ইংল্যান্ডের সঙ্গে সিরিজ শুরুর আগে সবাই ধরেই নিয়েছিল, ওয়ানডে সিরিজ জিতবে বাংলাদেশ, আর টি-টোয়েন্টি সিরিজ জিতবে ইংল্যান্ড। বর্তমানে ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি দুই ফরম্যাটেই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড। টি-টোয়েন্টিতে কখনোই ইংলিশদের হারাতে পারেনি টাইগাররা। তবে তিন ফরম্যাটের ক্রিকেটে ওয়ানডেতেই সবচেয়ে শক্তিশালী বাংলাদেশ দল। এক দিনের ক্রিকেটে যেকোনো দলের বিপক্ষেই জেতার সামর্থ্য আছে দলটির। ২০১৬ সালের পর ঘরের মাটিতে একটা ওয়ানডে সিরিজেও হারেনি বাংলাদেশ।
কিন্তু ওয়ানডে সিরিজ শুরু হতেই আলোচনার মোড় ঘুরিয়ে দেয় ইংল্যান্ড। যে ফরম্যাটে বাংলাদেশ সবচেয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, পরপর দুই ম্যাচে জয় তুলে নিয়ে সেই ওয়ানডে সিরিজ নিশ্চিত করে ফেলে জস বাটলারের দল। ঘরের মাটিতে ছয় বছর পর বাংলাদেশকে সিরিজ পরাজয়ের স্বাদ দেয় তারা। সর্বশেষ ২০১৬ সালে যে সিরিজ হেরেছিল বাংলাদেশ, সেটিও ছিল ইংল্যান্ডের বিপক্ষেই।
চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হওয়া সিরিজের শেষ ম্যাচটি জিতে ধবলধোলাই এড়ায় বাংলাদেশ। এরপরই আলোচনা শুরু হয়ে যায় টি-টোয়েন্টি সিরিজ নিয়ে। ঘুরেফিরে আসে সেই একই কথা, এই ফরম্যাটে বাংলাদেশ এমনিতেই দুর্বল। তার ওপর প্রতিপক্ষ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড। সিরিজ জয় হয়ে পড়ে অসম্ভবের পর্যায়েই।
টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের রেকর্ড ওয়ানডে ফরম্যাটের ঠিক বিপরীত। ঘরের মাঠে এই ফরম্যাটে বাংলাদেশের সর্বশেষ সাফল্য আসে ২০২১ সালে। মাহমুদউল্লাহর নেতৃত্বে দলটি সিরিজ জেতে অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। ২০১৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ঘরের মাঠে মোট ১২টি টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলেছে বাংলাদেশ। হেরেছে পাঁচটিতে, জিতেছে তিনটিতে। ড্র হয়েছে চারটি। বোঝাই যাচ্ছে, ক্রিকেটের সবচেয়ে ছোট ফরম্যাটে বেশ হিমশিম খাওয়া এক দল বাংলাদেশ।
২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাজে পারফরম্যান্সের পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন মাহমুদউল্লাহ। এরপরও প্রায় এক বছর মাহমুদউল্লাহ অধিনায়ক থাকলেও পারফরম্যান্সের গ্রাফে দেখা যাচ্ছিল না কোনো উন্নতি। শেষ পর্যন্ত মাহমুদউল্লাহকে সরিয়ে টি-টোয়েন্টি দলের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয় সাকিব আল হাসানের হাতে, ২০২২ বিশ্বকাপের অল্প কিছুদিন আগে।
দলে ফিরেই আস্তে আস্তে বদল আনতে শুরু করেন সাকিব। টি-টোয়েন্টি থেকে তামিম অবসর নিয়েছেন আগেই। বিশ্বকাপের কিছুদিন আগে অবসর নেন মুশফিকুর রহিম। পাশাপাশি ফর্মহীনতার কারণে জায়গা হারান মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। দলটাকে নতুন করে সাজানোর সুযোগ পান সাকিব। বিশ্বকাপে নিয়ে যান সম্পূর্ণ নতুন এক দলকে। তারুণ্যনির্ভর সেই দলটি খুব বেশি দূর যেতে না পারলেও উন্নতির ছাপ চোখে পড়ে সবারই।
বিশ্বকাপের পর বাংলাদেশ আর কোনো টি-টোয়েন্টি সিরিজ না খেললেও এ বছরের জানুয়ারিতে আয়োজিত হয় বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) নবম আসর। অনুমিতই ছিল, বিপিএলের ভালো পারফর্ম করলে সুযোগ মিলতে পারে ইংল্যান্ড সিরিজে। হয়েছেও তাই। বিপিএলে ধারাবাহিকতার পুরস্কার হিসেবে দলে সুযোগ পান রনি তালুকদার, তৌহিদ হৃদয় আর রেজাউর রহমান। পাশাপাশি আসেন শামীম হোসেনও।
টি-টোয়েন্টি দলটা যে বদলে যাচ্ছে, তা টের পাওয়া গেল প্রথম টি-টোয়েন্টিতেই।
টসে হেরে ব্যাটিংয়ে নেমে ২০ ওভারে ১৫৬ রানে থামে ইংল্যান্ডের ইনিংস। যে সূচনা করেছিলেন ফিল সল্ট আর বাটলার, তাতে রান হতে পারত আরও বেশি। কিন্তু ডেথ ওভারে তাসকিন আর হাসান মাহমুদের দুর্দান্ত বোলিংয়ে বেশি দূর যেতে পারেনি থ্রি লায়নরা।
চট্টগ্রামের পিচ অনুযায়ী ইংল্যান্ডের সংগ্রহ কম হলেও বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি ব্যাটিং আদৌ ভরসা করার মতো কি না—প্রশ্ন ছিল সেটা নিয়ে। এই ফরম্যাটে বেশির ভাগ সময়ই গতানুগতিক ব্যাটিং করতে দলটি ছিল ব্যর্থ। একের পর এক ডট বল খেলা, সিঙ্গেলস–ডাবলস নিতে ব্যর্থ হওয়ায় বেশির ভাগ সময় এই ধুঁকতে থাকে বাংলাদেশের ব্যাটিং।
ব্যাটিংয়ে নামতেই সব আশঙ্কা উড়িয়ে দেন রনি তালুকদার। আট বছর পর দলে ফিরে বুঝিয়ে দেন, কেন তাঁর ওপর আস্থা রেখেছেন নির্বাচকেরা। খুব বেশি রান করেননি, ১৪ বলে ২১। কিন্তু কখনো যে ভয়ডরহীন ব্যাটিং করতে পারেনি বাংলাদেশ, ঠিক সেই ব্যাটিংটাই দেখিয়ে যান রনি। রনি আর লিটন ফিরে গেলে ইনিংসের হাল ধরেন নাজমুল হোসেন শান্ত আর অভিষিক্ত তৌহিদ হৃদয়। রনি যেভাবে শুরু করেছিলেন, সেই ছন্দেই ব্যাটিং করেন দুজন। মার্ক উডের করা ইনিংসের সপ্তম ওভারে চার বলে শান্তর টানা চারটি চার কিংবা আদিল রশিদের বলে ডিপ মিড উইকেট দিয়ে তৌহিদ হৃদয়ের বিশাল ছক্কা—এসবই দলটির বদলে যাওয়া ব্যাটিংয়ের প্রমাণ। ১২ বল হাতে রেখে বাংলাদেশ যখন জয়ের বন্দরে, ততক্ষণে সবার কাছে পৌঁছে গেছে এই বার্তা।
তিন ম্যাচ সিরিজের শিরোপা জয়ের প্রত্যাশা নিয়ে রোববার মিরপুরে নামে বাংলাদেশ। টসে আবারও হেরে ব্যাটিংয়ে নামে ইংল্যান্ড। মিরপুরের পিচে যে লো-স্কোরিং একটা ম্যাচ হবে, সেটা সবারই জানা। সঙ্গে যোগ হয় মেহেদী হাসানের নিয়ন্ত্রিত বোলিং। ইংল্যান্ড অলআউট ১১৭ রানেই।
জয়ের খুব কাছে এসে হারার অভ্যাস বাংলাদেশের অনেক পুরোনো। পাকিস্তানের বিপক্ষে ২০১২ এশিয়া কাপের ফাইনালে ২ রানের পরাজয়, ২০১৬ বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে ৩ বলে ২ রান করতে না পারা—ক্ষতগুলো এখনো সবার মনে দগদগে। জয়ের জন্য তিন ওভারে যখন প্রয়োজন মাত্র ২১ রান, তখনই পরপর দুই ওভারে বিদায় নেন সাকিব আর আফিফ। প্রমাদ গুনতে শুরু করেন সবাই। আবারও তীরে এসে তরি ডুববে না তো?
সব শঙ্কা উড়িয়ে দেন শুরু থেকে এক প্রান্ত আগলে রাখা শান্ত আর তাসকিন। সমীকরণ ছিল ১২ বলে ১৩ রানের। ক্রিস জর্ডানের করা ১৯তম ওভারে দুজনে মিলে তোলেন ১৫ রান। বাংলাদেশকে উপহার দেন টি-টোয়েন্টিতে প্রথমবারের মতো ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিপক্ষীয় সিরিজ জয়।
২০২১ সালেও ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজে জয় পেয়েছিল বাংলাদেশ। সেই জয়ে বাংলাদেশের চেয়ে বেশির ভাগ মানুষ কৃতিত্ব দিয়েছিলেন মিরপুরের পিচকে। কিন্তু ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ জয়ের পর এই দল নিয়ে আর সমালোচনার সুযোগ নেই। যে ব্র্যান্ডের টি-টোয়েন্টি খেলার স্বপ্ন দেখত বাংলাদেশ, এই দল খেলেছে তেমনটাই। তাহলে কি টি-টোয়েন্টিতে নতুন যাত্রা শুরু করছে বাংলাদেশ? সাকিব আল হাসানের দলটি যে বিপ্লব শুরু করেছে, তাতে ধারাবাহিক হলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ এনে দেবে আরও বড় সাফল্য। এখন ধারাবাহিকতাই সবার প্রত্যাশা।