এই বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে কত স্বপ্ন দেখেছিল বাংলাদেশের মানুষ। পাশের দেশ ভারতে বিশ্বকাপ বলে কন্ডিশন নিয়ে তেমন ভাবনা ছিল না। ভাবনা ছিল না দল নিয়েও। তৃতীয় স্থানে থেকে ওয়ানডে সুপার লিগ শেষ করা টাইগারদের নিয়ে আশার পারদটা ছিল বেশ উঁচু। এমনকি প্রস্তুতি ম্যাচেও বাংলাদেশের পারফরম্যান্স ছিল ঠিকঠাক। কিন্তু যে-ই না বিশ্বকাপের বল মাঠে গড়াল, ওমনিতেই পাল্টে গেল সব সমীকরণ। সেমিফাইনাল খেলার আশা নিয়ে দেশ ছাড়া বাংলাদেশ দেশে ফিরছে একরাশ হতাশা আর চ্যাম্পিয়নস ট্রফি খেলার যোগ্যতা নিয়ে।
অধিনায়ক সাকিব আল হাসান আগেই বলে দিয়েছেন, এই বিশ্বকাপই বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে বিশ্বকাপ। হ্যাঁ, কাগজে–কলমে হয়তো এর থেকেও বাজে বিশ্বকাপ রয়েছে বাংলাদেশের ঝুলিতে। কিন্তু যে সম্ভাবনা আর আশা নিয়ে বিশ্বকাপে পা রেখেছিল বাংলাদেশ, তার ছিটেফোঁটাও মেলেনি দলের পারফরম্যান্সে। ব্যর্থ বিশ্বকাপ মিশনের নৈপথ্যে কী? কেন এই হতাশাজনক পারফরম্যান্স?
তামিম ইকবাল বিতর্ক
বিশ্বকাপ মাঠে গড়ানোর আগেই বাংলাদেশের সঙ্গী হয়েছিল বিতর্ক। বিশ্বকাপের মাত্র তিন মাস আগে সিরিজের মাঝপথে অবসরের ঘোষণা দেন অধিনায়ক তামিম ইকবাল। চার বছর ধরে গোছানো দলটা যেন মুহূর্তেই ভেঙে পড়ে। অধিনায়কত্বের ইচ্ছা না থাকায় তড়িঘড়ি করে অধিনায়ক করা হয় সাকিব আল হাসানকে। যদিও প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে আবারও ক্রিকেটে ফিরে আসেন তামিম, কিন্তু বাধা হয়ে আসে ‘ফিটনেস’–বিতর্ক। ভিডিও বার্তায় ঘোষণা দিয়ে দল থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন তামিম। তামিমের ঘোষণা নিয়ে যখন সরগরম সারা দেশ, তখনই বোমা ফাটান সাকিব আল হাসান। একটি চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রীতিমতো তামিমের নিবেদন নিয়েই প্রশ্ন তোলেন তিনি। ফেসবুকে তামিমের ভিডিও আর টেলিভিশনে দেওয়া সাকিবের সাক্ষাৎকার মুহূর্তেই দুই ভাগে বিভক্ত করে ফেলে বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকদের। ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় মঞ্চে নামার আগে এমন বিতর্ক স্বভাবতই দলকে ঠেলে দিয়েছিল খাদের কিনারায়।
ব্যাটিং লাইনআপের অদল-বদল
তবু বিশ্বকাপে টাইগারদের সূচনা নিয়ে অভিযোগ ছিল না কারোরই। আফগানিস্তানের বিপক্ষে জয়, বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বড় পরাজয়ের পরও বোলিং নিয়ে অভিযোগ ছিল না খুব একটা। কিন্তু বাদ সাধল সেই ব্যাটিং অর্ডার। বিশ্বকাপের আগে ফর্মের তুঙ্গে থাকা ব্যাটিং অর্ডার যেন মুহূর্তেই ভুলে গেল কীভাবে ব্যাট চালাতে হয়। লিটন দাস, নাজমুল হাসান শান্ত, তাওহিদ হৃদয়রা যেন রাতারাতি ব্যাটিং ভুল গেলেন। যাঁদের ওপর ভরসা করে সিনিয়র ব্যাটারদের নিচে নামিয়ে দিয়েছিলেন কোচ, সেই তরুণ তারকারাই ব্যর্থ হলেন বিশ্বকাপের চাপ নিতে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন মেকশিফট ওপেনার মেহেদী হাসান মিরাজ। আফগানিস্তানের বিপক্ষে এক সেঞ্চুরি আশা জাগায় সমর্থক থেকে শুরু করে কোচদের। হুট করেই ব্যাটিং অর্ডারে ওপরে উঠিয়ে আনা হয় তাঁকে। ফলাফল শূন্য। সাজানো–গোছানো ব্যাটিং অর্ডার মুহূর্তেই ভেঙে পড়ে তাসের ঘরের মতো। কয়েক বছর ধরে একইভাবে খেলে যাওয়া ব্যাটিং লাইনআপ ২০০ পার করতেও যেন হিমশিম খায়। ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতে থাকে বিশ্বকাপজুড়েই। এক লিটন দাস আর তানজিদ তামিম ছাড়া ব্যাটিং অর্ডারে কারও জায়গাই নির্দিষ্ট ছিল না। শেষ দুই ম্যাচ ছাড়া ব্যাটিং–ব্যর্থতা ছিল তাই বাংলাদেশের সঙ্গী।
বোলারদের বাজে ফর্ম
হতাশায় নিমজ্জিত করার দিক থেকে বাংলাদেশের ব্যাটিং অর্ডারের পরই থাকবে পেস বোলিং লাইনআপ। এক বছর ধরে বাংলাদেশের বোলিংয়ের মূল স্তম্ভ ছিল তাসকিন-এবাদত-মোস্তাফিজ-শরীফুল। বোলিং কোচ অ্যালান ডোনাল্ডের হাত ধরে বাংলাদেশ এগোচ্ছিল নতুন এক উত্থানের দিকে। কিন্তু বড় মঞ্চে গিয়েই খেই হারানোর পুরোনো স্বভাবটা ফিরে এসেছে আবারও। বাংলাদেশি পেসারদের কাছ থেকে না পাওয়া গিয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে উইকেট, না লাগাম টেনে ধরতে পেরেছেন রানে। বোলিং লাইনআপের ব্যর্থতা ভুগিয়েছে বাংলাদেশকে। স্পিনাররাও পিচ থেকে সুবিধা নিতে পারেননি। এনে দিতে পারেননি ব্রেকথ্রু।
‘অধিনায়ক’ সাকিব বিতর্ক
অফ ফর্ম, ব্যর্থতা—খেলার মাঠে বেশ স্বাভাবিক বিষয়। না চাইলেও মেনে নিতে হয়। কিন্তু টুর্নামেন্টের মাঝপথে সাকিব আল হাসান যা করেছেন, তা হাজারো যুক্তি দিয়েও মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। বিশ্বকাপের মাঝপথেই দল রেখে দেশে ফিরে এসেছিলেন তিনি। লক্ষ্য ছিল নিজের ব্যাটিং–গুরুর সঙ্গে কথাবার্তা বলে নিজের ভুলগুলো শুধরে নেওয়া। বিশ্বকাপের ফ্লাইটে ওঠার আগেই কড়া ভাষায় সমালোচনা করে গিয়েছেন সতীর্থ তামিম ইকবালের। সিরিজের মাঝপথে কীভাবে একজন অধিনায়ক দল ছেড়ে চলে যেতে পারেন। যুদ্ধের মধ্যে সেনাপতির প্রস্থান হিসেবেও সেটিকে আখ্যা দিয়েছেন তিনি। সেই সাকিবই কি না বিশ্বকাপের মাঝে একই কাজ করে বসলেন, দল ছেড়ে চলে এলেন বাংলাদেশে। ছুটিতে নিজের মতো করে সময় কাটানোর সুযোগ ছিল দলের সামনে, কিন্তু তাই বলে দেশে ফিরে একটা হুলুস্থুল কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলবেন সাকিব—এমনটা আশা করেনি কেউই। টানা ব্যাটিং–ব্যর্থতার শিকার হওয়া সাকিব যদিও শেষ দুই ম্যাচে ফর্মে ফিরেছেন, কিন্তু তাঁর এমন আচরণ বিতর্কিত হয়েছে নানা মহলে। চোটের কারণে গুরুত্বপূর্ণ দুই ম্যাচ খেলতে না পারা, নেদারল্যান্ডসের কাছে হার, বিশ্বকাপ মিশন শেষ না করেই দল রেখে দেশে ফিরে আসা—সব মিলিয়ে ভুলে যাওয়ার মতো একটা বিশ্বকাপ অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের জন্য।
আশার আলো এক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ
এত ব্যর্থতার মাঝেও বাংলাদেশের একমাত্র আশার আলো ছিলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। বিশ্বকাপের আগে দলে তাঁর জায়গাটাই ছিল সবচেয়ে নড়বড়ে। তাওহিদ হৃদয়ের আগমন এবং লোয়ার অর্ডারে মুশফিকুর রহিমের কার্যকর কিছু ইনিংসে ব্রাত্য হয়ে পড়েছিল রিয়াদের জায়গাটা। সঙ্গে বয়স আর ফিটনেস মিলিয়ে বাংলাদেশ দলে তাঁর সময়টাকে শেষ বলেই ধরে নিয়েছিলেন অনেকে। কিন্তু রিয়াদের পরিবর্তে দলে সুযোগ পাওয়া কেউই নিজেদের প্রস্তুত করতে পারেননি। উল্টো এ সময় নিজেকে তিনি বদলে ফেলেছেন। পরিবর্তন এনেছেন ব্যাটিং স্টাইলে, ঝরিয়ে ফেলেছেন মেদ, নিজেকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছেন সেই ২০১৫ সালে। ফলাফল তো সবার চোখের সামনেই। যাঁকে বাদ দেওয়ার জন্য এত তোড়জোড় ছিল কোচদের, সেই মাহমুদউল্লাহ রিয়াদই বাংলাদেশের সেরা পারফরমার। এক সেঞ্চুরি ও এক হাফ সেঞ্চুরিতে তাঁর ঝুলিতে রান সংখ্যা ৩২৮! কে ভেবেছিল এই ৩৭ বছর বয়সী রিয়াদের ওপর ভর করেই বাংলাদেশকে টিকে থাকতে হবে বিশ্বকাপে?
বিশ্বকাপে ব্যর্থতার ষোলোকলা পূর্ণ করেছে বাংলাদেশ দল। পয়েন্টের ব্যবধানে এগিয়ে থাকলেও হারের ব্যবধানে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে বিশ্বকাপ এটি। সাত ম্যাচে মাথা নিচু করে মাঠ ছাড়তে হয়েছে টাইগারদের, এর মধ্যে একটি আবার নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে। এত কিছুর পরও খেলা শুরু হতেই টিভির সামনে বসে সবাই আশায় বুক বাঁধে, আগেরবার হয়নি তো কী হয়েছে? এবার হবে। এই বিশ্বকাপে হয়নি তো কী হয়েছে? চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে হবে।