‘ফিনিশার’ মাহমুদউল্লাহ কি ‘ফিনিশড’?
গুড লেংথ উচ্চতায় কোমরের কাছাকাছি বল। কিছুদিন আগেও এমন বল অনায়াসে সীমানাছাড়া করেছেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। সেটাই হয়তো চেয়েছিলেন শেষ বেলায়ও। কিন্তু বাদ সাধল বয়স। সজোরে মারা শটটা আটকে গেল রিয়ান পরাগের হাতে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সবচেয়ে ছোট ফরম্যাটে তাঁর ক্যারিয়ারটা শেষ হলো ৯ বলে ৮ রানের এক ইনিংস দিয়ে!
মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের বিদায় দিয়ে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে আনুষ্ঠানিকভাবে ইতি টানা হলো ‘পঞ্চপাণ্ডব’ গাথার। শুরু হয়েছিল মাশরাফি বিন মুর্তজাকে দিয়ে, শেষটা করলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। তবে মিল আছে বৈকি। বাকি চারজনের মতো রিয়াদের বিদায়টাও হলো অনাড়ম্বর। শেষ বেলায় পেলেন একটা ছোট বিদায়ী সংবর্ধনা আর প্রেস কনফারেন্স। দুয়ে মিলে ‘ফিনিশার’ মাহমুদউল্লাহর বিদায়টা হয়ে রইল সাদামাটা।
টি-টোয়েন্টিতে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের অভিষেক হয়েছিল ২০০৭ সালে। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি তখনো নতুন, ফরম্যাটের মতিগতি ধরার চেষ্টায় ব্যস্ত তখনো সবাই। বাংলাদেশের দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি ম্যাচে অভিষেক হয়েছিল রিয়াদের। বলার মতো পারফরম্যান্স ছিল না, তবে কেনিয়ার বিপক্ষে সেই ম্যাচে জয় নিশ্চিত করেছিল টাইগাররা। এর পর থেকে ক্রিকেটের ছোট ফরম্যাটে বাংলাদেশের সুখ-দুঃখের সঙ্গী মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। পরিসংখ্যানও তা–ই বলে।
বাংলাদেশের জার্সিতে সবচেয়ে বেশি টি-টোয়েন্টি খেলার রেকর্ড তাঁর। সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায় তিনি আছেন দ্বিতীয়তে, উইকেট শিকারির তালিকায়ও আছেন সেরা ১০-এ! ১৪১ ম্যাচে ২৪৪৪ রান আর ৪১ উইকেট—খালি চোখে সংখ্যাটা মন্দ নয়। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে পরিসংখ্যানের চোখ দিয়ে দেখলে সেরা দাবি করা অন্যায় হবে না। সর্বোচ্চ ৪৩ ম্যাচে অধিনায়কত্ব করেছেন, ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও ছিলেন অধিনায়ক। সাকিব আল হাসানের পর বাংলাদেশের সেরা অধিনায়কও তিনি। পরিসংখ্যানের খাতায়ও তাঁর মতো খেলোয়াড় পাওয়া মুশকিল।
মাহমুদউল্লাহর ক্যারিয়ার অবশ্য তাঁর পরিসংখ্যানের মতো ছিল না। ক্যারিয়ারের গ্রাফ ওঠানামা করেছে নিয়মিতই। টি-টোয়েন্টি অবশ্য পরিসংখ্যানের খেলা নয়। এখানে খেলা মাপা হয় ইমপ্যাক্ট দিয়ে, টার্নিং পয়েন্ট দিয়ে। পরিসংখ্যানের খাতায় তা বেশির ভাগ সময়ই ফেলা যায় না। টি-টোয়েন্টি নামটার মধ্যে যে জাঁকজমক, খেলোয়াড় রিয়াদের মধ্যে তা কখনোই ছিল না। বরাবরই ঠান্ডা মাথার খেলোয়াড় তিনি। টি-টোয়েন্টি খেলতে সবচেয়ে বেশি যেটা প্রয়োজন, রিয়াদের সেই স্ট্রাইক রেট আটকে আছে ১১৭-তে। যে কারণে এক দিনের ক্রিকেটে যতটা সাফল্য পেয়েছেন, টি-টোয়েন্টিতে ছিলেন অনেকটা আড়ালেই। ১৭ বছরের ক্যারিয়ারে তাঁর হাফ সেঞ্চুরি ৮টি। আর ইমপ্যাক্ট কিংবা ম্যাচ জেতানো পারফরম্যান্সে রিয়াদ বরাবরই পিছিয়ে। তবু মাহমুদউল্লাহকে নিয়ে বলতে গেলে ফিরে যেতে হয় সেই ২০১৮ সালে, কলম্বোর নিদহাস ট্রফিতে। শ্রীলঙ্কা-বাংলাদেশ দ্বৈরথের সূচনা যে ম্যাচ দিয়ে।
নিদহাস ট্রফির অঘোষিত সেমিফাইনালে জেতার কোনো আশাই ছিল না বাংলাদেশের। শ্রীলঙ্কার করা ১৫৯ রান পরিণত হয়েছিল পাহাড়সম এক টার্গেটে। রিয়াদের অমন ভয়ংকর রূপ আগে দেখেনি কেউ। শ্রীলঙ্কার দুর্ধর্ষ বোলিং লাইনআপকে একাই নাস্তানাবুদ করেছিলেন রিয়াদ। ৩ চার, ২ ছয়ে করেছিলেন ১৮ বলে ৪৩ রান। ছক্কা মেরে দলকে পৌঁছে দিয়েছিলেন জয়ের বন্দরে। ২৩৯ স্ট্রাইক রেটের রিয়াদ দেখিয়ে দিয়েছিলেন কীভাবে টি-টোয়েন্টি খেলতে হয়। ‘ফিনিশার’ ডাকনামটার যথার্থতাও পূরণ করেছিলেন সেদিন।
মাহমুদউল্লাহর এমন দানবীয় রূপের দেখা মিলত কালেভদ্রে, বেশির ভাগ সময় থাকতেন ধীরস্থির, শান্ত। নিজের চিরাচরিত খেলা দিয়েও ম্যাচ বের করেছেন। ২০২১ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজ জয়ের ম্যাচটার কথাই ধরা যাক। পুরো ম্যাচে সবাই যখন বল বুঝতেই হিমশিম খাচ্ছেন, তখন অধিনায়কের মতো দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে করেছিলেন ৫৩ বলে ৫২! পারফেক্ট ‘ওয়ানডে’ ইনিংস বটে। কিন্তু সেদিন মিরপুরের সেই পিচে এমন ধীরস্থির ইনিংস দলকে এনে দিয়েছিল জয়ের দেখা।
টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে মাহমুদউল্লাহ ছিলেন এমনই। টপ অর্ডারের ব্যর্থতায় সব সময়ই তাঁকে নিতে হয়েছে ইনিংস ক্যারি করার ভূমিকা। দ্রুত কয়েকটি উইকেট পড়ে যাওয়ার পর দলের স্কোরকে সম্মানজনক জায়গায় নিয়ে যাওয়ার কাজটা মাহমুদউল্লাহই করতেন। টপ অর্ডার ভূমিকা রাখলে হয়তো হাত খুলেই খেলতে পারতেন। ১৭ বছরের বিশাল ক্যারিয়ারে হাইলাইট করার মতো অল্প কিছু ইনিংসই আছে তাঁর। আরেকটি অবশ্য আছে, তবে সেটা স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাস। ২০১৬ সাল, বেঙ্গালুরুতে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ম্যাচে মুখোমুখি বাংলাদেশ ও ভারত। ৩ বলে দরকার মাত্র ২ রান! নিশ্চিত জেতা ম্যাচ উচ্চাভিলাষী শট খেলে হেরে এসেছিলেন মুশফিক-মাহমুদউল্লাহ জুটি। মুশফিকের আউট দেখেও সতর্ক হননি, উড়িয়ে মারতে গিয়ে জলাঞ্জলি দিয়ে এসেছেন বাংলাদেশের স্বপ্ন। স্বপ্নজয় আর স্বপ্নভঙ্গ—দুটি কোটাই পূর্ণ করেছেন তিনি।
তবু বাংলাদেশের জার্সিতে মাহমুদউল্লাহ ছিলেন অপরিহার্য। অন্তত বছর দুয়েক আগপর্যন্ত। একটা সময় বাদও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মাহমুদউল্লাহ ফিরেছেন নিজের যোগ্যতাবলেই। পরিশ্রম করে, ঘাম ঝরিয়ে, তরুণদের সঙ্গে টেক্কা দিয়েই দলে জায়গা করে নিয়েছিলেন। কিন্তু বয়সের বাধা কি আর আটকে রাখা যায়? মাহমুদউল্লাহ আটকে গেছেন আধুনিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের কাছে। বয়সের ভারে তাঁর গড় কমেছে, পাল্লা দিয়ে সেভাবে ব্যাটটাও চালাতে পারছিলেন না। টি-টোয়েন্টির এই যুগে ফিনিশার বলতে ঠিক যে বিস্ফোরক ব্যাটিং দরকার ছিল, সেটার ঘাটতি ছিল না তাঁর। তবে অভিজ্ঞতা দিয়ে যেভাবে দলকে টেনে নিতেন, সেটা হারিয়ে গেছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। বেড়েছে শুধু দর্শকদের আফসোস আর হতাশা। কাঁচাপাকা চুল-দাঁড়ির রিয়াদ সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেননি।
অবধারিত বিদায়টা তাই এলই। রিয়াদের জন্য নয়, বরং দর্শক–সমর্থকদের জন্য। এমন সাদামাটা বিদায় কি রিয়াদের প্রাপ্য ছিল? কারও কারও মতে, কিছুটা হয়তো ছিল। কারও মতে বিদায়টা হতে পারত আরও সুন্দর, আরও জাঁকজমকপূর্ণ! যদি আগেই ঘোষণা দিতেন বিদায়ের। বছর দুই আগে বিদায়টা হলে হয়তো সবাই সাদরেই গ্রহণ করতেন। ধুমধাম করে বিদায় দেওয়া হতো তাঁকে। ভিনদেশে সিরিজ খেলে বিদায় নিতে হতো না। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘অধিকার ছাড়িয়া দিয়া অধিকার ধরিয়া রাখার মত বিড়ম্বনা আর হয় না।’ মাহমুদউল্লাহ যেন সেই চক্রেই পড়ে গেলেন। বাংলাদেশ ক্রিকেটের মহারথীর বিদায় হলো অনাড়ম্বরেই।