তহুরারা জয় করতে পারেন যেকোনো কিছুই
‘পকেট সাইজ ডিনামাইট’ বলে ইংরেজিতে একটা বিশেষণ খুব আলোচিত। একটু ছোটখাট গড়নের কেউ যখন ধুন্ধুমার কিছু ঘটিয়ে ফেলেন, তখন বিশেষণটি ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশের মেয়েদের ফুটবল দলে ‘পকেট সাইজ ডিনামাইট’ অবশ্যই তহুরা খাতুন। তাঁকে আগে থেকে দেখলে প্রতিপক্ষের কোচ খুব ভয়ংকর কিছু ভাবতে পারেন বলে মনে হয় না, কিন্তু খেলার মাঠে সেই তহুরাকে দেখে টনক নড়ে প্রতিপক্ষের। তখন যা সর্বনাশ হবার হয়ে গেছে। এবারের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতীয় নারী দলের কোচ সন্তোষ কাশ্যপের ঠিক সেই অবস্থাই হয়েছিল। বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচে তাঁর দলকে প্রথমার্ধেই ‘শেষ’ করে দিলেন ছোটখাট গড়নের তহুরা। তিনি নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন, বাংলাদেশ দলের সাবিনা খাতুন, সানজিদা আক্তার, ঋতুপর্না চাকমা, মারিয়া মান্দাদের নিয়ে এত বিশ্লেষণ এত পরিকল্পনা করে শেষে কিনা আসল কাজটা করে বসলেন তহুরা! কিন্তু সন্তোষ কাশ্যপ বুঝতে পারেননি, বাংলাদেশের পকেটে রাখা ডিনামাইট তো এই তহুরাই। অনূর্ধ্ব–১৪ থেকে বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দলে খেলে জাতীয় দল—তহুরার আন্তর্জাতিক গোলের সংখ্যাই যে ৫৫। বাংলাদেশের কোনো পুরুষ ফুটবলারেও এত গোলের রেকর্ড নেই। এই তহুরাকে নিয়ে আলাদা করে না ভাবলে হয়!
ভুটানের অস্ট্রেলীয় কোচ নিকোলা ডিমাইন অবশ্য একটু বাড়তি সুবিধা পেয়েছেন। সেমিফাইনালের আগে ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের ম্যাচটি দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে তহুরাকে চোখে পড়েছে তাঁর। এই তহুরা যে বক্স টু বক্স পরিস্থিতিতে দুর্দান্ত খেলোয়াড়; ডি বক্সের যেকোনো জায়গা থেকেই যে তহুরা গোল করতে পারেন, ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে তো সেটি স্পষ্টই। ডিমাইন তাই তহুরাকে নিয়ে পরিকল্পনা সাজাতে পেরেছিলেন। কিন্তু কোথায় সেই পরিকল্পনা, কোথায় কি! হ্যাটট্রিক করেই সেমিফাইনালে ভুটানকে উড়িয়ে দিয়েছেন তহুরা। সাফে ফাইনালের আগেই বাংলাদেশের ১১ গোলের ৫ গোলই তহুরার। কলসিন্দুরের মেয়ে তহুরা তাই ৩০ অক্টোবর নেপালের বিপক্ষে ফাইনালের আগে বাংলাদেশের সবচেয়ে ধারাল অস্ত্র।
বাংলাদেশের হ্যাটট্রিক–গার্লও বলা যেতে পারে তাঁকে। বয়সভিত্তিক ও জাতীয় দল মিলিয়ে ৬টি হ্যাটট্রিক আছে তহুরার। বংসভিত্তিক ফুটবলে হ্যাটট্রিক করেছেন তাজিকিস্তান, ইরান, হংকং ও ভারতের বিপক্ষে। ভারতের বিপক্ষে সেই ম্যাচে করেছিলেন ৪ গোল। ভুটানের বিপক্ষে তাই হ্যাটট্রিকের পর বাড়তি কোনো উচ্ছ্বাস দেখা যায়নি তাঁর মধ্যে। এ যেন খুব সহজ আর সাধারণ ব্যাপার। আসলে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের খেলোয়াড়দের সবকিছুকে সহজ আর স্বাভাবিক বানিয়ে ফেলার যে প্রবণতা, সেটিই তাদের খেলার সৌন্দর্য। এত দারুণ দারুণ সব কীর্তি—কিন্তু তারা আশ্চর্য রকমের শান্ত। যেন কিছুই হয়নি। নিজেদের শেকড়েই তাদের বিচরণ। যেমন বিচরণ তহুরার। এখনো ভুলতে পারেন না ছোটবেলার সেই বন্ধু সাবিনা ইয়াসমীনকে ।ময়মনসিংহের কলসিন্দুরের ধোবাউড়া গ্রামে একসঙ্গে বেড়ে উঠেছিলেন সাবিনার সঙ্গে। হরিহর আত্মা যাকে বলে তা–ই। গ্রামে পাশাপাশি বাড়িতে থাকা, এক সঙ্গে খেলাধুলা থেকে শুরু করে ফুটবলটাও দুজন একসঙ্গেই শুরু করেছিলেন। কিন্তু সেই বন্ধু সাবিনাই অকালে কয়েকদিনের জ্বরে ভুগে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। অনূর্ধ্ব–১৪ দলের ক্যাম্প থেকে দুজন একসঙ্গেই গিয়েছিলেন বাড়ি। সাবিনা গ্রামে গিয়েই জ্বরে পড়েন। তাঁর আর ফেরা হয়নি। তহুরা এই ৭ বছরে এক দিনের জন্যও ভুলতে পারেননি বন্ধুর কথা। বন্ধুর শোকে ফুটবল খেলাটাই ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিছুই ভালো লাগত না তাঁর। শেষ পর্যন্ত খেলাটা চালিয়ে গেছেন। এবারের সাফে ভারতের বিপক্ষে জোড়া গোল করে বন্ধুকে স্মরণ করেছিলেন মাঠেই।
সাবিনার শোকে খেলা ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন, আবার সেই বন্ধু সাবিনাই তাঁর প্রেরণা। সাবিনার মা তাঁর মায়ের মতোই। তহুরার খেলা ছেড়ে দেওয়ার কথা শুনে অনেক বুঝিয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, তুই আমার মেয়ের কথা মনে করেই খেলে যা। তুই ফুটবল খেললে, আমি ভাবব, আমার মেয়ের স্বপ্নই পূরণ হচ্ছে। তহুরাও এভাবেই দেখেন নিজের ফুটবল ক্যারিয়ারকে, ‘ও আমার ছোটবেলার ভালো বন্ধু। বঙ্গমাতা, আন্তস্কুল পর্যায়ে একসঙ্গে খেলেছি আমরা। ও মারা যাওয়ার পর অনেক সময় একা থাকতাম, ফুটবল ছেড়ে দেব ভাবতাম। কিন্তু ছাড়িনি। ওর মা আমাকে বলেছিল, সাবিনার জন্যই খেলে যেতে। ওর কথা মনে হলে ভাবি আমি খেলে যাব।’
কলসিন্দুরের বেড়ে ওঠার সময় ঢাকা শহরকেই অনেক দূরের ব্যাপার মনে হতো। ঢাকা শহরে আসাটাই যাঁর কাছে অনেক বড় ব্যাপার ছিল, সেই তহুরাই গত এক দশকে দেশ থেকে দেশান্তরে ফুটবল খেলছেন বাংলাদেশের জার্সি গায়ে। জীবনে ঢাকা শহরে এসে দেখেছিলেন লিফট। পাঁচ তারকা হোটেল কাকে বলে, কখনোই জানতেন না। শুধু মাত্র নিজের সামর্থ্যকে সবার সামনে তুলে ধরে নিজেকে এমন জায়গায় নিয়ে গেছেন,যা নিয়ে কখনোই ভাবেননি। পারিবারিক বাঁধাও কম ছিল না। জন্মগতভাবেই কিছুটা দুর্বল শারীরিক কাঠামোর অধিকারী ছিলেন। একটা মানুষ এত কিছু জয় করে নিজের লক্ষ্য অর্জন করতে পারে, তহুরাদের না দেখলে কারোরই বিশ্বাস হওয়ার কথা নয়।
এই বিশ্বাস এখন ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশেই, তহুরাদের দিয়ে জয় করা সম্ভব সব কিছুই। টানা দ্বিতীয়বারের মতো দক্ষিণ এশীয় শ্রেষ্ঠত্ব তো খুবই সাধারণ এক চাওয়া।