উইম্বল্ডন ফাইনাল। এক প্রান্তে স্পেনের তরুণ তারকা, অন্য প্রান্তে বর্তমান বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়। চ্যাম্পিয়নশিপ পয়েন্টের জন্য সার্ভ করছেন স্প্যানিয়ার্ড। মাঝারি মানের একটা সার্ভ, অনায়াসেই তা রিটার্ন করলেন র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে থাকা খেলোয়াড়। প্রতি–উত্তরে দুর্দান্ত ফোরহ্যান্ড, পুরো শরীরটা পেতে দিয়েও ফেরাতে পারলেন না প্রতিপক্ষ। বল আটকে গেল নেটে। স্প্যানিয়ার্ড লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে। ইংল্যান্ডের অল কোর্ট অ্যারেনায় জ্বলে উঠল হাজারো ক্যামেরার ফ্ল্যাশ। মাটিয়ে লুটিয়ে পড়া স্প্যানিয়ার্ডের বিশ্ব জয়ের গল্প ধরে রাখার চেষ্টামাত্র।
অনেক দিন ধরে টেনিস দেখা দর্শকেরা দেজা ভ্যু দেখলেন। উইম্বল্ডনের সেন্টার কোর্টে যেন আলকারাজ-জোকোভিচ নন, খেলছেন ফেদেরার আর নাদাল। ফাইনালের ঘণ্টাখানেক পর সেটা নিশ্চিত করল উইম্বল্ডন নিজেই। নাদাল আর আলকারাজের প্রথম উইম্বল্ডন জয়ের চিত্রনাট্য যেন শট টু শট রিমেক। সার্ভ, রিটার্ন, ফোরহ্যান্ড আর ব্যর্থ রিটার্ন। সেন্টার কোর্টের রাজা, বিশ্বের ১ নম্বর খেলোয়াড়কে হারিয়ে উইম্বল্ডন জয়। নাদাল আর আলকারাজের ইংল্যান্ড জয় যেন একই সূত্রে গাঁথা।
আলকারাজের উইম্বল্ডন জয়কে কিসের সঙ্গে তুলনা করা যায়? এভারেস্ট জয়? না, সেটা অনেকেই করেন। চন্দ্র জয়? নাহ, সেখানেও ১২ জনের পা পড়েছে, জয় করেছেন বহু লোক। কিন্তু উইম্বল্ডন ফাইনালে জোকোভিচকে হারানোর রেকর্ড মাত্র গুনে গুনে দুজনের। ঠিক ১০ বছর আগে ধূমকেতুর মতো উড়ে আসা ব্রিটিশ সুপারস্টার অ্যান্ডি মারে আর এই কার্লোস আলকারাজ।
আলকারাজের এই জয়কে এত বিশাল করে দেখার কারণ শুধু প্রতিপক্ষ জোকোভিচ বলে নয়। বরং গত দেড় বছরে তাঁর ধারেকাছে পৌঁছাতে পারেননি কেউ। ফর্মের দিক দিয়ে তাঁকে টেক্কা দেওয়ার মতো কেউ নেই। চোটজর্জর শরীরের বয়সটা যে ৩৬, তাঁকে দেখে মনে হওয়ার বিন্দুমাত্র জো নেই। আর রেকর্ডের কথা বলতে শুরু করলে তো আলকারাজের জয়কে রূপকথার পাতা থেকে তুলে আনা কোনো গল্প বলে মনে হবে। ১০ বছর ধরে সেন্টার কোর্টে অপরাজিত জোকোভিচ। ছয় বছর ধরে উইম্বল্ডনে। এর মধ্যে শেষ চার উইম্বল্ডনের শিরোপা উঠেছে তাঁর হাতেই। এ তো গেল উইম্বল্ডনের কথা, এই বছরের প্রথম দুটি গ্র্যান্ড স্লামও জিতেছেন কোনো বাধা ছাড়াই। টেনিস ইতিহাসের সর্বোচ্চ শিরোপাধারী ব্যক্তি এখন জোকোভিচ। তাঁর সঙ্গে টেক্কা দিতে পারাটাই অনেকের কাছে অনেক বড় কিছু।
ম্যাচের শুরুটাও হয়েছিল জোকোভিচময়। আলকারাজকে প্রতিরোধ গড়ার সুযোগই দেননি। সেট জিতে নিয়েছেন ৬-১ গেমে। জোকোভিচ ভক্ত না হলে ততক্ষণে টিভি চ্যানেল পাল্টে ফেলার কথা কমবেশি সবারই। খোদ নাদাল-ফেদেরারই ভালো অবস্থান থেকে খেই হারিয়ে ফেলেছেন, এ তো মাত্র ২০ বছর বয়সী আলকারাজ। কিন্তু আলকারাজ বড় হয়েছেন নাদালকে দেখে। হারার আগ পর্যন্ত হারার অনুমতি নেই তাঁর। পরের দুই সেটে বদলে গেল চিত্র, প্রথমটা টাইব্রেকে, পরেরটা সরাসরি। পুরোপুরি বদলে গেল ম্যাচের দৃশ্যপট। ঘণ্টা দুয়েক আগেও যে শিরোপাটা আলকারাজের কাছে অমাবস্যার চাঁদ বলে মনে হচ্ছিল, সেটাই যেন হাতের মুঠোয়। কিন্তু প্রতিপক্ষ জোকোভিচ বলে কথা। চতুর্থ সেটে কামব্যাক, পঞ্চম সেটেও লিডে। হাতের মুঠোয় থাকা শিরোপাটা যেন ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন জোকোভিচ। এমনটা অবশ্য নতুন কিছু নয়। কিন্তু আলকারাজ জোকো–বধের পণ করেই নেমেছিলেন। তাই তো জোকোভিচকে ক্ষান্ত করলেন জোকোভিচের মন্ত্রেই।
জোকোভিচকে ক্লান্ত করে তাঁর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিলেন একেকটি পয়েন্ট। হতাশ জোকোভিচ মেজাজ হারিয়েছেন, ভেঙেছেন র্যাকেট। হারাবেন না কেন? এবারের শিরোপা জিতলেই যে ছেলে-মেয়ে মিলিয়ে সবচেয়ে বেশি গ্র্যান্ড স্লাম জয়ের রেকর্ডে ভাগ বসানোর সুযোগ ছিল তাঁর। কাছে এসে আশাহত হতে কার ভালো লাগে? হতাশা গ্রাস করল রাজার শরীরে। একের পর এক ভুলে ধরাশায়ী হয়ে অবশেষে ক্ষান্ত হলেন রাজা। জোকোভিচের রিটার্ন জালে লেগে ফেরত আসতেই মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন আলকারাজ। বিশ্ব জয়ের অশ্রু তাঁর চোখে। টেনিসের সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত মঞ্চে এখন তিনি। উইম্বল্ডনজয়ী তারকাদের ছোট্ট গ্যালারিতে এখন শোভা পাবে তাঁর নাম। ব্রিটিশ রাজকুমারী কেট মিডলটনের হাত থেকে বুঝে নিলেন উইম্বল্ডনের শিরোপা। মাঠেই উপস্থিত ছিলেন স্প্যানিশ রাজা, তাঁর দিকে সামান্য ঝুঁকে যেন আশ্বাস দিলেন, কোর্টে স্প্যানিশদের রাজত্ব এত সহজে ভাঙছে না। নাদালের রেখে যাওয়া জায়গা তিনি ভালোভাবেই পূরণ করতে পারবেন।
আলকারাজ শ্রেষ্ঠ প্রশংসাটা পেয়েছেন তাঁর প্রতিপক্ষের কাছ থেকেই। জোকোভিচ নিজেই স্বীকার করে নিয়েছেন কার্লোসের শ্রেষ্ঠত্ব। ‘অনেকে বলে আলকারাজের খেলায় নাকি ফেদেরার, নাদাল আর আমার (জোকোভিচ) ছাপ রয়েছে। আমারও ঠিক তা–ই মনে হয়। আমাদের তিনজনের সেরা গুণগুলো নিয়েই আলকারাজ নিজের খেলা তৈরি করেছে।’
দর্শকদের কাছে অবশ্য আলকারাজ নাদালেরই প্রতিচ্ছবি। প্রতিচ্ছবি বললে ভুল হবে, যেন দেজা ভ্যু। ২০ বছর বয়সী স্প্যানিয়ার্ডের দিকে তাকালে মনে হয় নাদালই টাইম মেশিনে ঘুরে ফেরত এসেছেন। একজীবনে টেনিস খেলে তাঁর শখ মেটেনি, তাই এসেছেন আরেকবার উপভোগ করতে। নাদালকে দেখেই বড় হয়েছেন আলকারাজ, তাই খেলাতে নাদালের প্রভাব খুবই স্পষ্ট। খেলার সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেছেন ক্যারিয়ারের গ্রাফটাও। মাত্র ১৮ বছর বয়সে লাইমলাইটে আসা, ক্যারিয়ারের শুরুতেই ফেদেরারকে হারিয়ে হইচই ফেলে দেওয়া—সবটাই আগে দেখেছে টেনিস বিশ্ব। চেনা গল্পই নতুন করে বলছেন আলকারাজ।
চেনা গল্পের অসুবিধাটা কোথায় জানো? সমাপ্তিটা সবারই জানা। নাদালের পথ ধরে হাঁটা শুরু করেছেন মাত্র, বহুদূর যাওয়া এখনো বাকি। পথের শুরুতে চমক দেখিয়ে হারিয়ে যাওয়ার গল্প যেমন আছে, তেমনই শ্রেষ্ঠত্বের শীর্ষে ওঠার গল্পও আছে। স্বর্গের সিঁড়ি কিংবা নরকের দুয়ার—দুটো পথই খোলা আলকারাজের সামনে। পথটা তাই বেছে নিতে হবে সাবধানে।