বার্নাব্যুর ৯০ মিনিটেও রিয়াল কেন ব্যর্থ
'বার্নাব্যুর ৯০ মিনিট অনেক বড়। ধন্যবাদ লম্বা সময় ধরে আমাদের সমর্থন দেওয়ার জন্য'। ম্যাচ শেষে বার্নাব্যুর অ্যাওয়ে সমর্থকদের জন্য আর্সেনালের শুভেচ্ছা বার্তা ছিল অনেকটা এমনই। প্রতিপক্ষ রিয়ালকে একই বাক্যে যেন খোঁচা আর সমর্থন, দুটোই দেওয়া হয়েছে এতে।
হবে না কেন! ম্যাচের আগের থেকে কতশত কথা। ১৮ বছরের নিচে কেউ প্রবেশ করতে পারবে না, ৪০ বছরের ওপরে কেউ প্রবেশ করবে না। সমর্থকগোষ্ঠী বা আল্ট্রাসদের শোরগোল থাকবে পুরো রাস্তাজুড়ে। ৬ ঘণ্টা আগে বন্ধ করে দেওয়া হবে স্টেডিয়ামের ছাদ। একের পর এক চিৎকারে আত্মারাম বের হওয়ার দশা হবে মিকেল আর্তেতার দলের। হুট করে শুনে হাস্যকর লাগতে পারে। প্রতিপক্ষের মাঠই তো, বাঘের ডেরা তো আর না। এমন দুর্দশা কি বলে কয়ে আনা যায় নাকি?
রিয়ালের ঘরটা বলা যায় বাঘের ডেরার মতোই ভয়ানক কিছু। ওপরে লেখা প্রতিটি ঘটনা ঘটেছে। কখনও প্রতিপক্ষ অ্যাটলেটিকো, কখনও বায়ার্ন, সিটি, চেলসি কিংবা পিএসজি। পুরো গল্পের সাক্ষী এর আগে হয়েছে কেউ না কেউ। সবটাই পুরোনো স্ক্রিপ্ট। সকলের চেনা। এর আগে বহুবার দেখেছে বিশ্ব। এবার শুধু বদলেছে একটা নাম, আর্সেনাল। আর সেই আর্সেনালে এসে ভাঙা পড়ল রিয়ালের দুর্গ।
এমন নয় যে, রিয়ালের দুর্গ আগে ভাঙা পড়েনি। তবে চ্যাম্পিয়নস লিগে রিয়াল মাদ্রিদের ভয়ানক ফর্ম আর রেকর্ডের সামনে তটস্থ থাকতে হতো সকলকে। সে চেলসি হোক কিংবা সিটি, রিয়ালকে হারাতে তুমুল বেগ পেতে হয়েছে তাদের। কিন্তু কি ছিল মিকেল আর্তেতার জাদুর কাঠিতে? যে তার কাছে আসতেই সব হারিয়ে ফেলল রিয়াল?
রিয়াল খেই হারিয়ে ফেলেছিল আগের দেখাতেই। এক ডেকলান রাইসের কাছে নাস্তানাবুদ হতে হয়েছে রিয়ালকে। এক ম্যাচে দুই ফ্রি-কিক থেকে গোল হজম করা চাট্টিখানি কথা নয়। সেটাও আবার রিয়ালের মতো দলের বিপক্ষ। ইংল্যান্ডের সবচেয়ে দামি খেলোয়াড় সেটাই করে দেখিয়েছিলেন। প্রথম ম্যাচে ৩-০ গোলে হারার পর ফিরে আসার গল্প লেখা শুধু কঠিন ছিল না ছিল রীতিমতো অসম্ভব। শুধু রিয়াল বলেই হয়তো স্বপ্ন দেখেছিল অনেকে।
ম্যাচের আগে তাই খেলোয়াড় থেকে শুরু করে সমর্থক, এমনকি বাইরের লোকজনের মুখেও ছিল কানাকানি, এই না রিয়াল ফিরে আসে। ৩-০ গোলে পিছিয়ে থেকেও প্রতিপক্ষে এমন হাবভাব চমকে দিয়েছিল খোদ আর্সেনালকেও। কিন্তু গত ৬ বছরে আর্তেতা ধীরে ধীরে গড়েছেন নিজেকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছেন, নিজেকে শানিত করেছেন। আর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় সময়ে এসে জীবন পরীক্ষায় দাঁড় করালো খোদ চ্যাম্পিয়নস লিগের রাজা কার্লো আনচেলত্তির সামনে।
ম্যাচের শুরু থেকে লাইমলাইটে ছিল রিয়ালই, সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সাকার পেনাল্টি মিস। সবমিলিয়ে রিয়ালের সামনে আর্সেনাল চাপেই ছিল। কিন্তু রিয়াল যেন ঠিক খোলস ছেড়ে বেরুতে পারছিল না। প্রথমার্ধে একটি শটও পোস্টে না রাখতে পারা যেন তারই প্রমাণ। দ্বিতীয়ার্ধেও নেই ছিটেফোঁটা উন্নতি। সাকার গোলের পর একটা সুযোগ পেয়েছিল রিয়াল, ভিনিসিয়ুস জুনিয়র ডিফেন্ডারের ভুল কাজে লাগিয়েছেন গোলটা পেতে। দুই ম্যাচে, ১৮০ মিনিটের মহারণে উদ্যাপনের সুযোগ ছিল শুধু ভিনির গোলে। শেষ মিনিটে গ্যাব্রিয়েল মার্তিনেলির গোল রিয়ালকে যেন চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিল, প্রতিদিন বলে-কয়ে 'কামব্যাক' হয় না। কিছুদিন ব্যথা সয়ে নিতে হয়।
আর্তেতাও তাতে সুর মেলালেন, 'এতদিন শুধু শুনেছি, এই মাঠে ঢুকলে কী যেন হয়। আজ উপলব্ধি করেছি। এই মাঠে ঢুকলে আসলেই কিছু একটা হয়। এগিয়ে থাকার পরও সব সমীকরণ বদলে যায় মুহূর্তে। সান্তিয়াগো বার্নাব্যু বরাবরই অসামান্য।' আলচেলত্তির অভিজ্ঞতা, চ্যাম্পিয়নস লিগের নার্ভ আর বার্নাব্যুর পরিবেশ, তবুও কেন ৫-১ গোলের হার। কেন প্রয়োজনের দিনে এমবাপ্পের ছায়া হয়ে থাকা? ডিফেন্সের এমন বেহাল দশা? সবকিছুর পেছনে ঘুরে ফিরে যেন চোখ যায় একজনের দিকে। স্বয়ং কোচ কার্লো আনচেলত্তি।
বয়সটা তাঁকে গ্রাস করতে শুরু করেছে। আগের মতো ট্যাক্টিকাল জিনিয়াস তাকে বলা সাজে না। নইলে ম্যাচের পর ম্যাচ এমবাপ্পে-ভিনিসিয়ুস-রদ্রিগো-বেলিংহাম জুটি এভাবে মুখ থুবড়ে পরবে? বিশ্বের সেরা সেরা খেলোয়াড়েরা আটকে যাবে আর্সেনালের কাছে? আনচেলত্তি কি শেষ বয়সে পৌঁছে গিয়েছেন? গত বছরও হোসেলুর মতো খেলোয়াড়ের কাছ থেকে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স বের করে এনেছেন তিনি। ২ মিনিটে দুই গোল দিয়ে বায়ার্নকে ছিটকে দিয়েছেন টুর্নামেন্ট থেকে। সেই আনচেলত্তি পারছেন না এমবাপ্পকে নিয়ে?
এখানে অবশ্য আনচেলত্তির একার দোষ দিয়েও লাভ নেই। দোষটা পড়ে রিয়ালের হেভিওয়েট তারকাদের ওপরও। একটা সময় ছিল যখন বলে কয়ে এমন ম্যাচ বের করে আনতেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। রোনালদোর বিদায়ের পর সেই জায়গা পূরণ করেছিলেন বেনজেমা। গত মৌসুমে সে দায়িত্ব তুলে নিয়েছিলেন ভিনিসিয়ুস। কিন্তু এমবাপ্পে আসতেই যেন সব গোলমেলে হয়ে গেল। সুন্দর সাজানো দলটা হারিয়ে গেল কি শুধু তার ছোঁয়ায়? এই প্রশ্নের উত্তর নেই কারোর কাছে। কেউ খোঁজার চেষ্টাও করছে না বটে। সকলে ব্যস্ত আর্সেনাল আর আর্তেতার সঙ্গে। ১৫ বছর পর আবারও চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে গানার্সরা।
আজ থেকে ঠিক দুই দশক আগে এভাবে বার্নাব্যুকে স্তব্ধ করে দিয়েছিলেন থিয়েরি অঁরি। ঠোঁটে আঙুল দিয়ে সেটা যেন মনে করিয়ে দিলেন বুকায়ো সাকা। তবে মাঝমাঠের ত্রাস হয়ে রিয়ালকে সত্যিকারের স্তব্ধ করেছেন ডেকলান রাইস। পরপর দুই লেগে ম্যান অফ দ্য ম্যাচের ট্রফি, সঙ্গে সেমিফাইনালের টিকিট। ডেকলান রাইসের জন্য সপ্তাহটা যেন স্বপ্নের চেয়েও বড়। অন্যদিকে খেলোয়াড়, সমর্থক থেকে শুরু করে সোশাল মিডিয়ার কোটি পোস্টকে মিথ্যে করে দিয়ে রিয়াল যেন প্রমাণ করল, হয়তো কোন কোনো সময়, রিয়াল যত গর্জে, তত হয়তো বর্ষে না।