কেমন হলো এবারের দলবদলের মৌসুম
দলবদলের মৌসুম মানেই টাকার ছড়াছড়ি, পছন্দের খেলোয়াড়দের নিয়ে হেভিওয়েটদের কাড়াকাড়ি আর প্রিয় খেলোয়াড়কে পছন্দের জার্সিতে দেখার অপেক্ষা দর্শকদের। গত কয়েকবারের তুলনায় বেশ ম্যাড়মেড়েই গেছে এবারের দলবদলের মৌসুমটা। টাকাপয়সার ছড়াছড়ি হলেও দলবদলের মৌসুমের যে উত্তেজনা, তা ছড়িয়ে যেতে পারেনি ফুটবলপ্রেমীদের মনে। বাজারে আগুন না লাগায় এবারের দলবদলের মৌসুমটা বেশ ‘ঠান্ডা’ই গেছে। তার অর্থ এই নয় যে খরচ হয়নি। বড় দলগুলো পিছিয়ে থাকলেও ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগে টাকার ছড়াছড়ি থেমে থাকেনি।
ইউরোপের শীর্ষ ৫ লিগে খেলোয়াড় কেনা–বেচায় খরচ হয়েছে ৫ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ইউরো। টাকার অঙ্কে যা ৭০ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। দেদারসে টাকা খরচ করলেও গত মৌসুমের তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে আছে এবারের দলবদলের মৌসুম। গত মৌসুমে খরচ হয়েছিল প্রায় ৫ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ইউরো। এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ, ইউরোপিয়ান হেভিওয়েটদের অনুপস্থিতি।
রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, ম্যানচেস্টার সিটি, লিভারপুলের মতো দল খেলোয়াড় কেনা–বেচা করেছে বেশ ঠান্ডা মাথায়। বড় কোনো খরচই হয়নি তাদের। রিয়াল মাদ্রিদ তো কিলিয়ান এমবাপ্পেকে দলে ভিড়িয়েছে কোনো টাকাপয়সা খরচ না করেই। সে অর্থে বড় কোনো খরচ করেনি ম্যানচেস্টার সিটিও; বরং নিজেদের বড় দুই তারকা জুলিয়ান আলভারেজ আর হোয়াও ক্যান্সেলোকে বিক্রি করেছে চড়ামূল্যে। লিভারপুলও একই পথে হেঁটেছে।
এ ছাড়া এবারের দলবদলে তুলনামূলকভাবে বেশ শান্ত ছিল সৌদি ক্লাবগুলো। উচ্চাভিলাষী দলবদল নয়, বরং নিজেদের গ্যাপগুলো পূরণের চেষ্টা করেছে তারা। যে কারণে দলবদলের বাজারে উচ্চমূল্যে খেলোয়াড় কেনার দৌড়ে বেশ এবার বেশ পিছিয়ে আছে তারা।
এই মৌসুমে টাকার ছড়াছড়ি হয়েছে শিরোপাসন্ধানী দলগুলোতে। কয়েক মৌসুম ধরেই ব্যর্থতার বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। রেড ডেভিলরা তাই বেশ চাঙা ছিল এবারের দলবদলের মৌসুমে। ডিফেন্সে লেনি ইয়োরো, ম্যাথিয়াস ডি লিট, নাসির মাজরাউইয়ের মতো তরুণ তারকা। মাঝমাঠে ম্যানুয়েল উগার্তের মতো অভিজ্ঞ খেলোয়াড় আর ফরোয়ার্ডে জশুয়া জিরকজি। দলবদল ভালো হলেও এখন পর্যন্ত মাঠে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না তাঁদের। ৬২ মিলিয়ন ইউরোর ডিফেন্ডার ইয়োরো মৌসুম শুরুর আগেই পড়েছেন ইনজুরিতে। বাকিরাও নিজেদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন মাঠে।
চাঙা ছিল চেলসিও। নতুন মালিক টড বোহেলির আগমনের পর থেকে দেদারসে খরচ করে যাচ্ছে তারা। বড় কোনো তারকাকে ভেড়াতে নয়, বরং নতুন নতুন খেলোয়াড় দলে ভেড়ানোই যেন তাদের কাজ। মৌসুমের একপর্যায়ে তাদের মূল দলে খেলোয়াড়ের সংখ্যা ছিল ৪৫! যদিও তাঁদেরকে ধারে পাঠিয়ে এখন মূল দলে আছেন ২৯ জন। পেদ্রো নেতো, জোয়াও ফেলিক্স, জ্যাডোন সানচোকে দিয়ে আক্রমণভাগ সমৃদ্ধ করলেও খুব একটা লাভ হয়নি। নতুন কোচ এনজো মারেস্কার অধীনে এখনো খাবি খাচ্ছে ব্লুজরা।
তবে এই মৌসুমে খরচের দিক থেকে এগিয়ে আছে মধ্যম সারির দলগুলো। শুধু প্রিমিয়ার লিগ নয়, লা লিগা থেকে শুরু করে সিরি আ, টাকা খরচের দিক দিকে শিরোপাপ্রত্যাশী দলগুলোর বদলে এগিয়ে শীর্ষ চারের জন্য লড়াই করা দলগুলো। ব্রাইটন, অ্যাস্টন ভিলা, টটেনহাম খরচ করেছে দুই হাত ভরে। অন্যদিকে স্পেনের আতলেতিকো মাদ্রিদ, ইতালির নাপোলি, এমনকি ফ্রান্সের অলিম্পিক লিঁও পর্যন্ত এবারের মৌসুমে খরচের বন্যা বইয়েছে। লিগের হেভিওয়েট দলগুলোকে টেক্কা দিতে চাইলে টাকা খরচের যে বিকল্প নেই, তা খুব ভালোভাবেই বুঝতে শুরু করেছে দলগুলো। তাই তো মৌসুমের সবচেয়ে আলোচিত দলবদলগুলো হয়েছে তাদের হাত ধরেই।
এবারের দলবদলের মৌসুমের চমক ছিল স্প্যানিশ দল আতলেতিকো মাদ্রিদ। তিন বছর ধরে ঘরে আসেনি কোনো শিরোপা। বর্তমান সময়ের সর্বোচ্চ বেতনধারী কোচ ডিয়েগো সিমিওনের কপালে সামান্য চিন্তার ভাঁজ আছে বৈকি। এ কারণেই এই মৌসুমে আটঘাট বেঁধে নেমেছে লস কলচোনেরোরা। জোয়াও ফেলিক্স, আলভেরো মোরাতার মতো খেলোয়াড়কে পত্রপাঠ বিদায় করেছেন। তাঁদের জায়গায় ভিড়িয়েছেন প্রিমিয়ার লিগের দুই তারকা জুলিয়ান আলভারেজ আর কনর গ্যালাগার। বিশ্বকাপজয়ী আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকারকে ভেড়াতে আতলেতিকোকে খরচ করতে হয়েছে ৭৫ মিলিয়ন ইউরো। এই মৌসুমের সর্বোচ্চ দলবদল এটিই। এ ছাড়া রবিন লা নরমান, অ্যালেক্সেন্দার সরলথের মতো লা লিগা পরীক্ষিত খেলোয়াড় দিয়ে মৌসুম শেষ করেছে তারা। শিরোপার জন্য বেশ আটঘাট বেঁধেই নেমেছে তারা।
বড় দলগুলোর মধ্যে হাত খুলে খরচ করতে দেখা গেছে পিএসজি আর জুভেন্টাসকে। তবে তারাও পা ফেলেছে সাবধানে। বড় নামের পেছনে না ছুটে যে ধরনের খেলোয়াড় দরকার, তেমন খেলোয়াড়ই ভিড়িয়েছে পিএসজি। ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার ম্যানুয়েল উগার্তের বিদায়ে দলে যোগ দিয়েছেন জোয়াও নেভেস। কিলিয়ান এমবাপ্পের ফেলে রাখা জায়গায় যোগ দিয়েছেন গত মৌসুমে চমক দেখানো ১৯ বছর বয়সী উইঙ্গার দেসিয়ে দুরে। অন্যদিকে নতুন কোচ থিয়াগো মোত্তার অধীনে নিজেদের মাঝমাঠ শক্ত করেছে জুভেন্টাস। টিউন কুপমেইনার্স, ডগলাস লুইস, খেপরেন থুরামের মতো খেলোয়াড় যোগ দিয়েছেন জুভেন্টাসে। ফ্রান্সিসকো কনসিকাও, নিকো গঞ্জালেজের মতো উইঙ্গার আর গত মৌসুমের সেরা গোলরক্ষক মিশেল ডি জর্জিও; ভালো দল গড়তে যে বড় নামের দরকার হয় না, তার প্রমাণ এই দুই দল।
এ ছাড়া এবারের দলবদলে তুলনামূলকভাবে বেশ শান্ত ছিল সৌদি ক্লাবগুলো। উচ্চাভিলাষী দলবদল নয়, বরং নিজেদের গ্যাপগুলো পূরণের চেষ্টা করেছে তারা। যে কারণে দলবদলের বাজারে উচ্চমূল্যে খেলোয়াড় কেনার দৌড়ে বেশ এবার বেশ পিছিয়ে আছে তারা। তাদের মোট খরচ ৪৬৭ মিলিয়নের কাছাকাছি। মৌসুমে তা ছিল প্রায় এক বিলিয়নের কাছাকাছি! খরচের দিক থেকে বরাবরের মতোই এগিয়ে আছে প্রিমিয়ার লিগ। এই মৌসুমে মোট ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ইউরো খরচ করেছে প্রিমিয়ার লিগের দলগুলো। দ্বিতীয়তে আছে ইতালিয়ান সিরি আ। এই মৌসুমে তাদের খরচ ৭৪৭ মিলিয়ন ইউরো। বার্সা-রিয়ালের অনুপস্থিতিতে লা লিগা পিছিয়ে পড়েছে তৃতীয় স্থানে। তাদের খরচের পরিমাণ ৫৫৫ মিলিয়ন ইউরো।
দলবদলের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ। এখন অপেক্ষা বিশাল মৌসুমের। তিন মাস ধরে খাটাখাটুনি করে যে দল সাজানো হলো, তারা ভক্তদের আশা পূরণ করতে পারে কি না, সেই প্রশ্নই এখন সবার।