ক্লাব ফুটবলের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ আসরের নাম উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ। ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্বের খোঁজে ইউরোপের সেরা সেরা দলগুলো মুখোমুখি হয় চ্যাম্পিয়নস লিগের মঞ্চে। কিন্তু এবারের আসর থেকে পুরোপুরি বদলে গিয়েছে চ্যাম্পিয়নস লিগ। ১৯৫৫-৫৬ মৌসুম থেকে বিরতিহীনভাবে চলে আসা টুর্নামেন্টে নতুন যুগের সূচনা হচ্ছে এই মৌসুম থেকেই। কী পরিবর্তন আছে এবারের ফরম্যাটে?
নতুন ফরম্যাটে পা দেওয়ার আগে পুরোনো ফরম্যাটে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। গত ২১ মৌসুম ধরে একই ফরম্যাটে চলছিল চ্যাম্পিয়নস লিগের লড়াই। আটটি গ্রুপে ভাগ হয়ে প্রথম পর্বে খেলত ৩২টি দল। প্রতি গ্রুপের শীর্ষ দুই দল উঠত শেষ ষোলোতে। হোম-অ্যাওয়ে ভিত্তিতে প্রতিটি দল খেলার সুযোগ পেত ৬টি করে ম্যাচ। সেখান থেকে দুই লেগের নকআউট ম্যাচ খেলে ফাইনাল। সেখান থেকেই নির্ধারিত হতো কার হাত উঠবে ইউরোপিয়ান শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা।
এই মৌসুম থেকে দলের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, বদলে গিয়েছে খেলার ফরম্যাটও। নতুন ফরম্যাটে দলের সংখ্যা এখন ৩৬। থাকছে না কোনো গ্রুপ পর্ব। গ্রুপের বদলে এসেছে লিগপদ্ধতি। ৩৬ দল নিয়ে তৈরি হবে লিগ টেবিল। সেখানে প্রতিটি দল ৮টি করে ম্যাচ খেলবে। উয়েফার তৈরি বিশেষ সফটওয়ারের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে আটটি দল। সেই আট দলের বিপক্ষে নিজেদের মাঠে ৪টি ও প্রতিপক্ষের মাঠে চারটি ম্যাচ খেলবে প্রতিটি দল।
প্রশ্ন করতে পারো, বাড়তি চারটি দল আসছে কোথা থেকে? এই বাড়তি চার দলের দুটি আসবে গত মৌসুমে যে দুটি দেশের ক্লাবগুলো সামগ্রিকভাবে উয়েফার ক্লাব প্রতিযোগিতায় ভালো করেছে, তাদের থেকে। গত মৌসুমে ফলাফলের ভিত্তিতে ইতালি ও জার্মানি থেকে চ্যাম্পিয়নস লিগে সুযোগ পেয়েছে বোলোনিয়া ও বরুসিয়া ডর্টমুন্ড। আরেকটি দল আসবে উয়েফার র্যাঙ্কিংয়ে পাঁচে থাকা লিগের তৃতীয় দল। এবার ফ্রেঞ্চ লিগ থেকে চ্যাম্পিয়নস লিগে সুযোগ করে নিয়েছে ব্রেস্ত। আর চতুর্থ দলটি আসবে বাছাইপর্ব পেরিয়ে। আগে বাছাইপর্ব পেরিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলত চারটি দল, এবার খেলবে পাঁচটি দল।
লিগপদ্ধতি হওয়ায় পরিবর্তন এসেছে চ্যাম্পিয়নস লিগ ড্র-এর পদ্ধতিতেও। আগের মতো চিরাচরিত বল তুলে গ্রুপ নির্ধারণ নয়, বরং স্বয়ংক্রিয় সফটওয়্যারের সাহায্যে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে কাদের প্রতিপক্ষ হচ্ছে কারা। এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগের ৩৬ দলকে ভাগ করা হয়েছিল ৪টি পটে। তবে এর আগেই কিছু নিয়মের বেড়াজালে বেঁধে দেওয়া হয়েছে পুরো সিস্টেমকে। কিন্তু এই ড্র নিয়েই আছে অনেকের কনফিউশন।
প্রথম পট থেকে একটি দলের নাম তোলা হলো। ধরা যাক, দলটি রিয়াল মাদ্রিদ। সফটওয়ারের মাধ্যমে রিয়াল মাদ্রিদের প্রতিপক্ষ আটটি দলের নাম ভেসে আসবে স্ক্রিনে। কোন দলের সঙ্গে ‘হোম’ ও কোন দলের সঙ্গে ‘অ্যাওয়ে’ ম্যাচ খেলবে, সেটিও তাৎক্ষণিকভাবে নির্ধারণ করবে এই সফটওয়্যার। তবে এই আট দল নির্বাচনের মধ্যেও আছে মারপ্যাঁচ।
• প্রতিটি পটের দল প্রতিটি পট থেকে দুটি করে প্রতিপক্ষ পাবে। অর্থাৎ ৪টি পট থেকে ৮টি দল।
• একই দেশের ক্লাবগুলো পরস্পরের বিপক্ষে খেলবে না। অর্থাৎ গ্রুপ পর্বে রিয়াল মাদ্রিদ আর বার্সেলোনার মুখোমুখি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
• একটি দল অন্য একটি দেশের সর্বোচ্চ দুটি ক্লাবের বিপক্ষে খেলবে।
মোনাকোতে এরই মধ্যে চ্যাম্পিয়নস লিগের এবারের পর্বের ড্র সমাপ্ত হয়েছে। প্রতিপক্ষও নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে প্রতিটি দলের। এখন আসা যাক দ্বিতীয় পর্ব বা নকআউট পর্বের কথায়। পয়েন্ট তালিকার শীর্ষ আটটি দল সরাসরি চলে যাবে ‘রাউন্ড অফ সিক্সটিন’-এ। আর পয়েন্ট তালিকার ৯ থেকে ২৪ নম্বর—মুখোমুখি হবে নকআউট প্লে-অফ ম্যাচে। জয়ী আট দল সরাসরি যোগ দেবে ‘রাউন্ড অফ সিক্সটিন’-এর বাকি আট দলের সঙ্গে।
‘রাউন্ড অফ সিক্সটিন’ থেকে পথটা আগের মতোই। হোম-অ্যাওয়ে ভিত্তিতে দুই লেগের খেলা। জয়ী দল পরবর্তী পর্বে। শেষ ১৬ থেকে শেষ ৮, অতঃপর ৪। শেষ পর্যন্ত ২। আর ফাইনাল হবে প্রতিবারের মতো আগে থেকেই নির্ধারিত কোনো ভেন্যুতে। এবারের ভেন্যু জার্মানির অ্যালিয়াঞ্জ অ্যারেনা।
কয়েক বছর ধরেই চ্যাম্পিয়নস লিগে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছে উয়েফা। নিত্যনতুন বুদ্ধি বাতলে দিলেও বারবার তা বরখাস্ত হচ্ছিল সমর্থনের অভাবে। বড় দলগুলোর সমর্থনে অবশেষে এই মৌসুমে আসতে যাচ্ছে পরিবর্তন। এত বড় পরিবর্তনের পেছনে সবচেয়ে বড় নিয়ামক একটিই–টাকা। চ্যাম্পিয়নস লিগের ম্যাচসংখ্যা বেড়ে হচ্ছে ১৮৯। যত বেশি ম্যাচ, তত বেশি টাকা। সেই সঙ্গে বড় দলগুলোর দেখাও হচ্ছে বেশি বেশি। সব মিলিয়ে আর্থিকভাবে লাভ হবে উয়েফারই। কিন্তু এতে করে খেলোয়াড়দের ওপর যে প্রভাব পড়ছে, সেদিকে নজর দেওয়ার সময় নেই কারও। প্রতিটি দলের ম্যাচ বাড়ছে, প্রথমবারের মতো জানুয়ারি মাসে হতে যাচ্ছে চ্যাম্পিয়নস লিগের ম্যাচ। খেলোয়াড়দের ওপর এর বাজে প্রভাব দেখা যাবে মৌসুমজুড়েই। তাতে অবশ্য উয়েফা থোড়াই কেয়ার করে। তবে যা–ই হোক না কেন, এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগ যে অন্য সববারের থেকে আলাদা হতে যাচ্ছে, তা বলা বাহুল্য।