বাংলাদেশ না পারলেও আফগানিস্তান কেন পারে

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এমন উল্লাসে অনেকবারই মেতেছেন আফগানিস্তান–ক্রিকেটাররা।এএফপি

২ বলে প্রয়োজন ১০ রান। দেয়ালে ততক্ষণে পিঠ ঠেকে গেছে আদিল রশিদের। উচ্চাভিলাষী শট ছাড়া আর কোনো উপায় খোলা নেই তাঁর কাছে। আজমাতউল্লাহ ওমারজাইয়ের বলটা তাই হাঁকালেন সজোরে। উড়ে গিয়ে সেই বল জমা পড়ল ইব্রাহিম জাদরানের হাতে। চ্যাম্পিয়নস ট্রফির প্রথম জয় আফগানরা নিশ্চিত করল ইংল্যান্ডকে হারিয়ে। পুরো বিশ্ব একনাগাড়ে লিখতে শুরু করল, এ যেন রূপকথা লেখা হলো পাকিস্তানের মাটিতে। না, আফগানদের জয় কোনো রূপকথা নয়। বরং বছরের পর বছর ধরে কঠোর নিষ্ঠা আর পরিশ্রমের ফল।

আফগানিস্তান বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের চিত্র। মার্কিন আগ্রাসনের শিকার হয়ে এশিয়ার প্রভাবশালী দেশটি পরিণত হয়েছিল ধ্বংসস্তূপে। বহু বছর পেরিয়ে গেছে তারপর। আফগান ক্রিকেট এখন আর ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে নেই। বরং আফগান ক্রিকেট দাঁড়িয়ে আছে একটি কাঠামোর ওপর, যেখান থেকে নিয়মিত বেরিয়ে আসছেন তারকা। আর তারকারা বয়ে নিয়ে আসছেন সাফল্য। চোখের সামনে ডানা ঝাপটাতে থাকা আফগান ক্রিকেট আজ ডানা মেলে চলে গেছে বহুদূর।

অথচ তাদের ক্রিকেটের বয়স সর্বসাকল্যে দুই দশক। ২০০৮ সালে যখন আইসিসির পঞ্চম বিভাগে হাতেখড়ি হয় আফগানদের, তখন সুবিধা বলতে ছিল একটি ক্রিকেট একাডেমি। সেখানকার চারটি পিচে নিজেদের প্রস্তুত করতেন আফগানরা। সত্যিকারের ধ্বংসস্তূপ বলতে যা বোঝায়, আফগান ক্রিকেট ছিল সেখানেই। সেই চার পিচে প্র্যাকটিস করে করে বড় হয়েছেন মোহাম্মদ নবী। প্রায় দুই দশক পেরিয়ে মোহাম্মদ নবী আজও আফগানদের ভরসার পাত্র। ৪০ ছুঁই ছুঁই বয়সে ব্যাটে-বলে সমান পারফরম্যান্স। দল খাদের কিনারায় দাঁড়ালে নবী এখনো তাদের টেনে নিয়ে যান। চ্যাম্পিয়নস ট্রফির মঞ্চে দাঁড়িয়ে ইংল্যান্ডকে হারানোর উল্লাসের সঙ্গী যে মোহাম্মদ নবীও।

দুই দশকে আফগান ক্রিকেটের পরিবর্তন মোহাম্মদ নবী দেখেছেন চোখের সামনে। একটা সময় ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা-কানাডার বিপক্ষে টেক্কা দেওয়া আফগানরা এখন টেক্কা দেয় অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। ক্রিকেটে তাদের ক্রমাগত উন্নয়ন কিন্তু এক দিনে আসেনি। খেলার প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসা নয়, বরং ভালো করতে চাওয়ার প্রচণ্ড আগ্রহ আর বহু বছর ধরে গড়ে তোলা কাঠামোর ফলাফল আজকের আফগান ক্রিকেট।

খর্বশক্তির দলে থাকে বোলিং তারকাদের জয়জয়কার
এএফপি

সাধারণত খর্বশক্তির দলগুলোর বোলিং শক্তি হয় চোখে পড়ার মতো। তারকা বোলার দিয়ে গড়া দল বড় দলগুলোকে চমকে দেয় তাদের দুর্দান্ত বোলিং দিয়ে। কারণটা বেশ সহজ, তুলনামূলক কম সুযোগ–সুবিধা নিয়ে বড় হওয়া দলগুলো বোলিং অনুশীলনের সুযোগ যতটা পায়, ব্যাটিং করার সুযোগ সেভাবে হয় না। ব্যাটিং রপ্ত করতে হলে সঠিক প্রশিক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে দরকার ভালো পিচ ও ভালো মাঠ। যে কারণে আইসিসির সহকারী দলগুলো ব্যাটিংয়ের দিক থেকে বরাবরই একটু দুর্বল থাকে। আফগানদের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তেমনই ছিল। রশিদ খানের সঙ্গে হামিদ হাসান, শাপুর জাদরানের মতো দুর্দান্ত পেস বোলার মিলে বোলিংটা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল শুরুতেই। এমনকি মোহাম্মদ নবী, গুলবাদিন নাইবও শুরু করেছিলেন বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে। কিন্তু এক দশকে বদলে গেছে আফগানদের চিত্র। আফগানরা এখন আর বোলিং দিয়ে প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করে না। বরং তাদের দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ের কাছে হার মানতে হয়েছে ২০১৯ বিশ্বকাপজয়ী ইংল্যান্ডকে। এর পেছনে আছে এক দশকের বেশি সময় ধরে গড়ে ওঠা ক্রিকেট সংস্কৃতি।

আরও পড়ুন

গত এক দশকে ক্রিকেটকে নিজের ধ্যান-জ্ঞানে পরিণত করেছে আফগানরা। ক্রিকেট সংস্কৃতি গড়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বড় শক্তি সেই দেশের ঘরোয়া ক্রিকেট। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় প্রায় সারা বছরই ক্রিকেট খেলতে পারে আফগানরা। সেই আবহাওয়া কাজে লাগিয়ে আফগান বোর্ড তৈরি করেছে সূচি। সারা বছর তাদের মাঠগুলোতে চলে ক্রিকেট। আর মাঠগুলোতে দর্শক থাকে কানায় কানায় পূর্ণ। সেটা মূল দল হোক কিংবা বয়সভিত্তিক অথবা স্কুল ক্রিকেট। আফগানিস্তানের প্রতিটি প্রদেশে রয়েছে খেলার মাঠ, প্রতিটি প্রদেশের আছে নিজস্ব লিগ। ভিন্ন ভিন্ন ফরম্যাটের লিগ চলে সারা বছর। কয়েকটি প্রদেশ নিয়ে গড়ে উঠেছে অঞ্চল। এই অঞ্চলভিত্তিক টুর্নামেন্ট থেকে নিংড়ে আনা হয় প্রতিভা। সারা বছর ক্রিকেট থাকায় যেমন খেলোয়াড়েরা খেলার সুযোগ পান, তেমনি অর্থনৈতিকভাবেও থাকেন স্বাচ্ছন্দ্যে। পুরো ঘরোয়া ক্রিকেট মিলে খেলার সুযোগ পান প্রায় আট হাজার খেলোয়াড়!

চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ইতিহাসে সর্বোচ্চ ১৭৭ রানের ইনিংস এসেছে ইব্রাহিম জাদরানের ব্যাট থেকে
ছবি: এএফপি

এ তো গেল ঘরোয়া ক্রিকেটের কথা। জাতীয় দলের আশপাশে থাকা খেলোয়াড়দের জন্য রয়েছে সম্পূর্ণ আলাদা সুযোগ–সুবিধা। আফগানিস্তানে ক্রিকেট ভালোমতো চললেও তাদের পূর্ণ সুযোগ–সুবিধা দেওয়া অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয়ে ওঠে না। যে কারণে সারা বছর আফগানদের ক্রিকেট ক্যাম্প চলে সংযুক্ত আরব আমিরাতে। সেখানে শুধু ক্যাম্প নয়, থাকে থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা। জাতীয় দলে নিয়মিত অনেক আফগান ক্রিকেটারই নিজ দেশে যান না অনেক দিন। এর সঙ্গে রয়েছে বিদেশি লিগগুলোতে খেলতে দেওয়ার অবাধ সুযোগ। আফগান ক্রিকেটাররা যে লিগেই সুযোগ পান না কেন, তাঁদের কখনো না করে না বোর্ড। কারণ একটাই, দলে অভিজ্ঞতার ভান্ডার গড়ে তুলতে চাইলে নিয়মিত বিদেশি লিগে খেলার কোনো বিকল্প নেই। যে কারণে মোহাম্মদ নবী, রশিদ খান, রহমানুল্লাহ গুরবাজ এখন টি-টোয়েন্টি জগতের হট কেক।

আরও পড়ুন

আফগানিস্তান বললেই চোখের সামনে যে ধ্বংসস্তূপ ভেসে আসে, আফগান ক্রিকেটের বাস্তবতা তেমন নয়। একটা সময় পাকিস্তান আর ভারতের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকা আফগানরা এখন নিজেরাই স্বাবলম্বী। নিজেদের ফরম্যাট থেকে উঠে আসছেন নিত্যনতুন তারকা। স্পিন ঘূর্ণি কিংবা দুর্দান্ত পেসের কাছে হার মানতে হচ্ছে বিশ্বজয়ীদের। ইংল্যান্ডকে হারানো এখন আর তাই রূপকথার গল্প নয়। প্রতিটি টুর্নামেন্টেই আফগানরা ছাড়িয়ে যাচ্ছে নিজেদের। গত বিশ্বকাপে আফগানরা থেমে গিয়েছিল এক ঝলক দেখিয়ে। ম্যাক্সওয়েলের অতিমানবীয় ইনিংসটি না হলে হয়তো বিশ্বকাপের মঞ্চে সবচেয়ে বড় জয়টা হতো তাদেরই। কিন্তু সেখানেই থামেনি তারা। আফগানদের উন্নতির গ্রাফটা এগিয়েই যাচ্ছে দ্রুতগতিতে। কোচ জোনাথন ট্রটের হাত ধরে খোলনলচে বদলে গেছে আফগান ক্রিকেটের। ব্যাটে, বলে, ফিল্ডিংয়ে এ যেন নতুন এক পরাশক্তি। অবসাদের কারণে ক্যারিয়ারের ইতি টানা ট্রট নতুন করে ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছেন আফগানিস্তানে এসে। তিন বছর পর এসে ট্রটের আফগানিস্তানকে খাটো করে দেখার সাহস নেই কারও।

২০২৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল, ২০২৫ চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে ইংল্যান্ডকে হারানো; আফগানদের জয়গুলো কোনোটাই ফ্লুক নয়। বরং বছরের পর বছর ধরে করা পরিকল্পনার ফলাফল। আফগানদের জয়কে আর রূপকথার গল্প হিসেবে দেখার সুযোগ নেই আর। আফগানরা জিতবে, ক্রিকেট–বিশ্ব ছড়ি ঘোরাবে, বড় দলগুলো মুখোমুখি হওয়ার আগে তাদের নিয়ে আলাদা ছক কষবে। কালেভদ্রে নয়, নিয়মিতই বড় দলগুলোকে হারাবে। এটাই এখন বাস্তব।

আরও পড়ুন