বাংলাদেশের ক্রিকেটে তরুণ প্রতিভা আসা নতুন কিছু নয়। অনেক খেলোয়াড়ই আসেন ক্রিকেটপাগল এই জাতিকে স্বপ্ন দেখাতে, তাঁদের মধ্যে সাকিব-মুশফিকদের মতো অনেকেই স্থান করে নেন মানুষের হৃদয়ে। মেহেদী হাসান মিরাজ ভারতের বিপক্ষে দুটি ম্যাচে যে কাজ করলেন, তাতে তিনিও যে দেশের ক্রিকেট ছাড়িয়ে বিশ্ব ক্রিকেট রূপকথারই অংশ হবেন, সে কথা বলাই বাহুল্য!
মিরাজের আগমনী ধ্বনি শোনা গিয়েছিল ২০১৬ সালে দেশের মাটিতে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে। ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট হওয়ার দৌড়ে চার ফিফটিতে ২৪২ রান আর পাশাপাশি ১২ উইকেট নেওয়া মিরাজের ধারেকাছে ছিলেন না কেউ। ডাক পেয়ে যান ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে। অভিষেকেই ৬ উইকেট নিয়ে ধসিয়ে দেন ইংল্যান্ডের ব্যাটিং লাইনআপ। তবে ব্যাটিং–ব্যর্থতায় ম্যাচ হারে বাংলাদেশ। পরের ম্যাচে দুই ইনিংস মিলিয়ে ১২ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে দেওয়ার গুরুদায়িত্বটা এবার নিজেই পালন করেন তিনি। শুরুর দিকে ১০ নম্বরে ব্যাটিং করা মিরাজ বলেছিলেন, শুধু বোলিং নয়, সুযোগ পেলে ব্যাটিংয়েও নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ রাখতে চান তিনি। তবে ২০২১–এ চট্টগ্রাম টেস্টে সেঞ্চুরির আগপর্যন্ত মূলত দলে বোলার হিসেবেই টেস্ট দলে খেলতেন তিনি। ওয়ানডেতে অবশ্য প্রথমবার ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়েই করেছিলেন হাফ সেঞ্চুরি। ২০১৭ সালের সেই ম্যাচের পর ওয়ানডেতে পরবর্তী হাফ সেঞ্চুরিটি পেতে তাঁর সময় লাগে পাক্কা পাঁচ বছর। আফগানিস্তানের বিপক্ষে ২১৬ রানের টার্গেটে মাত্র ৪৫ রানে ৬ উইকেট হারায় বাংলাদেশ। আরেকটি বিব্রতকর পরাজয় যখন চোখ রাঙাচ্ছে বাংলাদেশকে, তখন আফিফ-মিরাজের অবিস্মরণীয় ১৭৪ রানের জুটিতে জয়ের বন্দরে পৌঁছায় বাংলাদেশ।
এই দুই অর্ধশতকের মাঝের পথচলাটা কিন্তু মিরাজের জন্য মোটেও সহজ ছিল না। ওয়ানডে দলে মিরাজের কাজ কী, কেন তাকে রাখা হচ্ছে, এমন প্রশ্ন উঠেছিল কয়েকবার। ওয়ানডেতে ৮ নম্বরে ব্যাট করে সর্বোচ্চ ইনিংসগুলোর মধ্যে শীর্ষ দশে জায়গা করে নেয় আফগানিস্তানের বিপক্ষের এই ইনিংস। কিন্তু শীর্ষ দশে হয়তোবা মন ভরছিল না মিরাজের। তাই এবার ভারতেই বিপক্ষে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ৮ নম্বরে ব্যাটিং করে সর্বোচ্চ ইনিংসটা নিজের করে নিলেন তিনি। মিরাজের আগে মাত্র একজন ক্রিকেটারের রেকর্ড ছিল ওয়ানডেতে ৮ নম্বরে ব্যাটিংয়ে নেমে সেঞ্চুরি করার। আয়ারল্যান্ডের সিমি সিং দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে অপরাজিত ১০০ করলেও আয়ারল্যান্ড কিন্তু ম্যাচটি জিততে পারেনি।
তবে রেকর্ড বুক বাদ দিয়েও এই সিরিজে মিরাজ যা করেছেন, তার মহার্ঘ অনেক। প্রথম ম্যাচে ১২৮ রানে ৪ উইকেট থেকে যখন বাংলাদেশ যখন হঠাৎ ১৩৬ রানে ৯ উইকেট হয়ে গেল, শেরেবাংলার গ্যালারি ততক্ষণে ফাঁকা। আর হবে নাই–বা কেন! ভারতের বিপক্ষে শেষ জুটিতে ৫১ রান করা কি কখনো সম্ভব? কিন্তু অসম্ভবকেই সম্ভব করল মিরাজের ছবির মতো সুন্দর এক ইনিংস। স্কোরবোর্ডে লেখা থাকবে মিরাজের ৩৯ বলে ৩৮ রান। কিন্তু যেটা লেখা থাকবে না, সেটা হচ্ছে মিরাজের বুক চিতিয়ে লড়ে যাওয়া, লেখা থাকবে না অসম্ভব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মারা দুটি ছয়। লেখা থাকবে না মুস্তাফিজকে দিয়ে স্ট্রাইক রোটেট করানো।
গতকালের ম্যাচে তো মিরাজ লিখলেন আরেক মহাকাব্য। টসে জিতে ব্যাটিংয়ে নেমে ৬৯ রানেই নেই বাংলাদেশের ৬ উইকেট। ১০০ রানের মধ্যে অলআউট হওয়ার আরেকটি লজ্জা যখন বাংলাদেশকে চোখ রাঙাচ্ছে, আবারও চীনের প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে গেলেন মিরাজ। আরেক পাশে মাহমুদউল্লাহকে পেয়ে আরও ভরসা পেলেন। ফলে এরপর আর কোনো স্বীকৃত ব্যাটসম্যান না থাকা সত্ত্বেও প্রথম বল থেকেই আক্রমণাত্মক খেলা শুরু করলেন। ব্যাটিং বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্ত থেকে প্রথমে মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে সপ্তম উইকেটে ভারতের বিপক্ষে গড়েন রেকর্ড ১৪৮ রানের পার্টনারশিপ। এরপর নাসুমকে নিয়ে শেষ ৪ ওভারে সংগ্রহ করেন আরও ৫৪ রান। বাংলাদেশের সংগ্রহ দাঁড়ায় ২৭১ রান, ম্যাচ জেতার জন্য যা ছিল যথেষ্ট। বল হাতেও হতাশ করেননি মিরাজ, ভারতের দুই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাটসম্যান শ্রেয়াস আইয়ার আর লোকেশ রাহুলের উইকেট তুলে নিয়ে মিডল অর্ডারের কোমর ভেঙে দেন। ইনিংসের শুরুতে ইবাদত আর মুস্তাফিজের তাণ্ডবে হোঁচট খাওয়া ভারত তাই শেষ দিকে রোহিত–বীরত্বের পরও জিততে পারল না ম্যাচ। তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচেই জয় তুলে নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ঘরের মাটিতে ভারতের বিপক্ষে সিরিজ জিতে নিল টাইগাররা।
মিরাজ শুধু এই সিরিজেরই নয়, ইঙ্গিত দিচ্ছেন পুরো বাংলাদেশের ক্রিকেটেরই ভবিষ্যৎ ‘পোস্টার বয়’ হওয়ার। এই সিরিজে ইতিমধ্যে প্রমাণ করেছেন, ‘ফিনিশার’ হওয়ার যোগ্যতা তাঁর আছে। অপর দিকে টি-টোয়েন্টিতে ওপেন করেছেন এই বছর। অভিষেক ম্যাচেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৬ উইকেট নেওয়া কারও বোলিং–সামর্থ্য নিয়েও প্রশ্ন থাকার কথা নয়। সাকিব–পরবর্তী যুগে বাংলাদেশ দল আরেকটি বিশ্বমানের অলরাউন্ডার পাবে নাকি, সে চিন্তার হয়তো এখানেই সমাপ্তি। সঙ্গে ২০১৬ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে দেখিয়েছিলেন নিজের অধিনায়কত্বেরও সামর্থ্য। মোটকথা, সাকিব, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ, তামিম অবসরে যাওয়ার পর ভবিষ্যতে দলকে নেতৃত্ব দেবেন কে, সেই আলোচনাতেও আছেন তিনি। হয়তোবা এই সিরিজের মাধ্যমে ভালোভাবেই মিরাজ–যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশের ক্রিকেট।