চমকে ঠাসা, রোমাঞ্চে ভরা এক চ্যাম্পিয়নস লিগ মৌসুম দেখল ফুটবল–বিশ্ব। ২০২২ ফুটবল বিশ্বকাপের কারণে এবারের লিগ ফুটবল–সূচিতে নানা রকম পরিবর্তন এসেছিল। অল্প সময়ের ব্যবধানে একাধিক ম্যাচ খেলা, প্লেয়ারদের ক্লান্তি—সব মিলিয়ে ধারণা করা হয়েছিল ম্যাড়ম্যাড়ে এক মৌসুম হয়তো দেখা যাবে এবার। কিন্তু ভুল প্রমাণিত হয়েছে সেসব।
চ্যাম্পিয়নস লিগের প্রথম চমকটা দেখায় ইতালির ক্লাব নাপোলি। গতবারের রানার্সআপ এবং ইংল্যান্ডের অন্যতম শক্তিশালী ক্লাব লিভারপুলকে গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে উড়িয়ে দেয় ৪-১ গোলে! নাপোলির দুর্দান্ত মৌসুমের ইশারা ওই দিনই পাওয়া যায়।
তবে সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছে বার্সেলোনা ও জুভেন্টাস। ইউরোপের জায়ান্ট দুই দলই ব্যর্থ হয় গ্রুপ পর্বের বাধা পার হতে। বার্সেলোনা অবশ্য ছিল গ্রুপ অব ডেথে—বায়ার্ন মিউনিখ ও ইন্টার মিলানের সঙ্গে। দুর্ভাগ্যক্রমে ডেথ পেনাল্টিটা পড়ে তাদের ঘাড়েই! অন্যদিকে একেবারে হতশ্রী ফুটবল খেলে বাদ পড়েছে জুভেন্টাস। পিএসজি, বেনফিকা, মাক্কাবি হাফিয়ার সঙ্গে লড়াইয়ে সবার শেষে থেকেছেন বনুচ্চি-ডি মারিয়ারা।
জুভেন্টাস না পারলেও প্রত্যাশার চেয়ে বেশি ভালো খেলেছে অন্য ইতালিয়ান দলগুলো। নাপোলি, এসি মিলান, ইন্টার মিলান একে একে পৌঁছেছে কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল এবং ফাইনালের সিঁড়িতে। প্রায় ১৬ বছর পর সেমিফাইনালে পৌঁছানোয় আনন্দে মেতেছিল এসি মিলান ভক্তরা। টটেনহামের বিপক্ষে শেষ ষোলো এবং নাপোলির বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনাল জিতে সাফল্যের উন্মাদনা ঘিরে ধরেছিল রোজোনেরিদের। কিন্তু সেই আনন্দ স্থায়ী হয়নি চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইন্টার মিলানের কাছে ডার্বির দুই লেগই হেরে সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নেওয়ায়।
ইতালিয়ান ক্লাবগুলোর ভালো ফলাফলের বিপরীতে একেবারেই হতাশ করেছে স্প্যানিশ ক্লাবগুলো। একমাত্র রিয়াল মাদ্রিদ ছাড়া আর কোনো দলই পার হতে পারেনি গ্রুপ পর্ব। বার্সেলোনা, সেভিয়া, অ্যাতলেতিকো মাদ্রিদের দীনতা ফুটে উঠেছিল মাঠের খেলাতেই। ইউরোপের সফলতম দল রিয়াল মাদ্রিদকে অবশ্য থামতে হয়েছে সেমিফাইনালেই। তার আগে অবশ্য মাদ্রিদের কাছে বিদায় নিয়েছে গতবারের রানার্সআপ লিভারপুল এবং আরেক ইংলিশ ক্লাব চেলসি। তেড়েফুঁড়ে এগোতে থাকা আনচেলত্তির মাদ্রিদের সামনে পড়ে গত মৌসুমের সেই পুরোনো প্রতিপক্ষ—ম্যানচেস্টার সিটি। তবে এবার সেমিফাইনালে আর রূপকথার মতো জয় ছিনিয়ে আনতে পারেননি ভিনিসুয়াস, রদ্রিগোরা। বেনজেমা-মদ্রিচরা উল্টো নাস্তানাবুদ হয়েছেন সিটির কাছে।
চ্যাম্পিয়নস লিগে ছোট লিগের চমক দেখানো দলগুলোর মধ্যে একটির নাম—ক্লাব ব্রুগা। বেলজিয়ামের ক্লাবটি নিজেদের প্রথম তিন গ্রুপ ম্যাচে নিজেদের চেয়ে শক্তিশালী বায়ার লেভারকুসেন, পোর্তো এবং অ্যাতলেতিকো মাদ্রিদকে হারিয়ে নজর কেড়ে নেয় সবার। ফেরান জুতগুলা এবং কামাল সোয়াহের পায়ে ভর দিয়ে তারা নিশ্চিত করে পরবর্তী রাউন্ড। সেখানে অবশ্য বেনফিকার কাছে ধরাশায়ী হয়ে বিদায় নিতে হয় নীল-কালো জার্সিধারী ক্লাবটিকে।
গ্রুপ রাউন্ড পার করা আরেকটি অপ্রত্যাশিত দলের নাম—আইনট্রাখট ফ্রাঙ্কফুর্ট। গতবার ইউরোপা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সুবাদে এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগের টিকিট পায় জার্মান দলটি। কিন্তু গ্রুপ পর্বে তাদের চেয়ে সামর্থ্যবান ধরা হচ্ছিল পর্তুগালের স্পোর্টিং সিপি এবং ফ্রেঞ্চ ক্লাব অলিম্পিক মার্শেইকে। কিন্তু তারা দুটি দলকেই একবার করে হারিয়ে শেষ ষোলোর টিকিট নিশ্চিত করে। যদিও সেখানে পরাক্রমশালী নাপোলির বিপক্ষে পেরে ওঠেনি ‘ডি অ্যাডলার’ বা ইগল নামে পরিচিত দলটি।
ভুলে যাওয়ার মতো সময় কেটেছে পিএসজিরও। মেসি, এমবাপ্পে, নেইমার, রামোসের মতো তারকায় ভরা প্যারিস সেন্ট–জার্মেই বিদায় নিয়েছে শেষ ষোলো থেকেই। বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে দুই লেগের কোনোটিতেই গোল করতে পারেনি তারা। মাথা নিচু করে মাঠ ছাড়তে হয়েছে তাদের। অপরিকল্পিতভাবে টাকা ঢাললেই যে ফুটবলে রাতারাতি সাফল্য মেলে না, এই তিতা কথা মেনে নিতে হচ্ছে পিএসজিকে।
বায়ার্ন মিউনিখ অবশ্য থেমে গেছে কোয়ার্টার ফাইনালে। ইউরোপের নতুন পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়া ম্যানচেস্টার সিটির সামনে নত স্বীকার করতে হয়েছে বাভারিয়ানদের। দুই লেগ মিলিয়ে ৪-১ গোলের হার লেখা হয়েছে তাদের নামের পাশে। তবে কোয়ার্টার ফাইনালের ঠিক আগে কোচ নাগলসমানকে ছাঁটাই না করলে ফলটা অন্য রকম হতো কি না, সেটা নিয়ে এখনো তর্ক করছেন বায়ার্ন–ভক্তরা।
পিএসজির মতো ধনী এবং টাকা দিয়ে প্রায় যেকোনো খেলোয়াড়কে কিনে ফেলার সামর্থ্য রাখে ম্যানচেস্টার সিটি। কিন্তু একটাই পার্থক্য ফ্রেঞ্চ পরাশক্তিদের সঙ্গে—পেপ গার্দিওলা। কোচ এবং ম্যানেজার হিসেবে গার্দিওলার সুপরিকল্পিত ছকে এগোনোর ফল হিসেবে গত তিন মৌসুমের মধ্যে দ্বিতীয় চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল খেলছে সিটিজেনরা। দাপটের সঙ্গে লাইপজিগ, বায়ার্ন মিউনিখ ও রিয়াল মাদ্রিদকে হারিয়েছে তারা নকআউট রাউন্ডের ম্যাচে। ডি ব্রুইনার অনন্য সুন্দর পাসিং এবং আরলিং হলান্ডের নিখুঁত ফিনিশিং ম্যান সিটিকে করেছে অদম্য। রিয়াল মাদ্রিদকে ঘরের মাঠ ইতিহাদে ৪-০ গোলে তছনছ করে দেওয়ার পর তাই কার্লো আনচেলত্তি বলতে বাধ্য হয়েছেন, “বলতে দ্বিধা নেই, এবার ওরাই সেরা”।
ইন্টার মিলানের চ্যাম্পিয়নস লিগ–যাত্রাটা আবার একেবারেই ভিন্ন। একসময়ের দাপট দেখানো ইন্টার যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জৌলুশ হারিয়ে ফেলেছে, এটা কারও অজানা নয়। গ্রুপ অব ডেথ থেকে বার্সেলোনাকে হটিয়ে রানার্সআপ হয়ে তাদের নকআউট রাউন্ডের টিকিট পাওয়া। এরপর পোর্তো, বেনফিকা এবং এসি মিলানকে নকআউট করে ফাইনালের নিশ্চয়তা পাওয়া। লাওতারো মার্তিনেজ-বারেল্লাদের নিয়ে গড়া ইন্টার প্রায় সব ম্যাচেই খেলেছে অ্যাটাকিং এবং ডিফেন্ডিংয়ের ভারসাম্যপূর্ণ খেলা। সেই সঙ্গে দলগত পারফরম্যান্সও রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
এক যুগেরও বেশি সময় ধরে চ্যাম্পিয়নস লিগ মাতিয়ে রাখা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে মিস করেছে সবাই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ধার হারিয়েছেন লিওনেল মেসিও। তাঁদের জুতায় কিছু সময়ের জন্য পা গলানো করিম বেনজেমা এবং রবার্ট লেফানডফস্কিও তেমন কিছু করতে পারেননি এবার। ফাঁকা হয়ে যাওয়া ওই জায়গায় এবার পা রেখেছেন আরলিং হালান্ড। ৬ ফুট ৪ ইঞ্চির বিশালদেহী এই নরওয়েজিয়ানই তাই এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগে ১২ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে। নতুন প্রজন্মের অন্যতম সেরা ফুটবলার এমবাপ্পের সঙ্গে তার গোল ব্যবধান ৫। হলান্ডের পেছনে অবশ্য পেপ গার্দিওলার অবদানের কথা অনস্বীকার্য। সামনের মৌসুম থেকে হলান্ডকে নিয়ে সময়ের সেরার তর্ক উঠবে—সে কথা বলা বাহুল্য। তবে তার আগে জিততে হবে এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল।
ফাইনাল অনুষ্ঠিত হবে তুরস্কের আতাতুর্ক অলিম্পিক স্টেডিয়ামে। ১১ জুন বাংলাদেশ সময় রাত ১টায় দেখা যাবে ম্যাচটি।