ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ: ম্যাচউইক ২৪ প্রিভিউ
গুরু-শিষ্য মুখোমুখি, লিভারপুলের দুই ম্যাচ
প্রিমিয়ার লিগের বাকি ম্যাচউইকের তুলনায় এই সপ্তাহটা বেশ লম্বা হতে চলেছে। ঝড়ের কারণে বাতিল হওয়া লিভারপুল-এভারটনের ম্যাচ আলাদা করে যুক্ত হয়েছে এই সপ্তাহে। যে কারণে এই সপ্তাহে দুটো ম্যাচ খেলবে মার্সিসাইডের দুই দল লিভারপুল ও এভারটন। লম্বা ম্যাচউইকের আগে কেমন দলগুলোর অবস্থা জেনে নেওয়া যাক এক নজরে।
নটিংহাম ফরেস্ট বনাম ব্রাইটন
হঠাৎ করেই যেন ছন্দপতন। ছন্দপতন শব্দটাও যেন কম হয়ে যায়। উড়তে উড়তে যেন মাটিতে টেনে নিয়ে আসা। নটিংহাম ফরেস্টের অবস্থাটা হয়েছে অনেকটা সেরকমই। টানা আট ম্যাচ জেতার পর প্রিমিয়ার লিগের জন্য একটা লড়াই করার সুবাতাস পাচ্ছিলেন নুনো এসপারিতো সান্তোর শিষ্যরা। সে উড়ন্ত ফর্মে বাধা হয়ে এল বোর্নমাউথ। ৫-০ গোলের হার তাদেরকে অনেকটাই ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছে। কিন্তু প্রিমিয়া লিগ বলে কথা, এই হারের ধাক্কা সামলাতে না সামলাতে আবারও মাঠে নামতে হচ্ছে তাদের। হোঁচট সামলে উঠতে পারলে ব্রাইটনের বিপক্ষে জেতাটা খুব একটা কঠিন হবে না। তাদের সর্বশেষ দেখায় পয়েন্ট ভাগাভাগি করেছিল দুই দল। তখন অবশ্য দুই দলই ছিল ফর্মের তুঙ্গে। এবার সে ফলাফলে পরিবর্তন আসে কী না দেখার বিষয়।
বোর্নমাউথ বনাম লিভারপুল
উড়তে থাকা দলকে টেনে নামিয়ে আনতে যেন আলদা করে ট্রেনিং নিয়েছে বোর্নমাউথ। সিটি, আর্সেনাল থেকে শুরু করে নটিংহাম ফরেস্ট। দূর্দান্ত ফর্মে থাকা আন্দোনি ইরাওলার শিষ্যদের কাছে কেউই অপরাজেয় নয়। অন্যদিকে উড়তে থাকা লিভারপুলকে মাটিতে নামিয়ে এনেছেন পিএসভি। চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ ম্যাচে হারতে হয়েছে তাদের। যদিও মূল দলের বেশিরভাগ খেলোয়াড়কে বিশ্রাম দিয়েছিলেন আর্নে স্লট, তবুও হার তো হারই। আর প্রতিপক্ষ যখন বোর্নমাউথ, তখন তো একটু নড়েচড়ে বসতেই হয়। তবে আশার কথা, নিয়মিত ডিফেন্ডার জো গোমেজ ফিরছেন চোট থেকে। তবে জোতা ও নুনেজকে পেতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে কোচ আর্নে স্লটকে। গত দেখায় ৩-০ গোলে জেতা লিভারপুল চাইবে একই ফলাফল ফিরিয়ে আনতে। নিজেদের লিড ধরে রাখতে চাইলে জয়টা বড্ড প্রয়োজন তাদের।
এভারটন বনাম লেস্টার সিটি
আয়নায় তাকালে এভারটন আর লেস্টার নিজেদের জমজ বলেও ভাবতে পারে। মৌসুমজুড়ে দুটি দল যেন একই সমান্তরালে চলছে। বাজে শুরু, পত্রপাঠে কোচ বিদায়, এরপর আবার নতুন কোচের আগমন। গত সপ্তাহে জয় দিয়ে দুই নীল দল বেরিয়ে এসেছে অবনমনের সারি থেকে। দুজনের কেউই সেই জায়গায় ফিরে যেতে চাইবেন না। অবনমনের সারি থেকে সামান্য ওপরে থাকা দুই দলের লড়াইটা উপভোগ্য হতে চলেছে, বলাই বাহুল্য। তবে চিন্তার ভাঁজ আছে এভারটন কোচ ডেভিড ময়েসের কপালে। গত সপ্তাহে চোট নিয়ে মাঠ ছেড়েছেন ডমিনিক কালভার্ট-লেউইন ও ওরেল মানগালা। দীর্ঘ সময়ের জন্য তাদের পাবেন না তিনি, ফলাফলে বেতো ছাড়া আর কোনো স্ট্রাইকার নেই তার হাতে। অন্যদিকে চোটমুক্তি মিলছে লেস্টারের। উইলফ্রেদ এনদিদি ট্রেনিংয়ে ফিরলেও একাদশে ফিরছেন না। তবে গোলবারের নিচে অবশেষে ফিরছেন ম্যাডস হারম্যানসন। তাকে ছাড়া গোলবার একপ্রকার ফাঁকাই ছিল তাদের। ফিরে মানিয়ে নিতে সময় নেন কীনা, সে নিয়েও দুশ্চিন্তা আছে। ফলে অবনমন থেকে বেঁচে থাকতে চাইলে দুই দলকে লড়াই করতে হবে হাড্ডাহাড্ডি।
ইপসউইচ টাউন বনাম সাউদাম্পটন
মৌসুমের দ্বিতীয়ার্ধে এসে সবচেয়ে উপভোগ্য ম্যাচের তালিকায় উপরের দিকে থাকে ‘দ্য ব্যাটল অব রেলিগেশন’। অবনমনের সারিতে লড়তে থাকা দুই দলের লড়াই সবসময়ই উপভোগ্য। তবে এই মৌসুমে সাউদাম্পটনের অবস্থা বাকিদের তুলনায় বেশ শোচনীয়। নতুন কোচ এনেও ভাগ্য খোলেনি তাদের। সে তুলনায় সদ্য চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে উঠে আসা ইপসউইচ বেশ ভালো করেছে। অবনমনের সারি থেকে উঠতে চাইলে দুই দলেরই জয়ের কোনো বিকল্প খোলা নেই। এই মৌসুমের তাদের আরেকটি ম্যাচ শেষ হয়েছিল ১-১ গোলে।
নিউক্যাসল ইউনাইটেড বনাম ফুলহাম
গত ডিসেম্বর থেকে যেন সপ্তম আসমানে চড়ে ছিল নিউক্যাসল। টানা ৯ জয়ের পর তাদের মাটিতে নামিয়ে এনেছে বোর্নমাউথ। সেই জয় তাদের সামান্য ধাক্কা দিয়েছে বটে কিন্তু সাউদাম্পটনকে হারিয়ে আবারও পুরোনো ফর্মে ফিরেছে ম্যাগপাইরা। বিশেষ করে অ্যালেজেন্দার ইসাককে থামানো যেন অসম্ভব! গোল ব্যবধানে পঞ্চম অবস্থানে থাকা নিউক্যাসলের লক্ষ্য চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলা। আর সেটা খেলতে চাইলে জয়ের কোনো বিকল্প খোলা নেই তাদের সামনে। অন্যদিকে ফুলহামের সামনেও খোলা আছে ইউরোপের দরজা। জয়ের বিকল্প খোলা নেই তাদের সামনেও। নিউক্যাসল কোচ অবশ্য আছেন দোটানায়। নিয়মিত গোলরক্ষক নিক পোপ ফিরেছেন চোট থেকে। গোলবারের নিচে তিনি ফিরবেন নাকি মার্তিন দুব্রাভকার ওপরে ভরসা রাখবেন, সেটা দেখার বিষয়। অন্যদিকে ফুলহাম কোচ মার্কো সিলভা ভরসা রাখবেন এমিল স্মিথ-রো আর রাউল হিমিনেজের উপর। শেষ দেখায় ঘরের মাটিতে তারাই এনে দিয়েছে ৩-১ গোলের জয়।
উলভস বনাম অ্যাস্টন ভিলা
উলভস যেন পেন্ডুলামের ওপর দুলছে। এই সপ্তাহে অবনমনের বাইরে তো পরের সপ্তাহে আবার অবনমনের সারিতে। এই সপ্তাহ তাদের শুরু হচ্ছে অবনমনের সারিতে থেকে। অন্যদিকে চ্যাম্পিয়নস লিগের পরবর্তী পর্বে সরাসরি যোগ দিচ্ছে অ্যাস্টন ভিলা। বোঝাই যাচ্ছে, হাসিখুশি মেজাজে থাকছে কারা। গতবারের দেখায় উলভসদের ৩-১ গোলে হারিয়েছিল উনাই এমেরির শিষ্যরা। এবারও মনে হচ্ছে ফলাফলটা সেদিকেই যাবে। উলভসের কপালে চোটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হোয়াও গোমেসের লাল কার্ড। সবমিলিয়ে তথৈবচ অবস্থায় আছেন কোচ ভিতর পেরেইরা। অন্যদিকে ভিলার ডিফেন্ডাররাও আছেন চোটে। এমনকি তাদের মূল তারকা জন ডুরান ধরেছেন সৌদির প্লেন। সবমিলিয়ে তাদেরকে খুজতে হবে নতুন পরিকল্পনা।
ব্রেন্টফোর্ড বনাম টটেনহাম হটস্পার্স
আর কতদিন এই অচলাবস্থা চললে কোচের পদ থেকে বরখাস্ত হবেন আগ্নে পোস্তকোগলু? এই প্রশ্ন যেন প্রতিটি স্পার্স সমর্থকের মনে। এর থেকেও অনেক কমে কোচ বরখাস্তের রেকর্ড আছে স্পার্স চেয়ারম্যান ডেনিয়েল লেভির। অথচ অজি কোচ আছেন বহাল তবিয়তে। ১ মাস পেরিয়ে গেলেও নতুন বছরে কোনো জয়ের দেখা পায়নি তাঁর দল। অন্যদিকে আস্তে আস্তে গুছিয়ে উঠছে ব্রেন্টফোর্ড। ঘরে মাটিতে এখনও দূর্দান্ত তারা। টমাস ফ্র্যাংকের অধীনে তারা চমক দেখিয়েছে এই মৌসুমে। গত দেখায় টটেনহাম জিতলেও এবার সেটা বলা সম্ভব হচ্ছে না।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড বনাম ক্রিস্টাল প্যালেস
ঘরের মাটিতে খুব একটা সুবিধা করতে পারছে না ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। বরং বড় জয়গুলো আসছে ঘরের বাইরে থেকে। গত সপ্তাহের ফুলহামের বিপক্ষে জয়টাও এসেছে প্রতিপক্ষের মাঠ থেকে। নিজেদের দর্শকদের সামনে এখনও যেন মানিয়ে নিতে পারেননি কোচ রুবেন আমোরিম। ক্রিস্টাল প্যালেসের বিপক্ষে তাই একটা চাপ থাকবেই তাঁর ওপরে। গত মৌসুমে আট নম্বর অবস্থানে থেকে শেষ করেছিল ইউনাইটেড। প্রিমিয়ার লিগ ইতিহাসে সেটাই ছিল তাদের সবচেয়ে বাজে পারফরম্যান্স। দ্রুত দলের উন্নতি করতে না পারলে সে রেকর্ড ভেঙে যেতে পারে এই মৌসুমে। প্রথম মৌসুমেই নিজের নামের পাশে এই বদনাম যোগ করতে নিশ্চয় চাইবেন না আমোরিম। সে তুলনায় ক্রিস্টাল প্যালেস বেশ ভালো অবস্হানে আছে। অবনমনের সারি থেকে যেমন দূরে তেমনই ভালো ফর্মেও। গত ম্যাচে হার বাদ দিলে ৬ ম্যাচ অপরাজিত ছিল দলটি। গত দেখায় পাওয়া গোলশূণ্য ড্র আবারও পেলে খুব একটা অখুশি হবে না তারা।
আর্সেনাল বনাম ম্যানচেস্টার সিটি
গত কয়েক মৌসুম ধরে প্রিমিয়ার লিগের সবচেয়ে হেভিওয়েট ম্যাচের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে আর্সেনাল বনাম ম্যান সিটি। হবে না-ই বা কেন, এ তো একেবারে গুরুদক্ষিণা। যে পেপ গার্দিওলার অধীনে থেকে দুই বছর দীক্ষা পেয়েছেন মিকেল আর্তেতা, সেই আর্তেতা যখন কোচ হয়ে গার্দিওলার বিপক্ষে নামেন, সে দৃশ্যটা বরাবরই দেখার মতো। প্রতিবার লড়াইয়ে সিটি ফেভারিট থাকলেই এবার সিটি শুরু করছে আন্ডারডগ হিসেবে। টানা বাজে ফর্মের খেসারত হিসেবে তাদের অবস্থান চতুর্থ। তবে আর্সেনালকে ধরতে চাইলে দুইটি জয়ই যথেষ্ট। তাদের শেষ দেখায় কষ্টার্জিত এক ড্র নিয়ে মাঠ ছেড়েছিলেন গার্দিওলা। শেষ মুহুর্তের গোলে শিষ্যের কাছ থেকে জয় ছিনিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। এবার সেটা চাইবেন না আর্তেতা। যদিও গোলবারের নিচে ডেভিড রায়াকে নিয়ে কিছুটা শঙ্কা আছে গানার্সদের। চোটের কারণে বড় সময় ধরে দলে নেই বেন হোয়াইট, গাব্রিয়েল জেসুস ও বুকায়ো সাকা। সিটির লাইন-আপেও নেই জেরেমি ডকু। সবমিলিয়ে সপ্তাহের সবচেয়ে জমজমাট ম্যাচের দেখা মিলবে এমিরেটস স্টেডিয়ামে।
চেলসি বনাম ওয়েস্ট হ্যাম ইউনাইটেড
লন্ডনের পূর্ব আর পশ্চিম প্রান্তের দুই দল মুখোমুখি, ফলাফল লন্ডনজুড়ে আবারও উত্তেজনা। রাস্তায় বেরুনো দায়। চেলসি আর ওয়েস্ট হাম দুই দলের অবস্থাই অবশ্য শোচনীয়। শুরুটা ভালো করেও পথভ্রষ্ট হয়েছে চেলসি। এনজো মারেসকার শিষ্যরা এখন ইউরোপের লড়াই থেকেও বাদ পরার পথে। অন্যদিকে বাজে পারফরম্যান্সের দরুণ কোচ হুলেন লোপেতেগিকে বরখাস্ত করেছে ওয়েস্ট হাম। গ্রাহাম পটারের অধীনে নতুন করে দল সাজাচ্ছে তারা। টানা হার আর বাজে ফলাফল নিয়ে দুই দলই নিজেদের খুঁজে ফিরছে। ফলে লন্ডন ডার্বি শুধু সম্মানের লড়াই নয়, নিজেদের অবস্থান বুঝে নেওয়ার লড়াইও বটে। এই ম্যাচে হারলে ইউরোপের স্বপ্ন অনেকটাই ছেতে ফেলতে হবে চেলসিকে। অন্যদিকে স্বপ্ন জিইয়ে রাখতে জয়ের বিকল্প খোলা নেই ওয়েস্ট হামের সামনে।
এভারটন বনাম লিভারপুল
‘মার্সিসাইড ডার্বি’, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের অন্যতম পুরোনো এবং শান্তশিষ্ট ডার্বি হিসেবে পরিচিত রাইভালরি। শুনে হাস্যকর ঠেকতে পারে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা কীভাবে শান্ত হয়? লিভারপুল আর এভারটনের সম্পর্কটা এরকমই। গুডিনসন পার্কে তাদের ম্যাচ হওয়ার কথা ছিল ডিসেম্বরের ২ তারিখ, প্রিমিয়ার লিগের ১৫তম সপ্তাহে হওয়ার কথা ছিল ম্যাচটি। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় ‘দারাঘ’ হানা দেওয়ায় স্থগিত করা হয় ম্যাচটি। ফলে ৯ সপ্তাহ পর এসে মাঠে গড়াচ্ছে প্রিমিয়ার লিগের অন্যতম জনপ্রিয় ডার্বি। ইতোমধ্যে অবশ্য দুই দলই অনেকটা পালটে গিয়েছে। এভারটনের নতুন কোচ ডেভিড ময়েস দলকে সাজাচ্ছেন নতুন করে। অন্যদিকে প্রিমিয়ার লিগের শীর্ষে উঠে নিজেদের শাণিয়ে নিয়েছে লিভারপুল। সবমিলিয়ে দুই দলের মর্যাদার লড়াইয়ের সঙ্গে লড়াইটা নিজেদের অবস্থানকে আরও পাকাপোক্ত করার। এক ম্যাচের অ্যাডভান্টেজে থাকা কোন দল নিজেদের পূর্ণ সুবিধা নিতে পারে, সেটাই দেখার বিষয়।