হলেও ইউরোতে কখনো এই দুই দেশ একে অপরের মুখোমুখি হয়নি। পর্তুগালের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে সম্ভাবনা জাগিয়েও শেষ পর্যন্ত পেরে ওঠেনি চেকরা।
গ্রুপ ডির ম্যাচগুলো:
রাউন্ড এক:
তুরস্ক বনাম জর্জিয়া —১৮ জুন (রাত ১০টা)
খেলার ফল: তুরস্ক ৩-১ জর্জিয়া
পর্তুগাল বনাম চেক প্রজাতন্ত্র—১৯ জুন (রাত ১টা)
খেলার ফল: পর্তুগাল ২-১ চেক প্রজাতন্ত্র
রাউন্ড দুই:
জর্জিয়া বনাম চেক প্রজাতন্ত্র—২২ জুন (সন্ধ্যা ৭টা)
তুরস্ক বনাম পর্তুগাল—২২ জুন (রাত ১০টা)
রাউন্ড তিন:
জর্জিয়া বনাম পর্তুগাল—২৭ জুন (রাত ১টা)
চেক প্রজাতন্ত্র বনাম তুরস্ক—২৭ জুন (রাত ১টা)