অবসর নেওয়ার বয়সে অভিষেক, তারপরও সফল তাঁরা
কথায় আছে, সকালের সূর্যটা দেখেই পুরো দিনের পূর্বাভাস দিয়ে দেওয়া সম্ভব। কথাটা অনেকাংশেই সত্য, ক্যারিয়ারের সূচনা দেখে ভবিষ্যতের তারকা হিসেবে কাউকে আখ্যা দেওয়া নতুন কিছু নয়। শুধু ক্রিকেট কেন, দুনিয়ার সব খেলোয়াড়ই কোনো না কোনোভাবে উঠে এসেছেন বয়সভিত্তিক দল থেকে। তরুণ বয়সে তাঁদের খেলা দেখেই মুগ্ধ হয়েছেন নির্বাচকেরা, সেখান থেকে জাতীয় দলে, অতঃপর বিশ্বজয়। কিন্তু কিছু কিছু খেলোয়াড় এই বাঁধাধরা নিয়ম ছুড়ে ফেলে নিজেদের ক্যারিয়ার গড়েছেন সায়াহ্নে এসে। একজন খেলোয়াড়ের ক্যারিয়ার যে বয়সে পড়তে শুরু করে, সেই বয়সে এসেই শুরু করেন অনেকে। আজকের গল্পটা এমন কিছু খেলোয়াড়ের, যাঁরা ক্যারিয়ারের শেষ দিকে এসেই শুরু করেছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট।
মাইকেল হাসি
আদর করে সতীর্থরা তাঁকে ডাকতেন ‘মিস্টার ক্রিকেট’ নামে। কীভাবে এই ডাকনাম পেয়েছেন তিনি, তা নিয়ে বিতর্ক আছে বটে। কেউ বলেন, ক্রিকেটের প্রতি অগাধ জ্ঞান থেকেই তাঁকে এই নামে ডাকা শুরু করেন সতীর্থরা। আবার কেউ বলেন, তিনি এই ডাকনাম পেয়েছেন ইংল্যান্ডে কাউন্টি ক্রিকেট খেলতে গিয়ে। সাবেক ইংলিশ অধিনায়ক অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফের কাছ থেকে। বৃষ্টিভেজা সকাল হোক কিংবা কাঠফাটা রোদ্দুর, প্রচণ্ড বাজে কন্ডিশনেও অনুশীলন করা থেকে তাঁকে আটকাতে পারেননি কেউ। সবাই যখন ড্রেসিংরুমে বসে আয়েশ করছেন, তখন মাইক হাসি একাই অনুশীলন করতে গিয়েছেন মাঠে। তা দেখে ফ্লিনটফ ব্র্যাড হজকে বলেছিলেন, ‘ক্রিকেটকে এমনভাবে ভালোবাসতে কাউকে দেখিনি। ও আজ থেকে “মিস্টার ক্রিকেট”!’ ঘটনা যেটাই হোক না কেন, ক্রিকেটের প্রতি যে তাঁর অগাধ ভালোবাসা ছিল, তা অস্বীকার করতে পারবেন না কেউই।
অথচ এই মিস্টার ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল ২৯ বছর বয়সে। অভিষেকের পর থেকে অবসরের আগপর্যন্ত, হাসি খেলে গিয়েছেন সমানতালে। অফ ফর্ম আর মাইক হাসি যেন দুই মেরুর বাসিন্দা। মাত্র ৯ বছরের ক্যারিয়ারে রয়েছে ২২টি সেঞ্চুরি, ১৯টি টেস্টে আর এক দিনের ক্রিকেটে ৩টি। ওপেনিং থেকে ৭ নম্বর, ব্যাটিং অর্ডারের যখন যেখানে দরকার হয়েছে, হাসি হাজির হয়েছেন ত্রাতা হিসেবে। কিছুদিনের জন্য টেস্ট ক্রিকেটের ১ নম্বর ব্যাটসম্যানও ছিলেন তিনি। এমনকি টি-টোয়েন্টি যুগে যখন তাল মেলাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন তারকা খেলোয়াড়েরা, মাইক হাসি তা গ্রহণ করেছেন দুহাত মেলে। আইপিএলের ইতিহাসে, বিশেষ করে চেন্নাইয়ের ড্রেসিংরুমে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে হাসির নাম।
ডেভিড হাসি
মাইক হাসির কথা যদি আসে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে ডেভিড হাসির কথাও চলে আসতে বাধ্য। মাইকের মতো ডেভিড হাসির ক্যারিয়ারও অনেকটা একই সূত্রে গাঁথা। তবে বড় ভাই মাইকের মতো প্রভাব রেখে যেতে পারেননি অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটে। ২০০৮ সালে ৩১ বছর বয়সে অভিষেক হয় ডেভিড হাসির। অস্ট্রেলিয়ার মহিরুহদের সামনে ডেভিড হাসির ক্যারিয়ারটা একটু ফিকেই লাগে। অজিদের ব্যাগি গ্রিন ক্যাপ মাথায় সাদা জার্সিতে খেলার সৌভাগ্য হয়নি তাঁর। ৬৯ ওডিআই ম্যাচে একবার মাত্র পার করতে পেরেছেন শতরান। বল হাতেও যে খুব একটা প্রভাব ফেলতে পেরেছেন, তেমনটা নয়। তবে সব মিলিয়ে দলের জন্য একজন কার্যকর অলরাউন্ডারের ভূমিকা পালন করে গেছেন ডেভিড হাসি।
সাঈদ আজমল
সাঈদ আজমল পাকিস্তানের ইতিহাসের অন্যতম সেরা স্পিনার। আঙুলের ঘূর্ণিতে পুরো ব্যাটিং লাইনআপকে যে একা ধসিয়ে দেওয়া সম্ভব, সেটা প্রতিনিয়তই করে দেখাতেন আজমল। ২০০৮ সালে ৩১ বছর বয়সে ভারতের বিপক্ষে অভিষেক হয় আজমলের। এর পর থেকে আর কখনো পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। নিজের আঙুলের জাদুতে মুগ্ধ করেছেন সবাইকে। বিশেষ করে তাঁর ‘তিসরা’ ডেলিভারির রহস্য তো আজও অনেকের কাছে অজানা।
সাঈদ আজমলের ক্যারিয়ারে বারবার বাদ সেধেছেন আম্পায়াররা। ২০০৯ সালে তাঁর বোলিং অ্যাকশন নিয়ে অভিযোগ আনেন আম্পায়াররা। সে সময় মুক্তি পেলেও ২০১৪ সালে অনির্দিষ্টকালের জন্য আজমলকে ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ করে আইসিসি। বল করার সময় হাত ১৫ ডিগ্রির বেশি বাঁকা হয়, নিষিদ্ধ হন তিনি। সেখান থেকে ফিরে এসেও বেশি দিন আর খেলা চালিয়ে যাননি তিনি। ৩৯ বছর বয়সেই বুটজোড়া তুলে রাখেন আজমল। ২০১০ সালে ম্যাচ ফিক্সিং-কাণ্ডে উঠে এসেছিল আজমলের নামও। সালমান বাট, আমির, আসিফদের সঙ্গে তাঁকেও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল ম্যাচ ফিক্সিংয়ের। কিন্তু সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে সে সময় বেশ বাহবা পেয়েছিলেন তিনি। মাত্র ৭ বছরের ক্যারিয়ারে ৪৪৭ উইকেটের মালিক তিনি। ঠিক সময়ে ক্যারিয়ার শুরু করতে পারলে কোথায় থামতেন, সে প্রশ্নের উত্তর জানা নেই কারও!
ডেভন কনওয়ে
কনওয়ের গল্পটা অন্য দশজন খেলোয়াড়ের থেকে বেশ আলাদা। কনওয়ের জন্ম দক্ষিণ আফ্রিকায়। বাবার দেখাদেখি নাম লিখিয়েছিলেন ফুটবলে। কিন্তু ১২ বছর বয়সে খেলা পরিবর্তন করে চলে এলেন ক্রিকেটে। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকায় খুব একটা সুবিধা করতে পারছিলেন না। ২৭ বছর বয়সে সিদ্ধান্ত নিলেন, দেশ পরিবর্তন করবেন। স্ত্রীর সঙ্গে কথাবার্তা বলে সব ছেড়ে ছুড়ে চলে এলেন দ্বীপরাষ্ট্র নিউজিল্যান্ডে। সেখানে এসেই ব্যাটে ফুটল খই। একের পর এক বড় ইনিংসে নজর পড়ল ওয়েলিংটন রাজ্য দলের। সেখান থেকে জাতীয় দলে। অবশেষে ৩০ বছর বয়সে এসে নিউজিল্যান্ডের জার্সিতে স্বপ্নপূরণ হলো ডেভন কনওয়ের। বর্তমানে কিউইদের ব্যাটিং লাইনআপের সবচেয়ে বড় ভরসার নাম ডেভন কনওয়ে।
ডেভিড মালান
মালানের গল্পটাও অনেকটা কনওয়ের মতোই। ইংল্যান্ডে জন্ম হলেও খুব ছোট বয়সে দক্ষিণ আফ্রিকায় পাড়ি দিয়েছিল মালানের পরিবার। সেখানেই ক্রিকেটের সঙ্গে পরিচিত হন মালান। পরবর্তী সময়ে ইংল্যান্ড জাতীয় দলে খেলার ইচ্ছা থেকে ফিরে আসেন ইংল্যান্ডে। কিন্তু ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই অপ্রচলিত ব্যাটিং ধরনের জন্য নির্বাচকদের রাডারের বাইরেই থাকতেন তিনি। তবে ২০১৫ বিশ্বকাপের পর বদলে যায় ইংল্যান্ডের খেলার ধরন। তারপরই জাতীয় দলে ডাক পান মালান। ২০১৭ সালে ৩০ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক অভিষেক হয় মালানের। মাঠের বাইরে অ্যালেক্স হেলসের কার্যক্রম মালানের জায়গা পাকাপোক্ত করে দলে। তাঁর ওপর যে ভরসা রেখেছিলেন অধিনায়ক মরগান, সেটাই পূরণ করছেন তিনি। ৩০ ওয়ানডে ম্যাচে ১ হাজার ৪৫০ করা মালানের আছে ৬টি সেঞ্চুরি। টি-টোয়েন্টিতেও বেশ ভালো তাঁর রেকর্ড। ৬২ ম্যাচে ১৩২ স্ট্রাইক রেটে করেছেন ১ হাজার ৮৯২ রান। আছে একটি সেঞ্চুরিও।