কুকুরেলার হোঁচটে কেন ধাক্কা খেল পুমা

ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের গেম উইক ১৫-তে অদ্ভুত এক ঘটনার সাক্ষী হয়েছিলেন সমর্থকেরা। ম্যাচের প্রথম ১২ মিনিটে দুবার হোঁচট খেয়েছিলেন স্প্যানিশ ডিফেন্ডার মার্ক কুকুরেলা। এরপর মাঠেই বদলাতে দেখা গেছে বুট। অতঃপর সেই ঘটনা গড়িয়েছে বহুদূর…

এমনটা আগে কখনো দেখা গিয়েছে কিনা বলা মুশকিল। একদিকে গোল উদ্‌যাপনে সয়লাব টটেনহাম। অন্যদিকে নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছে চেলসি সমর্থকেরা। ম্যাচের তখন মাত্র ১২ মিনিট চলছে। এর মধ্যেই শহুরে প্রতিদ্বন্দ্বীরা মেতে উঠেছে দুই গোলের আনন্দে। তখনো মাঠে লুটোপুটি খাচ্ছেন মার্ক কুকুরেলা।

প্রথম গোলের সময় ‘স্লিপ’ করেছেন কুকুরেলা।
ছবি: এক্স

গোল হজম করতে গিয়ে ডিফেন্ডারকে নাস্তানাবুদ করা নতুন কিছু নয়। খোদ রোনালদো নাজারিও তো ঘোল খাওয়াতেন স্বয়ং গোলরক্ষকদের। ডিফেন্ডাররা তো সেখানে নস্যি। কিন্তু একই ডিফেন্ডার যখন মিনিট পাঁচেকের ব্যবধানে দুই–দুইবার মাঠে পা ফসকে পরে যান, তখন কিছু তো খটকা লাগেই। শুধু পা ফসকালেও হতো, সেই দুবারের পা ফসকানো থেকে হজম করতে হয়েছে দুই গোল। ডিফেন্ডারের জন্য সময়টা বেশ লজ্জারই। একজন বুদ্ধিমান খেলোয়াড়ের যেটা করা উচিত, কুকুরেলা সেটাই করলেন। ড্রেসিং রুমে সংকেত দিলেন বুট বদলানোর। ড্রেসিংরুম থেকে এল আরেক জোড়া বুট। নতুন বুট খুলে পুরনো বুট নিয়ে ফিরে গেলেন মাঠে।

ম্যাচের মাঝেই বদলাচ্ছেন বুট।
ছবি: এক্স

পুরনো বুটে যেন ফিরে গেলেন সেই পুরোনো ফর্মে। ৫ মিনিটের মাথায় বুটজোড়া থেকে এল অ্যাসিস্ট। ১৬ মিনিটের মাথায় মাঠের বাম প্রান্ত থেকে বল বাড়িয়ে দিলেন জেডন সানচোর উদ্দেশ্যে। ডি বক্সের বাইরে থেকে দুর্দান্ত এক গোল করে চমকে দিলেন সানচো। ১২ মিনিটে ২ গোল হজম করা চেলসি ম্যাচে ফিরল সানচোর গোল দিয়ে। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি ব্লুজদের। কোল পালমারের ২ পেনাল্টি আর এনজো ফার্নান্দেজের অসাধারণ গোলে ম্যাচটা নিজের করে নেয় চেলসি। ভাগ্যিস ফলাফলটা পক্ষে এসেছিল, নইলে স্লিপের দুঃসহ স্মৃতি তাড়া করে বেড়াতে হতো আজীবন। কিন্তু কুকুরেলার জীবনেও ভাবেননি মাঠের থেকে বেশি মাথা ঘামাতে হবে মাঠের বাইরের ঘটনায়।

আরও পড়ুন

ম্যাচ শেষে ফুরফুরে মেজাজে ড্রেসিংরুমে ফিরেছেন কুকুরেলা। হাসতে হাসতে বুটজুড়ো ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে ছবি তুলেছেন, এরপর ইন্সটাগ্রামে স্টোরি দিয়ে ক্যাপশন দিয়েছেন; ‘স্যরি ব্লুজ’। ঘটনাটা জমে ক্ষীর হয়েছে ঠিক এখান থেকেই। যা মাঠের ভেতরের থেকেও বহুগুণ বেশি রসালো। ঘটনাটা বুঝতে ফিরে আবারও ফিরে যেতে হবে বুটের ইতিহাসে।

ইন্সটাগ্রাম স্টোরিতে ক্ষমাপ্রার্থী কুকুরেলা।
ছবি: এক্স

প্রতিটি খেলোয়াড়ের নিজস্ব কিছু স্পন্সর থাকে। পায়ের বুট থেকে শুরু করে পরনের স্যুট, সবকিছুতে আভিজাত্যের ছাপ দিতে কোনো কার্পণ্য করেন না খেলোয়াড়েরা। আর সেই আভিজাত্যে নাম লেখাতে মোটা অংকের অর্থ খরচ করেন স্পোর্টসওয়্যার কোম্পানিগুলো। তাদের নতুন মডেলের স্যুট থেকে বুট শোভা পায় খেলোয়াড়দের পায়ে। এটা শুধু আজকের নয়, প্রায় এক শতাব্দীর কাছাকাছি সময় ধরে চলে আসছে এই নিয়ম। ১৯৭০ বিশ্বকাপের ফাইনালে পুমা পেলেকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়েছিল শুধু ম্যাচ শুরুর আগে ম্যাচ থামিয়ে জুতা বাঁধার জন্য। নিজের নাম প্রচার করার জন্য ওইটুকু স্ক্রিনটাইমই প্রয়োজন ছিল তাদের।

স্পন্সর হওয়ার সুবিধা যেমন আছে, অসুবিধাও আছে বৈকি। খেলোয়াড়ের ভালো সময়ের পাশাপাশি খারাপ সময়ের অংশীদারও হতে হয় তাঁদের। কুকুরেলার ক্ষেত্রে অবশ্য মূদ্রার উল্টোপিঠ দেখতে হয়েছে পুমাকে।

টটেনহামের বিপক্ষে কুকুরেলা মাঠে নেমেছিলেন পুমার নতুন বুট ‘ফিউচার ৮’ পরে। নতুন সোল প্লেট ডিজাইন আর স্টাড প্যাটার্নের কারণে বেশ অনেক দিন ধরেই আলোচনায় ছিল ‘ফিউচার ৮’। বড়দিনকে সামনে রেখে পুমার নতুন জেনারেশনের বুট পৌঁছে গিয়েছিল খেলোয়াড়দের কাছে। সেই সারির প্রথম দিকের তারকা ছিলেন স্প্যানিশ ডিফেন্ডার মার্ক কুকুরেলা। ট্রেনিংয়ে স্বাচ্ছন্দ্য পেয়ে অবশেষে পা গলিয়েছেন মূল ম্যাচে। আর সেখানেই বাঁধল বিপত্তি। ম্যাচ পারফরম্যান্স এতটাই বাজে যে ১২ মিনিটের মাথায় ছুড়ে ফেললেন সেই বুট। অতঃপর তার জায়গা হলো ডাস্টবিনে।

আরও পড়ুন

এমন ঘটনা শুধু কুকুরেলা নয়, ধাক্কা দিয়েছিল পুমার হেডকোয়াটারেও। সদ্য ইউরো জেতা ডিফেন্ডার, প্রিমিয়ার লিগের অন্যতম বড় নাম যখন প্রকাশ্যে নতুন বুট ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলেন, চিন্তার বলিরেখা কপালে ঠাঁই পাওয়া তো তখন বড্ড স্বাভাবিক। স্পন্সর থেকে ফোন এল, আধঘণ্টার মধ্যে কুকুরেলা মুছে দিলেন সেই স্টোরি। ততক্ষণে অবশ্য পুমার নতুন বুটের রিভিউ বোঝা হয়ে গিয়েছে সকলের। নতুন বছরে নতুন জেনারেশনের বুটের অভিজ্ঞতা যে খুব একটা সুখকর হবে না, সেটা খুব ভালোভাবে বুঝে গিয়েছিলেন ফুটবলপ্রেমীরা। কিন্তু তাই বলে হাত–পা গুটিয়ে বসে থাকা তো চলবে না। শুরু হলো পিআর ম্যানেজমেন্ট। কীভাবে হাওয়া বদল করে নিজেদের দিকে আনা যায়?

পুমার নতুন ক্যাম্পেইনে।
ছবি: এক্স

দুই দিন পরে ইন্সটাগ্রামে পুমা ফুটবলের পেইজ থেকে এল এক ভিডিও। ফুটবল মাঠ মুছতে মুছতে এগুচ্ছেন কুকুরেলা, পাশে ‘ওয়েট ফ্লোর’ সাইন। সঙ্গে ‘সাবধান! ওয়েট ফ্লোর’ সাইনের সঙ্গে কুকুরেলার এক ছবি। সেই ছবির ক্যাপশনে লেখা ‘It’s not how you slip, it’s how you bounce back.’ হোঁচট খাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ না, বরং কীভাবে ফিরে এসেছ সেটা গুরুত্বপূর্ণ। কুকুরেলা শুধু বার্তা দিয়ে ক্ষান্ত হননি, প্রমাণ করেছেন মাঠেও। বুট বদলে সেদিনই জানান দিয়েছিলেন, সামান্য বুট তার ফর্মে প্রভাব ফেলতে পারবে না। সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতে তার আরও বড় প্রমাণ পেল প্রিমিয়ার লিগ।

মার্ক ‘পেনগুইন’ কুকুরেলা।
ছবি: এক্স

পরের সপ্তাহে দেখা মিলল আরেক কুকুরেলার। ডিফেন্স থেকে শুরু করে আক্রমণ, সব জায়গাতে একচ্ছত্র আধিপত্য তাঁর। অসাধারণ এক হেডে ব্রেন্টফোর্ডের বিপক্ষে দলকে এনে দিয়েছিলেন লিড। এই মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগে নিজের প্রথম গোল উদ্‌যাপন করেছেন পেঙ্গুইনের মতো করে লাফিয়ে। এ যেন চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া, শত প্রতিকূলতার মধ্যেও পেঙ্গুইন যেমন বেঁচে থাকে লাফিয়ে লাফিয়ে। ফেরত আসে নিজের মতো করে নিজের ঘরে। তিনিও এসেছেন। ভবিষ্যতেও আসবেন।

আরও পড়ুন