সিজার লুইস মেনোত্তি: আর্জেন্টাইন ফুটবলের পালাবদলের মহারথী
আর্জেন্টাইন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের হেডকোয়ার্টারে বেশ চিন্তিত মুখে হাঁটাচলা করছেন এক ভদ্রলোক। ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল তাঁর। ভদ্রলোকের নাম সিজার লুইস মেনোত্তি, আর্জেন্টাইন জাতীয় ফুটবল দলের কোচ। ঘরের মাঠে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া বিশ্বকাপ সামনে রেখে আর কিছুক্ষণ পর দল ঘোষণা করবেন তিনি। বিশাল এক চমক থাকতে চলেছে সেই দলে। এই চমক সবাই কীভাবে নেবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। কারণ, মেনোত্তি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, দুই বছর ধরে দুর্দান্ত খেলতে থাকা ১৭ বছর বয়সী বিস্ময়–বালক ম্যারাডোনাকে বিশ্বকাপের দলে রাখবেন না। তাঁর মনে হয়েছে, এই বিশ্বকাপের চাপ নিতে এখনো প্রস্তুত নন ম্যারাডোনা। তিনি যে ঘরানার ফুটবল খেলাতে ইচ্ছুক, বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে ওই ধরনের ফুটবল ম্যারাডোনা খেলতে পারবেন না। তা ছাড়া তাঁর হাতে অভিজ্ঞ খেলোয়াড়ের সংখ্যাও কম নয়। তাই এদের নিয়েই এবারের বিশ্বকাপে যেতে চান তিনি।
বুয়েনস এইরেসে তখন ম্যারাডোনা রেডিও কানে ধরে বসে আছেন এক স্বপ্নপূরণের আশায়। সংবাদ সম্মেলনে মেনোত্তি এলেন। গম্ভীর মুখে দল ঘোষণা করলেন। একে একে বললেন অস্কার ওরতিজ, আলবার্তো তারান্তিনি, মিগুয়েল ওভিয়েদো, ড্যানিয়েল বার্তোনি, মারিও কেম্পেস, রেনে হাউসম্যান এবং ড্যানিয়েল প্যাসারেল্লাদের নাম। কিন্তু সেখানে ডিয়েগো ম্যারাডোনার নাম নেই। গুঞ্জনের জোয়ার উঠল চারদিকে। এরপর গুঞ্জন বদলে রূপ নিল সমালোচনায়। মেনোত্তি সেসবের কিছুই কানে তুললেন না। সাংবাদিকদের গুটিকয় প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সোজা বিদায় নিলেন। এমন অসম সিদ্ধান্তের পর শুরুতে ব্যাপক সমালোচিত হন তিনি। তবে ধীরে ধীরে সব সমালোচনা উবে যেতে শুরু করল। কারণ, আর্জেন্টিনায় তখন চলছে রাজনৈতিক সহিংসতা। সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে হোর্হে ভিদেলা তখন দেশের ক্ষমতায়। সেই নরকতুল্য আর্জেন্টিনা একটুকরো স্বর্গের হাওয়া পেয়েছিল ফুটবলে। মারিও কেম্পেসের জাদুতে আর্জেন্টিনা জিতেছিল তাদের ইতিহাসের প্রথম বিশ্বকাপ। যার নেপথ্যে ছিলেন ডাগআউটে দাঁড়ানো লিকলিক গড়নের কোচ সিজার লুইস মেনোত্তি।
মেনোত্তির শারীরিক গঠন ছিল একেবারে পলকা, এ জন্যই তাকে বলা হতো ‘এল ফ্লাকো।’ তাঁর লম্বা চুল সব সময় নেমে থাকত ঘাড় পর্যন্ত। নরসুন্দরের প্রতি নাকি বিশ্বাস ছিল না মেনোত্তির। তাই নিজের চুল কাটার প্রয়োজন হলে নিজেই নেমে পড়তেন কাঁচি নিয়ে। ব্যক্তিগত জীবনে ধূমপায়ী ছিলেন। সিগারেট খেতে ভালোবাসতেন। এ জন্য সব সময় দুই হাতের মাঝখানে জ্বলজ্বলে এক সিগারেট থাকা লাগত। নিজে রাজনৈতিক কর্মীও ছিলেন। পছন্দ করতেন বক্সিং। কিন্তু তাঁর এই রাজনৈতিক জীবন, আর্জেন্টিনাকে একবার বিশ্বকাপ জেতানো, সঙ্গে সমালোচনা—সিজার লুইস মেনোত্তি কি এসব বিষয়বস্তুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ? আর কিছুই কি নয়?
মেনোত্তির জন্ম রোজারিওতে, যেখানে পরে জন্ম লিওনেল মেসির। ফুটবল ক্যারিয়ার তেমন বর্ণাঢ্য নয় মেনোত্তির। রোজারিও সেন্ট্রাল, রেসিং ক্লাব আর বোকা জুনিয়র্সের পর ব্রাজিলে গিয়ে পেলের সঙ্গে সান্তোসের হয়ে খেলেছেন। আর্জেন্টিনার হয়েও মাঠে নেমেছেন মোট ১১ ম্যাচে, গোল করেছেন মাত্র ২টি। এরপর বুটজোড়া তুলে রাখেন ১৯৬৯ সালে। ’৭০-এর বিশ্বকাপের ঠিক আগের বছর। ১৬ বছর বয়সে বাবা ক্যানসারে মারা গিয়েছিলেন। তত দিনে তাঁর ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু হয়ে গেছে স্থানীয় ক্লাব ইউনিয়ন আমেরিকায়। খেলতেন স্ট্রাইকার হিসেবে। ছেলেবেলার এই ক্লাবে থাকাকালে স্টেডিয়ামের দেয়ালে গ্রাফিতি আঁকার জন্য ৩০ দিনের কারাবাসের অভিজ্ঞতা হয় তাঁর।
খেলোয়াড়ি জীবনকে বিদায় জানিয়েই কোচ হিসেবে কাজ করা শুরু করে দেন মেনোত্তি। লাতিন আমেরিকানরা তাঁর নাম প্রথম চিনতে শুরু করে হুরাকানকে মেট্রোপলিটানো চ্যাম্পিয়নশিপ জেতানোর পর। তখনকার সময়ে আগ্রাসী ফুটবলের প্রচলন ছিল আর্জেন্টিনায়। শরীর দিয়ে মারকুটে গতির ফুটবল খেলত সবাই। নান্দনিকতার ছিটেফোঁটাও ছিল না সেখানে। ব্রাজিল তখন তাদের রক্তে মেশানো ফুটবলের সাম্বা নৃত্য ঠিকই করে যাচ্ছে। মেক্সিকো বিশ্বকাপে গিয়ে মারিও জাগালোর দল শিরোপা পর্যন্ত ছিনিয়ে নিয়ে এল। অথচ সেবার বিশ্বকাপের মূল মঞ্চেই পৌঁছাতে পারেনি আর্জেন্টিনা। সবাই সবকিছু জিতেছে, নান্দনিক ফুটবল খেলছে, শুধু আর্জেন্টিনায় ব্যতিক্রম।
গোটা আর্জেন্টিনায় একটা বিশাল পরিবর্তনের দরকার ছিল। প্রথা ভাঙলেন মেনোত্তি, আনলেন পরিবর্তন। হুরাকানে তাঁর দল খেলতে শুরু করল দৃষ্টিনন্দন পাসিং আর অ্যাটাকিং ফুটবলের মিশেলে। ওভারল্যাপিং, নাটমেগ, ওয়ান-টাচ-মুভ, ওয়ান-টু-ওয়ানের মতো কৌশলের ছত্রচ্ছায়ায় বেড়ে উঠেছিল হুরাকানের খেলোয়াড়েরা। আর্জেন্টাইন এই ক্লাবের হয়ে রোমাঞ্চকর ফুটবল খেলিয়ে তিনি যখন সাফল্য পাচ্ছেন, ঠিক তখনই বিশ্বকাপে রাইনাস মিশেলের ডাচ বাহিনীর সামনে আর্জেন্টিনা আরও একবার ধরাশায়ী। দ্বিতীয় রাউন্ডে ব্রাজিল আর নেদারল্যান্ডের কাছে হেরে বিশ্বকাপে আবারও ব্যর্থ আর্জেন্টিনা। এরপর আলবিসেলেস্তেদের কোচের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হলো মেনোত্তির হাতে।
৯ বছর থাকলেন নিজের দেশের দায়িত্বে। জেতালেন বিশ্বকাপ। বার্সেলোনার কোচ হয়ে ১৯৮৩ সালে পাড়ি জমালেন ইউরোপে। সেখানে একবার স্প্যানিশ সুপার কাপ এবং স্প্যানিশ কাপ জিতলেন। এরপর বার্সার পাট চুকিয়ে বেশ কয়েকটা ক্লাবে কোচের দায়িত্ব কমবেশি পালন করেছেন তিনি। কিন্তু পরিসংখ্যান ঘাঁটলে তেমন শিরোপা পাওয়া যাবে না তাঁর ঝুলিতে। মেনোত্তির সমসাময়িক বা পরবর্তী সময়ে অনেক কোচ রয়েছেন, যাঁরা তাঁরা চেয়েও বেশি সাফল্যের দেখা পেয়েছেন, একগাদা শিরোপা রয়েছে তাঁদের ঝুলিতে। কিন্তু মেনোত্তিকে এই শিরোপা বা ক্লাবের সাফল্য পরিসংখ্যান দিয়ে মাপা ঠিক হবে না।
মেনোত্তির দর্শন ছিল ‘রাফ অ্যান্ড টাফ’ ফুটবলকে সরিয়ে দৃষ্টিনন্দন ফুটবলকে প্রতিষ্ঠিত করা। যেখানে ফুটবল একটি সাধারণ ৯০ মিনিটের খেলা নয়, যে খেলা দেখে গ্যালারিতে দর্শক উপভোগ করবে। তাঁর কাছে গোটা ফুটবল ছিল একটা ছন্দ, যে ছন্দ তৈরি হতো পাসের মাধ্যমে। আর্জেন্টিনার ফুটবলে তাঁর এই ধারণাকে বলা হয় ‘মেনোত্তিজম’। ১৯৭৪ সালে আর্জেন্টিনার কোচের দায়িত্ব পেয়ে ১৯৭৮ সালেই প্রথমবার বিশ্বকাপ জিতিয়ে দেওয়ার মধ্যেই মেনোত্তির অবদান কিন্তু শেষ নয়। তিনি আসলে আর্জেন্টিনার ফুটবলের রূপরেখা বদলে দিয়েছিলেন। ঘরের মাঠের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে তিনি ৪-৩-৩-এর আক্রমণাত্মক ছকে খেলিয়েছিলেন। তাঁর দল কখনো ক্ষুধার্ত দানবের মতো প্রতিপক্ষের ডেরায় আক্রমণ চালাত না, বরং সব সময় বল পায়ে রেখে শকুনের দৃষ্টিতে খুঁজে চলত প্রতিপক্ষের দেওয়া একটু স্পেস আর সঠিক সময়ের অপেক্ষা। আর এই পুরো ব্যাপারটাই তাঁর দলে চলত যুগপতভাবে। মেনোত্তির কথা ছিল ম্যাচ জেতা লাগবে না, আগে সুন্দর ফুটবল খেলার চেষ্টা করো। এই সুন্দর ফুটবল খেলেই মেনোত্তি জিতেছিলেন আটাত্তরের বিশ্বকাপ। স্তাদিও মনুমেন্টালে ফাইনালে কিন্তু তাঁরা হারিয়েছিল ফুটবলের আরেক সুন্দরের পূজারি নেদারল্যান্ডসকে। এরপর কার্লোস বিলারদো বা আলফি বাসিলেসহ কোচ হিসেবে যাঁরা এসেছেন, সবাই হেঁটেছেন মেনোত্তির দেখানো পথেই। তাঁরা সবাই চেয়েছেন উপভোগ্য, সুন্দর ফুটবল খেলতে।
১৯৭৮ সালে ম্যারাডোনাকে বিশ্বকাপে না নিয়ে প্রচ্ছন্নভাবে তার ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন মেনোত্তি। সেবার দলে জায়গা না পেয়ে প্রবল এক ক্ষুধা চেপে বসেছিল ম্যারাডোনার মধ্যে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি পরিণত হয়েছেন, থিতু হয়েছেন দলে। ফুটবলের মাঠে তাঁর বড় একটা সমস্যা ছিল নিজের স্বভাব আর মেজাজ। ম্যারাডোনা সেখানে প্রতিনিয়ত কাজ করেছেন, চেষ্টা করেছেন ওই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসার। মাঝের একটা বিশ্বকাপ কেটেছে ভুলে যাওয়ার মতো। কিন্তু ছিয়াশির বিশ্বকাপ তো ম্যারাডোনা নিজ হাতে জিতিয়েছিলেন। হয়তো আটাত্তরে ঘরের মাঠে বিশ্বকাপে গেলে ম্যারাডোনার ফুটবল–জীবন অন্য রকম হলেও হতে পারতো। হয়তো মেনোত্তি তাঁকে বাদ দিয়েছিলে পরিকল্পনার কথা ভেবে। কিন্তু বাদ পড়ার এই হতাশা ম্যারডোনার জন্য ছিল এক নতুন পথচলা, ক্যারিয়ারের এক নতুন ভোর।
আটাত্তরে কোচের আসনে থেকে মেনোত্তি বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন, ছিয়াশির বিশ্বকাপের জয়ের নায়ককে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছেন। আর্জেন্টিনার তৃতীয় বিশ্বকাপে কি তাঁর ভূমিকা নেই? একটু খুঁজে দেখা যাক।
২০১৮ বিশ্বকাপের ভরাডুবির পর কোচের আসন থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় তৎকালীন কোচ হোর্হে সাম্পাওলিকে। পরবর্তী কোচ কে হবেন? আলোচনার টেবিলে ছিল মারসেলো গ্যালারদোসহ আরও প্রতিষ্ঠিত বেশ কয়েকজন কোচের নাম। মেনোত্তি তখন আর্জেন্টিনার ফুটবল ডিরেক্টরের ভূমিকায়। তিনি পরামর্শ দিলেন, কোচ হিসেবে সাম্পাওলির সহকারী কোচ লিওনেল স্কালোনিকে দায়িত্ব দিতে। আর্জেন্টাইন বোর্ড মেনোত্তির পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করল। স্কালোনি প্রথমে এলেন অন্তবর্তীকালীন ম্যানেজার হিসেবে। এরপর ব্রাজিলের মাটিতে কোপা আমেরিকা, ইতালিকে হারিয়ে ফিনালিসিমা আর কাতারে ফ্রান্সের সঙ্গে সেই ঐতিহাসিক ফাইনালের গল্প তো সবার জানা।
কোনো দেশের ফুটবলে বা ক্লাবে কালেভদ্রে কিছু চরিত্রের আগমন ঘটে, যাদের চিন্তাধারা ক্লাবের পুরো ইতিহাসে বিশাল এক ছাপ রেখে যায়। আয়াক্স, নেদারল্যান্ডস আর বার্সেলোনার ক্ষেত্রে ‘টোটাল ফুটবল’ দিয়ে তাদের ডিএনএ যেমন ইয়োহান ক্রুয়েফ বদলে দিয়েছেন তেমনি আর্জেন্টিনার জন্য নামটা লুইস মেনোত্তির। তাঁর থেকে ভালো কোচ স্বয়ং আর্জেন্টিনাই পেয়েছে। বহু কোচ মেনোত্তির থেকে ঢের সফল ছিলেন। কিন্তু আর্জেন্টিনার ফুটবল খেলার ধরন বদলে দেওয়ার পাশাপাশি তাদের তিনটি বিশ্বকাপ জয়ের পেছনে অবদান রাখার জন্য মেনোত্তি আলবিসেলেস্তেদের ফুটবলে আজীবন এক ছন্দময় চরিত্র হয়ে থাকবেন।
গত ৫ মে ৮৫ বছর বয়সে মারা গেছেন সিজার লুইস মেনোত্তি। সুন্দর ফুটবল উপহার দেওয়ায় বিভোর থাকা এই ভদ্রলোক শুধু সশরীর এই পৃথিবীতে থাকবেন না। কিন্তু গোটা আর্জেন্টিনা আজীবন তাঁকে মনে রাখবে। বলে বেড়াবে, এল ফ্লাকো এসেছিল বলেই তো আমরা দৃষ্টিনন্দন ছন্দময়ী মনোরম ফুটবলটা খেলতে পারি।