কিছু কিছু খেলোয়াড় একসময় একটি ক্লাবের প্রতিশব্দ হয়ে ওঠেন। ক্লাবের নাম উচ্চারণ করলেই মনের অজান্তেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে তাঁদের নাম। রোমা বললে ফ্র্যান্সেস্কো টট্টি, লিভারপুল বললে স্টিভেন জেরার্ড, চেলসির প্রসঙ্গে ফ্র্যাঙ্ক ল্যাম্পার্ড। তেমনিভাবে ইংলিশ ক্লাব টটেনহামের প্রসঙ্গ এলেই সবার আগে মনে পড়ে হ্যারি কেইনের নাম। ২০ বছরের সম্পর্ক ভেঙে সেই হ্যারি কেইনই ছাড়ছেন টটেনহাম, গন্তব্য বায়ার্ন মিউনিখ।
কেইনের সঙ্গে টটেনহামের সম্পর্ক জন্ম-জন্মান্তরের। মাত্র ১১ বছর বয়সে টটেনহামে পা দিয়েছিলেন তিনি। ১৯ বছর পেরিয়ে গিয়েছে, স্পার্স আর কেইনের সম্পর্ক ভাঙতে পারেনি কেউই। মাঝে তাঁকে ঝালিয়ে নেওয়ার জন্য তিন মৌসুম ধারে ছিলেন অন্য দলে, তাতে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র চিড় ধরেনি। বরং আরও ইস্পাতকঠিন হয়েছে। কেইন লাইমলাইটে আসেন ২০১৪-১৫ মৌসুমে, টটেনহামে যোগ দেওয়ার ১০ বছর পর। তরুণ কোচ মাউরিসিও পচেত্তিনো নিজের দলের জন্য চাচ্ছিলেন তরুণ কাউকে। পচেত্তিনোর হাত ধরেই বড় মঞ্চে নিজেকে প্রমাণের সুযোগ পান কেইন। যার প্রতিদান দিতে বিন্দুমাত্র ভুল করেননি, প্রথম মৌসুমেই ৩১ গোল। বাকি গল্পটা কেইনের ইংল্যান্ড জয়ের।
মৌসুমের পর মৌসুম গড়িয়েছে আর কেইন ছাড়িয়ে গিয়েছেন নিজেকেই। রেকর্ডের পর রেকর্ড ভেঙেছেন, স্পার্স সমর্থকদের আস্থার প্রতীক হয়েছেন। ‘১০’ নম্বর জার্সি, অধিনায়কের আর্মব্যান্ড—সবই অর্জন করে নিয়েছেন নিজ যোগ্যতায়। তাঁর নামের পাশে শোভা পায় হাজারো বিশেষণ। অথচ এত কিছুর পরও কেইন আটকে আছেন একটা জায়গাতেই—শিরোপা! ৩১ বছরের জীবনে একটিবারও শিরোপা ছুয়ে দেখা হয়নি তাঁর।
শিরোপার বড্ড কাছাকাছি গিয়েছেন বেশ কয়েকবার। ২০১৬-১৭ মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগ জয়ের অনেক কাছাকাছি পৌঁছেছিলেন বটে, কিন্তু ছুঁয়ে দেখা হয়নি। হার মানতে হয়েছিল পরাক্রমশালী চেলসির কাছে। ২০১৮-১৯ মৌসুমে পৌঁছেছিলেন চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে। সেখানেও আটকে গিয়েছেন লিভারপুলের কাছে। পচেত্তিনোর অধীনে নিজের ক্যারিয়ারের চূড়ায় উঠেছেন বটে, কিন্তু দলকে একটা শিরোপা উপহার দিতে পারেননি। জোসে মরিনহোর অধীনেও অনেক চেষ্টা করেছিলেন বটে, কিন্তু ফাইনালের আগের দিন কোচকে বরখাস্ত করে সব হযবরল করে দেন ক্লাব চেয়ারপারসন ড্যানিয়েল লেভি। ম্যানচেস্টার সিটির কাছে হেরে এই শিরোপাও জলাঞ্জলি দিতে হয় তাঁকে।
একটা সময় সাধারণ জ্ঞানের বইয়ে পড়েছি, চীনের দুঃখ যেমন বলা হয় হোয়াং হো নদীকে; এতটা উত্তাল সে নদী যে তার প্রকোপে চীনের বিশাল একটা অংশ ডুবে যেত যেকোনো সময়। অথচ সেই নদীর ওপর ভর করেই একটা সময় বেঁচে ছিল চীনের অর্থনীতি। কেইনের সঙ্গে টটেনহামের সম্পর্ক অনেকটা সে রকমই। টটেনহ্যামের সেরা সময়টা এসেছে হ্যারি কেইনের হাত ধরেই। কিন্তু ক্যারিয়ারের সেরা সময়ে শিরোপা–খরা মেটাতে পারেনি তারা। উল্টো অনেকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁকে আটকে রেখেছেন টটেনহ্যাম চেয়ারপারসন ড্যানিয়েল লেভি।
ড্যানিয়েল লেভিকে বলা হয় ট্রান্সফার মার্কেটের সবচেয়ে জেদি লোক। ২০০১ সাল থেকে টটেনহামের চেয়ারে আছেন তিনি। আর সেদিন থেকে এখন পর্যন্ত টটেনহাম থেকে খেলোয়াড় কিনতে চাওয়ার অর্থ হলো যুদ্ধে নামা। আর সে যুদ্ধের মন্ত্র একটাই, ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী’। খেলোয়াড় বিক্রিতে তাঁর দাবিদাওয়াই শেষ কথা। ‘ট্রান্সফার মার্কেটের ডন’খ্যাত ফ্লোরেন্তিনো পেরেজকে পর্যন্ত খাবি খাইয়ে ছেড়েছেন তিনি। তাঁর কাছ থেকে হ্যারি কেইনকে কেনা কখনো সহজ কর্ম ছিল না।
তাই তো গত চার বছরে যখনই হ্যারি কেইনকে কেনার চেষ্টা করেছে কোনো দল, অদ্ভুতুড়ে একটা দাম লেপ্টে দিয়েছে তাঁর গায়ে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, ম্যানচেস্টার সিটি থেকে শুরু করে রিয়াল মাদ্রিদ, দলের অভাব ছিল না কেইনের জন্য। কিন্তু সবাইকেই মানা করে দিয়েছেন তিনি। কিন্তু এই মৌসুমে চাইলেও না করতে পারছেন না লেভি। পরের মৌসুমেই ফ্রি এজেন্ট হয়ে যাচ্ছেন কেইন। ছয় মাস পর চাইলেই তাঁকে ফ্রিতে কিনতে পারবে যেকোনো দল। কেইনও থাকতে খুব একটা ইচ্ছুক নন। সোনার ডিম পারা হাঁসকে বিক্রি করার এই শেষ সুযোগ।
দলবদলের বাজারে ভালো স্ট্রাইকার পাওয়াই মুশকিল। সেখানে কেইনের মতো খেলোয়াড়কে বিক্রি করতে রাজি টটেনহাম, শুনে অনেকেই আগ্রহী হয়েছিল। কিন্তু আটকে গেল সেই লেভির কাছেই। ১০০ মিলিয়নের এক পয়সা কমে রাজি হবেন না তিনি। আর প্রিমিয়ার লিগের দল হলে ১৫০ মিলিয়ন। লেভির এক কথা, এক কাজ। শুরুতেই কেটে পড়ল ইউনাইটেড আর চেলসি। রিয়াল মাদ্রিদ কিছুটা চেষ্টা-চরিত্র করেছিল বটে, দামটা ৬০-৭০ এর আশপাশে নামাতে চেয়েছিল স্প্যানিশ জায়ান্ট। লাভ হয়নি। বেঁচে থাকল শুধু একটি দল, বায়ার্ন মিউনিখ।
গত মৌসুমটা যাচ্ছেতাই গিয়েছে বায়ার্নের জন্য। রবার্ট লেফানডফস্কির অভাবটা পূরণ করতে পারেননি কেউই। সাদিও মানেকে অনেক আশা নিয়ে কিনেছিল তারা, কিন্তু প্রত্যাশার বিন্দুমাত্র পূরণ করতে পারেননি। লিগ হাতছাড়া হতে হতে হয়নি তাদের। এই মৌসুমে তাই বায়ার্নের প্রথম লক্ষ্য ছিল বড় কোনো নামকে দলে ভেড়ানো। আর হ্যারি কেইনের থেকে বড় নাম কে-ই বা আছে বর্তমানে?
কম দামে কেইনকে কিনতে চেয়েছিল বায়ার্নও। শুরু করেছিল ৮০ মিলিয়ন দিয়ে, লেভির এক কথা, ১০০ মিলিয়নের নিচে এক পয়সাও নয়। পরপর তিনবার বায়ার্নকে ফিরিয়েছে টটেনহাম, কিন্তু পিছু ছাড়েনি বাভারিয়ানরা। শেষমেশ লেভির কাছেই মাথা নত করতে হলো বায়ার্নকে। ১০০ মিলিয়ন ইউরোর বদলেই বায়ার্নে যোগ দিতে যাচ্ছেন হ্যারি কেইন।
হ্যারি কেইনের জন্য লড়াইটা বেশ ভিন্ন। পুরো জীবনটাই কাটিয়েছেন টটেনহামের ছায়াতলে। সেখান থেকে ভিন্ন একটা দেশে, ভিন্ন একটা পরিবেশে যাচ্ছেন। সেখানে চ্যালেঞ্জ শুধু মানিয়ে নেওয়াই নয়, ১০০ মিলিয়ন ইউরোর ভারও যুক্ত হয়েছে তার সঙ্গে। এমনিতেই ইংল্যান্ডের বাইরে ইংলিশদের ইতিহাস খুব একটা সুবিধার নয়। কেইন সেই গ্লানি দূর করতে পারেন কি না, সেদিকেই এখন নজর সবার।