মাত্র ৩৫ মিলিয়ন! বিশ্বকাপজয়ী খেলোয়াড়ের দাম মাত্র ৩৫ মিলিয়ন? পত্রপত্রিকায় গুঞ্জন ছিল, আর্জেন্টাইন মায়েস্ত্রোকে কিনতে কমপক্ষে ৫০ মিলিয়ন খরচ করতে হবে লিভারপুলকে। কিন্তু আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসামাত্র চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল সবার। বিশ্বকাপজয়ী মিডফিল্ডার ম্যাক অ্যালিস্টারকে মাত্র ৩৫ মিলিয়ন পাউন্ডে কিনেছে লিভারপুল। কম দামে ভালো খেলোয়াড়ের সবচেয়ে বড় উদাহরণ যেন অ্যালেক্সিস ম্যাক অ্যালিস্টার।
মাঝমাঠ নিয়ে অনেক দিন ধরেই ভুগছে লিভারপুল। অনেক দিন বলতে আক্ষরিক অর্থেই অনেক দিন। শেষ ২০১৭-১৮ মৌসুমে শেষবারের মতো অল রেডদের মাঝমাঠ কাঁপিয়েছেন কোনো ক্রিয়েটিভ মিডফিল্ডার। ফিলিপে কুতিনহোকে নিজেদের সন্তানের মতো ভালোবাসত লিভারপুলবাসী। তাঁর বিদায়ের পর থেকেই মাঝমাঠ থেকে নজর অনেকটাই সরিয়ে ফেলেন কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ। সামনে সালাহ-মানে-ফিরমিনোর মতো ক্রিয়েটিভ খেলোয়াড় থাকলে মাঝমাঠের ক্রিয়েটিভিটির প্রয়োজনীয়তা অনেকটাই কমে যায়। তাই মাঝমাঠে পরিশ্রমী খেলোয়াড়দের দিয়েই কাজ চালাতেন তিনি। যে কাজটা খুব ভালোভাবেই করতেন হেন্ডারসন, মিলনার, উইনালদামরা।
তবে এর মধ্যে যে মাঝমাঠের ‘প্রাণ’ কেনার চেষ্টা করেননি ক্লপ, ব্যাপারটা তেমন নয়। কিনেছেন, কিন্তু কেউই স্থায়ী হতে পারেননি। লিভারপুলে ভেরার পর তাঁর প্রিয় ট্রাম্পকার্ড অ্যাডাম লাল্লানা আর অ্যালেক্স অক্সলেইড-চেম্বারলিন—দুজনের ক্যারিয়ারই থমকে দিয়েছে চোট। অনেক আশা নিয়ে আরবি লাইপজিগ থেকে কিনে এনেছিলেন নাবি কেইটাকে। আশার বিন্দুমাত্র প্রতিদান দিতে পারেননি তিনি।
মাঝমাঠের দায়িত্ব কাঁধে তুলে দেওয়ার জন্য প্রতি মৌসুমেই কাউকে না কাউকে কিনেছেন ক্লপ। জার্দান শাকিরি থেকে শুরু করে থিয়াগো আলকান্তারা কিংবা আর্থার; কেউই কোচের আস্থার বিন্দুমাত্র প্রতিদান দিতে পারেননি। চোট, নইলে বাজে ফর্মের কারণে জায়গা হারিয়েছেন। ঘুরেফিরে শেষ পর্যন্ত ৩৭ বছর বয়সী জেমস মিলনার আর ৩৩ বছর বয়সী জর্ডান হেন্ডারসনের ওপরেই মাঝমাঠের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছেন ক্লপ।
এ মৌসুমে এসে যেন কূলহারা নাবিক হয়ে গেছেন ইয়ুর্গেন ক্লপ। গত মৌসুমে দল ছেড়েছেন সাদিও মানে। মানে ছিলেন ক্লপের সোনার ডিমপাড়া হাঁস। মাঝমাঠ থেকে আক্রমণ, যখন যেখানে দরকার সেখানেই পদচিহ্ন ছিল মানের। মানের বিদায় প্রভাব ফেলেছে লিভারপুলের আক্রমণে। মাঝমাঠ থেকে যে পরিমাণ বল আসার কথা, তার অর্ধেকও আসেনি এই মৌসুমে। রবার্তো ফিরমিনোও ঘোষণা দিয়েছেন দল ছাড়ার। সেই সঙ্গে এত দিন মাঝমাঠের অতন্দ্র প্রহরী হয়ে থাকা জেমস মিলনার, অ্যালেক্স অক্সলেইড-চেম্বারলিন আর নাবি কেইটাও বিদায় বলেছেন অল রেডদের। ক্লপের বাজারের তালিকায় তাই সবার ওপরে ছিল নতুন মিডফিল্ডারের নাম।
ক্লপের পছন্দের তালিকায় প্রথম নাম ছিল বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের তারকা জ্যুড বেলিংহাম। ইংলিশ তারকার সঙ্গে কথাবার্তাও অনেক দূর এগিয়েছিল ক্লপের। তাঁর বাসায় গিয়ে নিজে কথা বলেছেন, প্রস্তাব দিয়েছেন লিভারপুলে যোগ দেওয়ার। কিন্তু ক্লপের প্রস্তাব নয়, বেলিংহামের মন পড়ে ছিল শৈশবের প্রিয় দল আর খেলোয়াড়ের প্রতি। সঙ্গে তাঁর বিশাল ট্রান্সফার ফি পরিশোধেও অপারগ ছিল লিভারপুলের মালিকপক্ষ। সব মিলিয়ে জ্যুড ধরলেন মাদ্রিদের প্লেন আর ক্লপ নজর দিলেন তাঁর দ্বিতীয় পছন্দের দিকে। ব্রাইটনের বিশ্বজয়ী তারকা অ্যালেক্সিস ম্যাক এলিস্টারের দিকে।
কাগজে–কলমে সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার হলেও ম্যাক এলিস্টার যেন এক জাদুর বাক্স, একের ভেতর তিন! আক্রমণভাগে বল তৈরি করে দেওয়ায় তিনি যেমন নস্যি, তেমনি প্রতিপক্ষে পা থেকে বল কেড়ে নিতেও দস্যি। পাসিং, বল ক্যারি, বল ইন্টারসেপশন—সবকিছুতেই ম্যাক অ্যালিস্টার প্রিমিয়ার লিগের সেরাদের একজন। লিভারপুল মিডফিল্ডের ‘ওয়ান স্টপ সলিউশন’ যেন এক ম্যাক অ্যালিস্টারই।
ফুটবল ও ম্যাক অ্যালিস্টারের যেন জন্মজন্মান্তরের। বাবা কার্লোস ম্যাক অ্যালিস্টার ছিলেন ফুটবলার। বলার মতো তেমন বড় কোনো ক্যারিয়ার ছিল না। অর্জন বলতে ক্যারিয়ারের শেষবেলায় ডিয়েগো ম্যারাডোনা ছিলেন তাঁর সতীর্থ। খুব কম বয়সেই ক্যারিয়ার শেষ হয়েছিল কার্লোসের। কার্লোসের অপূর্ণ স্বপ্ন পূরণ করেছেন কার্লোসের ছেলেরা। তিন সন্তানের তিনজনই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন ফুটবল। এর মধ্যে একমাত্র অ্যালেক্সিসই খোলস ছেড়ে বেরোতে পেরেছেন। বড় দুই ভাইয়ের ক্যারিয়ার এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে আর্জেন্টিনাতেই।
আর্জেন্টিনো জুনিয়র্সের খেলোয়াড় থাকাকালেই ম্যাক অ্যালিস্টারকে চোখে পড়ে ইংলিশ স্কাউটদের। নামমাত্র মূল্যে তাঁকে দলে ভেড়ায় প্রিমিয়ার লিগের দল ব্রাইটন অ্যান্ড হোভ অ্যালবিয়ন। তৎক্ষণাৎ দলে না ভিড়িয়ে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয় ব্রাইটন। দুই মৌসুমের জন্য আর্জেন্টিনায়ই খেলতে থাকেন ম্যাক অ্যালিস্টার। কিন্তু দেড় মৌসুমের মাথাতেই চুক্তি ভেঙে তাঁকে ডেকে পাঠায় ব্রাইটন। ব্রাইটন মিডফিল্ডারদের চোট কপাল খুলে দেয় ম্যাক অ্যালিস্টারের। আর্জেন্টিনা থেকে এসেই গ্রাহাম পটারের একাদশে ঢুকে যান তিনি। বাকি ছিল শুধু নিজেকে প্রমাণ করার। মৌসুম যত গড়াতে থাকে, ততই নিজেকে প্রমাণ করতে থাকেন এই মিডফিল্ডার। একটা সময়ে মাঝমাঠ থেকে পুরো ব্রাইটন দলকে সামলানো শুরু করেন ম্যাক অ্যালিস্টার।
আর্জেন্টাইন কোচ লিওনেল স্কালোনির চোখে পড়তে খুব একটা বেশি সময় লাগেনি। মাত্র ৯ মাসের মাথায় আর্জেন্টিনার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে পড়লেন তিনি। আর্জেন্টিনার মাঝমাঠে তাঁর জন্য আলাদা একটা জায়গাই তৈরি করে ফেললেন স্কালোনি। রদ্রিগো ডি পল, এনজো ফার্নান্দেসের সঙ্গে মাঝমাঠের তৃতীয় নাম হিসেবে যুক্ত হলেন অ্যালেক্সিস ম্যাক অ্যালিস্টার। বিশ্বকাপের মাত্র ৯ মাস আগে দলে জায়গা করে নিয়েও বিশ্বকাপে পৌঁছালেন দলের অপরিহার্য অংশ হিসেবে। আর তার প্রমাণ মিলল প্রথম ম্যাচ থেকেই।
সৌদি আরবের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে তাঁকে ছাড়াই একাদশ সাজিয়েছিলেন স্কালোনি। ফলাফল? ম্যাচের মাঝপথে মিডফিল্ড ব্যাটেল হারিয়ে পরাজয়। এরপর থেকে প্রতিটি ম্যাচেই ম্যাক অ্যালিস্টার ছিলেন শুরুর একাদশে। আর ফলাফল তো চোখের সামনেই। ৩৬ বছর পর বিশ্বকাপ শিরোপা আর্জেন্টিনার হাতে।
ভালো খেলার প্রতিদান পেয়েছেন মৌসুম শেষ হতে না হতেই। চড়া দামে অল রেড শিবিরে ভিড়তে যাচ্ছেন এই আর্জেন্টাইন। প্রশ্ন করতে পারো, তাঁরই দুই সতীর্থ এনজো ফার্নান্দেস আর রদ্রিগো ডি পল চড়া মূল্যে বিক্রি হলেও অ্যালেক্সিসের দামটা এত কম কেন? এর কারণ তাঁর সঙ্গে ব্রাইটনের চুক্তি। ব্রাইটনের সঙ্গে ম্যাকের চুক্তি ছিল চার বছরের, যা শেষ হতে চলেছে আগামী বছর। এ মৌসুমে যদি তাঁকে বিক্রি না করা হয়, তবে পরের মৌসুমে ফ্রিতে ছাড়তে হবে তাঁকে। যে কারণে অনেকটা পানির দামেই বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে ব্রাইটন। সেই সঙ্গে ক্লপের সঙ্গে খেলার বহুদিনের ইচ্ছে ম্যাক অ্যালিস্টারের। নামমাত্র মূল্যে তাঁকে কেনার অন্যতম বড় কারণও এটি।
ফিলিপে কুতিনহো, সাদিও মানের পর লিভারপুলের ১০ নম্বর জার্সি গায়ে চড়াতে যাচ্ছেন ম্যাক এলিস্টার। এর আগে যাঁরাই ‘১০’ গায়ে চড়িয়েছেন, নিজের সন্তানের মতোই তাঁদেরই আপন করে নিয়েছেন অল রেডরা। চোট আর ফর্মহীনতার চক্করে না পড়লে সেই ভালোবাসা পেতে খুব একটা বেগ পেতে হবে না ম্যাক অ্যালিস্টারকে।