কেমন ছিল হাথুরুসিংহের দ্বিতীয় অধ্যায়
ন্যাড়া বেলতলায় একবার গেলেও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড গেল দুবার। দেশের ক্রিকেটের সঙ্গে চন্ডিকা হাথুরুসিংহে জুটির প্রথম অধ্যায় যে পরিমাণ তিক্ততায় শেষ হয়েছিল, তারপর তাঁকে যেকোনো সময় ফেরাতে ওজর-আপত্তি দেখাত যেকোনো দেশই। কিন্তু বাংলাদেশ তাঁর হাতে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিল প্রথম পর্ব শেষের অর্ধযুগের মধ্যেই। যদি কর্তারা ভেবে থাকেন, এবার বেশ মধুরেণসমাপয়েৎ ঘটবে, সে আশাতেও গুড়ে বালি। এবার অবশ্য হাথুরুসিংহে নিজেই দায়িত্ব ছাড়ার সুযোগ পাননি, বরং বিসিবিই চাকরিচ্যুত করেছে তাঁকে। বিসিবি সভাপতি হিসেবে ফারুক আহমেদ দায়িত্ব গ্রহণের পর যাকে একরকম ভবিতব্যই বলে ধরে নেওয়া হচ্ছিল।
শেষ পর্যন্ত গত ওয়ানডে বিশ্বকাপের মধ্যে এক ক্রিকেটারের ওপর চড়াও হওয়া আর নির্ধারিত বরাদ্দের চাইতে বেশি ছুটি নেওয়াকে কারণ দেখিয়ে বিদায় করা হয়েছে এই শ্রীলঙ্কান কোচকে। তাঁকে ৪৮ ঘণ্টার কারণ দর্শানো নোটিশ পাঠিয়ে এর মধ্যেই নতুন কোচ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় ফিল সিমন্সকে। এই তড়িঘড়ির কারণে বিসিবিকে কোনো আইনি জটিলতায় পড়তে হবে কি না, এ নিয়েও ক্রিকেটপাড়ায় আছে কানাঘুষা। চাকরিচ্যুত হয়ে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়াতেই আইনের শরণাপন্ন হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন হাথুরু। দিন কয়েক বাদে সংবাদমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার তো করেছেনই, প্রশ্ন তুলেছেন কর্মীদের সঙ্গে বিসিবির আচরণ নিয়েও। হাথুরুসিংহে তাই আপাতত বাংলাদেশ ছাড়লেও এই গল্পের কিছুটা বোধ হয় বাকি আছে এখনো।
সেটা লেখা হতে হতে বরং হাথুরুসিংহে কী করে গিয়েছেন, এই খেরোখাতার হিসাব মেলানোই শ্রেয়। প্রথম দফায় যেমন ফলাফলের ঘরে চোখ বুলিয়েই সফল বলে দেওয়া যাচ্ছিল তাঁকে, দ্বিতীয় দফায় সেই সুযোগটা পাওয়া যাচ্ছে না একদমই। দ্বিতীয় দফায় কেমন করেছেন হাথুরুসিংহে—এই প্রশ্নের প্রতিক্রিয়াটা বোধ হয় মিশ্রই হবে।
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব নেন এই শ্রীলঙ্কান কোচ। তারপর বাংলাদেশ টেস্ট খেলেছে ১০টি। জয়-পরাজয়ের সংখ্যা সমান সমান, পাঁচটি। তবে এই পাঁচ জয়ে বাড়তি নজর দিতেই হচ্ছে। আফগানিস্তানের বিপক্ষে একমাত্র টেস্টে বাংলাদেশ জয় পেয়েছিল ৫৪৬ রানে, দেশের ক্রিকেট ইতিহাসে এর চাইতে বড় জয় আসেনি। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেও জয় এসেছে তাঁর সময়ে। আর পাকিস্তানের বিপক্ষে পাকিস্তান থেকে সিরিজ জিতে আসাটা তো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের পরিপ্রেক্ষিতেও বড়সড় ঘটনা এ বছর। ক্রিকেটের জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম ‘ক্রিকইনফো’ যেমন প্রশ্নই ছুড়ে দিয়েছে, ‘বাংলাদেশ পাকিস্তানের বিপক্ষে দুই টেস্টই জিতেছে, ২০২৪ সালে এর চাইতে বড় অঘটন ঘটেছে কি না।’
তবে, বিদায় নেওয়ার আগে সবশেষে যা ঘটল, মানে, বাংলাদেশ-ভারত সিরিজে, সেটা হাথুরুকে পীড়াই দেবে বোধ হয়। যেমন পীড়া দেবে ওয়ানডের পরিসংখ্যানটা। প্রথমবার যে ফরম্যাটে এসেছিল স্মরণীয় সব সাফল্য, সেই ফরম্যাটে দ্বিতীয় দফায় মনে রাখার মতো জয় খুঁজে পাওয়াই হচ্ছে দুষ্কর। হ্যাঁ, কিউইদের বিপক্ষে তাদের মাঠে গিয়ে প্রথমবার জয় পাওয়ার রেকর্ড হয়েছে এবার, ৩৫ ম্যাচে ১৩টা জয়ও আছে, কিন্তু হারতে তো হয়েছে ১৯ ম্যাচে। আর হারগুলোর এক-তৃতীয়াংশের বেশি বিশ্বকাপে বলে দগদগে হয়ে জ্বলছে সেই স্মৃতিগুলোই। ভারত-অস্ট্রেলিয়া-পাকিস্তান-দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলের বিপক্ষে তো কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাই গড়া যায়নি, হারতে হয়েছে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষেও। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মান রক্ষার জয় না পেলে আগামী বছরের চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে খেলার স্বপ্নও মিশে যেত ধুলোয়।
হতাশার গল্প ছিল টি-টোয়েন্টিতেও। আয়ারল্যান্ড আর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টানা ছয়টি-টোয়েন্টি জিতে হাথুরু যখন শুরু করলেন, তার চাইতেও বড় কথা, জয়গুলো যেভাবে এসেছিল, টি-টোয়েন্টি নিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখতেই শুরু করেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু পরের বছর বিশ্বকাপ আসতে আসতে সব স্বপ্নই হাওয়ায় গেল মিলিয়ে। আফগানিস্তানের বিপক্ষে হারটাই বোধ হয় সবচেয়ে পোড়াচ্ছে বাংলাদেশের ক্রিকেট-ভক্তদের। সেমিফাইনালের স্বপ্ন যখন মাত্র ১১৬ রান দূরে, তখন ৩ উইকেট হারাতেই হাল ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করা, হতবাক করেছে সমর্থক–সমালোচকদের।
জাতীয় দলের সাবেক পারফরম্যান্স অ্যানালিস্ট শ্রীনিবাস চন্দ্রশেখরন তো শুধু মনের মধ্যেই চেপে রাখেননি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একদম খুল্লামখোলাই খোঁচা মেরেছিলেন হাথুরুসিংহেকে। দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই তামিম ইকবালের সঙ্গে সম্পর্কটা হয়ে গিয়েছিল বরফের মতো শীতল। বিসিবি সভাপতি জানিয়েছেন, হাথুরুকে চাকরিচ্যুত করার পেছনে এক ক্রিকেটারের গায়ে হাত তোলাটা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। অভিযোগ ছিল, অন্য এক ক্রিকেটারের ওপর চড়াও হওয়ারও। শ্রীনিবাসনের খোঁচাকে বলা যেতে পারে, তাঁর মনের মধ্যে পুষে রাখা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশও। যা থেকে ধারণা করে নেওয়া যায়, দায়িত্বে থাকাকালে কোচিং স্টাফদের সঙ্গেও খুব একটা সদ্ভাব বজায় রাখতে পারেননি এই শ্রীলঙ্কান। যার সর্বশেষ পরিণতি, দ্বিতীয়বারের মতো মেয়াদ পূর্ণ করার আগেই বাংলাদেশছাড়া।
যে বিদায়ে প্রশ্ন উঠছে কেবল একটাই, চ্যাম্পিয়নস ট্রফি মাত্র পাঁচ মাস দূরে, এই ক্ষণে এসে তাঁকে বিদায় দেওয়ার জন্য সময়টা আদর্শ ছিল কি না।