২০০০ সাল, সিডনি। ১০০ মিটার সাঁতারের ফ্রিস্টাইলের জন্য প্রস্তুত প্রতিযোগীরা। অলিম্পিকের মূল পর্বে যেতে হলে জিততে হবে এই বাছাই পর্ব। কাজটা তেমন কঠিন নয়। কারণ, মোট প্রতিযোগী তিনজন। অপেক্ষা করছেন ফাইনাল সংকেতের জন্য। দুজন ঝাঁপিয়ে পড়েছেন সুইমিং পুলে। একজন এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। অবাক হয়ে তাকাচ্ছেন এদিক–ওদিক। নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না। বন্দুকের গুলি ছুটিয়ে সংকেত দিল আর তিনি শুনতেই পেলেন না! নাকি এখনো সংকেত দেওয়াই হয়নি। কিন্তু দুজন যে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। কী করবেন এখন তিনি? ঝাঁপিয়ে পড়বেন পুলে? এমন সিদ্ধান্তহীনতায় যখন ভুগছেন, তখন যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। যে দুজন পুলে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, তাঁরা ডিসকোয়ালিফায়েড। তার মানে এখনো গুলি ছোটেনি। পরের রাউন্ডে যাওয়ার জন্য তাঁর সমীকরণ পানির মতো সহজ। শুধু সাঁতারটা শেষ করতে পারলেই হলো। কিন্তু সবার মনের ইচ্ছা তো আর সব দিন পূরণ হয় না! যেমনটা হয়নি এরিক মুসাম্বানিরও। কী হয়েছিল সেদিন এরিকের সঙ্গে, সেটাই বলব তোমাদের।
নির্দিষ্ট সময়ে বন্দুক থেকে গুলি বেরোল। এরিক ঝাঁপিয়ে পড়লেন পুলে। জীবনের প্রথমবার। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছ। অলিম্পিকে তো বটেই, ১০০ মিটার সাঁতারেও জীবনে প্রথমবার। ১৭ হাজার দর্শকের সামনে ১০০ মিটার সাঁতার কাটতে হবে ১ মিনিট ১০ সেকেন্ডের মধ্যে। সাঁতারুরা অবশ্য ১ মিনিটের কম সময়েই ১০০ মিটার পার করেন। কিন্তু এরিক নির্দিষ্ট এই সময়ের মধ্যে শেষ করতে না পারলে যেতে পারবেন না পরের রাউন্ডে।
শুরুতে ভালোই সাঁতার কাটলেন এরিক। কিন্তু সময় যেতেই তাঁর গতি কমছিল। ফলে ৫০ মিটার শেষ করতেই লাগে প্রায় ৪১ সেকেন্ড। বাকি ৫০ মিটার পাড়ি দিতে হবে মাত্র ২৯ সেকেন্ডে। বোঝাই যাচ্ছিল, নির্দিষ্ট সময়ে এরিক গন্তবে পৌঁছাতে পারবেন না। তবুও দর্শকেরা তাঁকে উৎসাহ দিতে থাকল। কিন্তু ৫০ মিটার পার হতেই দেখা গেল এরিকের আসল রূপ। আর এগোতে পারছেন না সামনে। সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে ফেলেছেন। এক জায়গায় স্থির হয়ে নিঃশ্বাস ফেলছেন। দর্শকদের কেউ কেউ এরিককে ব্যঙ্গ করে হাসছে। এরিক ভেসে রয়েছে পানিতে। দর্শকসারি থেকে চিৎকার ভেসে এল। গো! গো! গো! সেই উল্লাসে শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে এরিক শেষ করলেন ১০০ মিটার সাঁতার। ততক্ষণে হয়ে গেছে প্রায় ১ মিনিট ৫৩ সেকেন্ড। এরিক যেন যুদ্ধের ময়দান থেকে উঠে এসেছেন। কোনো রকমে শরীরটা টেনে পুলের ওপরে তুলেছে। দর্শকেরা সবাই দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে। কারণ, এই দর্শকদের জন্যই ১০০ মিটার পার করতে পেরেছেন এরিক। সে বছর সাঁতারে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন গুগেনব্যান্ড। তাঁর সময় লেগেছিল ৪৮.৩০ সেকেন্ড।
এরিক ইকুয়াটোরিয়াল গিনির মানুষ। খুব গরিব। শখের বশে সাঁতার শেখেন। সাঁতার শেখার কিছুদিন পরে জানতে পারেন অলিম্পিক প্রতিযোগিতার কথা। তা–ও আবার অলিম্পিকের জন্য মানুষ খোঁজা হচ্ছে, সেখানেই জানতে পারেন।
আর এরিক? ইতিহাসের সবচেয়ে ধীরগতির সাঁতারু হিসেবে পরিচিত হয়েছেন। কারণ, অলিম্পিকে আজ পর্যন্ত কোনো সাঁতারুর ১০০ মিটার পার করতে ১ মিনিট ৫৩ সেকেন্ড লাগেনি। কিন্তু তাতে এরিকের কোনো ক্ষতি হয়নি। বরং রাতারাতি তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ব্যর্থতাই তাঁকে ইতিহাসে পরিণত করেছে। সাংবাদিকরা তাঁকে ট্রল করে নাম দেন ‘এরিক দ্য ইল’। তাই মুসাম্বানি আজও ‘দ্য ইল’ নামেই বেশি পরিচিত। গণমাধ্যমের কল্যাণেই এরিক এত বিখ্যাত হয়ে যান যে অলিম্পিক কর্মকর্তারা তাঁর জন্য একজন দোভাষীর ব্যবস্থা করেছিলেন। মানুষ তাঁর অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য রীতিমতো লাইন করে দাঁড়াত।
এখন তোমাদের মনে দুটি প্রশ্ন আসতে পারে। প্রথমত, এরিকের কেন সাঁতার শেষ করতে এত কষ্ট হলো। আর দ্বিতীয়ত, এরিক যদি সাঁতার না-ই পারে, তাহলে অলিম্পিকে পৌঁছাল কীভাবে। এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য যেতে হবে বেশ খানিকটা পেছনে।
এরিক ইকুয়াটোরিয়াল গিনির মানুষ। খুব গরিব। শখের বশে সাঁতার শেখেন। সাঁতার শেখার কিছুদিন পরে জানতে পারেন অলিম্পিক প্রতিযোগিতার কথা। তা–ও আবার অলিম্পিকের জন্য মানুষ খোঁজা হচ্ছে, সেখানেই জানতে পারেন। এরিক ভাবলেন, সাঁতার যখন পারি তাহলে নাম দিতে সমস্যা কী। তিনি নাম লেখালেন অলিম্পিকে। এখানে জানিয়ে রাখি, আগে উন্নয়নশীল দেশে অলিম্পিক জনপ্রিয় করতে ওয়াইল্ড কার্ড দেওয়া হতো। এই কার্ডের সাহায্যে যেকোনো মানুষ অলিম্পিকে যোগ দিতে পারে। তেমনই গিনি থেকে ওয়াইল্ড কার্ডের সাহায্যে অ্যাথলেট নেওয়া হবে।
যা–ই হোক, গিনিতে সাঁতার প্রতিযোগিতার জন্য যাঁরা নাম লেখালেন, ট্রায়ালের দিন তাঁরা কেউ এলেন না। এই ট্রায়াল থেকে সেরা সাঁতারুদের দেওয়া হবে অলিম্পিকের ওয়াইল্ড কার্ড। সেদিন এরিকের সঙ্গে ট্রায়ালে উপস্থিত হয়েছিলেন আরও একটি মেয়ে। এই দুজনই। আয়োজকেরা ভাবল, মাত্র দুজন প্রতিযোগী, তাঁদের আবার ট্রায়ালের কী দরকার! একবারে তাঁদের দুজনকেই ওয়াইল্ড কার্ড দেওয়া হলো।
এবার এরিকের সাঁতার অনুশীলন করার পালা। কিন্তু অনুশীলন করবে কোথায়? যেখানে ট্রায়াল দিতে এসেছিলেন, সেই পুলের দৈর্ঘ্য ছিল মাত্র ১২ মিটার। তা–ও একটি হোটেলের পুল। ফলে গরিব এরিককে সেখানে সাঁতারের তেমন সুযোগ দেওয়া হতো না। সব মিলিয়ে মাত্র ৫-৬ বার তিনি সেই পুলে নেমেছিলরন। তা–ও আবার কোনো কোচ নেই। নিজের মতো করে কয়েকবার সাঁতার কাটলেন এরিক।
অলিম্পিক থেকে এরিক শিক্ষা নিয়েছিলেন। এরপর সত্যিই তিনি সাঁতার শিখেছেন। পরে তিনি ৫৭ সেকেন্ডে ১০০ মিটার পাড়ি দেওয়ার রেকর্ড করেছিলেন। অবশ্য পরের অলিম্পিকে ভিসা জটিলতার কারণে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। আর ২০০৮ সালে নিজেই অংশ নেননি। তবে ২০১২ সালে এরিক গিনির জাতীয় সাঁতার দলের কোচের দায়িত্ব নেন।
দেখতে দেখতে চলে এলো অলিম্পিকের সময়। এর আগে কোনো দিন এরিক প্লেনে ওঠেননি। সিডনি যে কোথায় তা–ও তিনি জানেন না। এ অবস্থাতেই সিডনি পৌঁছালেন। গিয়ে দেখলেন, ইয়া বড় বড় পুল। আগে শুনেছিলেন ৫০ মিটার সাঁতার কাটতে হবে তাঁকে। এখন শুনছেন, ওটা আসলে ১০০ মিটার। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়বে। এত পথ কীভাবে পাড়ি দেবেন তিনি। সাঁতরেছেন তো মাত্র ওই ১২ মিটার পুলে।
সিদ্ধান্ত নিলেন, এখানে অন্য সাঁতারুদের দেখেই তিনি সাঁতার শিখবেন। কিছুটা শিখেছিলেনও। কীভাবে লাফ দিতে হয়, এ রকম কিছু বিষয়। তাঁর সঙ্গে সাঁতারের প্রয়োজনীয় কোনো জিনিসও ছিল না। সেগুলো নাকি অন্য এক দেশের কোচ তাঁকে দিয়েছিলরন। এই হলো অবস্থা! সেই এরিক যে প্রথমবার ১০০ মিটারের পুলে সাঁতার সম্পন্ন করেছেন, এটাই–বা কম কী? দর্শকদের স্ট্যান্ডিং অভিষেক তো তাঁরই প্রাপ্য। আরও একটা চমকে দেওয়া তথ্য দিই। এরিকের সবচেয়ে ধীরগতির ওই টাইমিংই গিনির সবচেয়ে দ্রুততম সাঁতারুর রেকর্ড হয়েছিল। ভাবো এবার!
তবে এই অলিম্পিক থেকে এরিক শিক্ষা নিয়েছিলেন। এরপর সত্যিই তিনি সাঁতার শিখেছেন। পরে তিনি ৫৭ সেকেন্ডে ১০০ মিটার পাড়ি দেওয়ার রেকর্ড করেছিলেন। অবশ্য পরের অলিম্পিকে ভিসা জটিলতার কারণে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। আর ২০০৮ সালে নিজেই অংশ নেননি। তবে ২০১২ সালে এরিক গিনির জাতীয় সাঁতার দলের কোচের দায়িত্ব নেন।
এখানে আরও একটি কথা জানিয়ে রাখি। এরিকের সঙ্গে অলিম্পিকের ফ্রিস্টাইলে যে দুজন ডিসকোয়ালিফায়েড হয়েছিলেন, তাঁরাও ওয়াইল্ড কার্ডের সাহায্যে এসেছিলেন। হয়তো তাঁরাও এরিকের মতো নিয়ম-কানুন জানতেন না। তাই সংকেত দেওয়ার আগেই অমন ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন পুলে।
এরিক অলিম্পিকের সবচেয়ে ধীরগতির সাঁতারু হলেও তিনি ভিলেন হননি। হয়েছেন নায়ক। ব্যর্থ হয়েও বারবার চেষ্টায় সফল হয়েছেন। কম আয়ের একটি দেশ থেকে উঠে এসে নিজের ইচ্ছায় সাঁতার শিখে ৫৭ সেকেন্ডে ১০০ মিটার পাড়ি দেওয়া কম কথা নয়। সবচেয়ে বড় কথা, সিডনির ওই অলিম্পিকে তিনি হতাশ হয়ে পুল থেকে উঠে আসেননি। নিজের সবটা দিয়ে সাঁতার শেষ করেছেন। মানুষের মন জয় করার জন্য এটাই যথেষ্ট।