বর্তমানে পৃথিবীর অন্যতম সেরা অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার বলা হয় কেভিন ডি ব্রুইনাকে। বেলজিয়ামের ডনগ্রেনে জন্ম নেয়া এই ফুটবলার খেলেন ইংলিশ ক্লাব ম্যানচেস্টার সিটিতে। পাশাপাশি তিনি বেলজিয়াম জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়কও। ক্রীড়াবিষয়ক ওয়েবসাইট দ্য প্লেয়ার্স ট্রিবিউনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে ম্যানসিটির হয়ে চারবার প্রিমিয়ার লিগ জেতা এই তারকা কথা বলেছেন নিজের ব্যক্তিগত আর পেশাদার জীবন নিয়ে। সেখান থেকেই কিছু অংশ অনুবাদ করে দেওয়া হলো তোমাদের জন্য।
ছোটবেলা থেকেই খুব শান্ত আর ধীরস্থির প্রকৃতির ছিলাম আমি। বেশির ভাগ সময়ই চুপচাপ থাকতাম। এ জন্য আমার কাছের বন্ধুও খুব কম। আমি কথা বলতাম শুধু মাঠে, ফুটবল দিয়ে। মাঠের বাইরে, আবারো হয়ে যেতাম আগের মতো, ইন্ট্রোভার্টদের (অন্তর্মুখী) ক্ষেত্রে যা হয় আরকি!
এই চুপচাপ থাকাটা যে অনেকে পছন্দ করত না, সেটা বুঝতে বেশ কিছুদিন সময় লেগেছে আমার। এটাই স্বাভাবিক, কারণ, আমি অনেক ছোট ছিলাম।
জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্তটি আমাকে নিতে হয়েছিল ১৪ বছর বয়সে। আমার জন্ম বেলজিয়ামের ডনগ্রেনে। ফুটবল ছিল সবচেয়ে পছন্দের খেলা, খেলতামও ভালো। ওই সময়টায় জেঙ্ক থেকে একটা প্রস্তাব আসে। ওদের ফুটবল একাডেমিতে ভর্তির হওয়ার সুযোগ পাই আমি। বেলজিয়ামের আরেক প্রান্তে ছিল শহরটি, ডনগ্রেন থেকে প্রতিদিন যাওয়া–আসা করার উপায় নেই। ফলে মা–বাবা একটু ইতস্তত করছিলেন। কিন্তু তাঁদের জোর দিয়ে বলি, আমি জেঙ্কেই যেতে চাই।
সমস্যা দেখা দিল অন্য জায়গায়।
নিজের এলাকাতেই আমি তেমন একটা কথা বলতাম না। আর জেঙ্কে তো আমি নতুন, কথা বলতাম ডনগ্রেনের আঞ্চলিক ভাষায়। অন্য ছেলেদের কাছে যা ছিল হাস্যকর। ভীষণ একাকিত্বে ভোগা শুরু করলাম। বাকিদের সঙ্গে মেশার জন্য সময়ও পেতাম না তেমন। কারণ, সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বাড়িতে চলে যেতাম আমি।
তোমরা হয়তো ভাবছ, বাড়িতেই তো ভালো ছিলাম। শুধু শুধু ওই বয়সে এত কঠিন জীবন বেছে নিলাম কেন?
উত্তর একটাই, ফুটবল। মাঠে নামলেই সবকিছু ভুলে যেতাম। যতক্ষণ ফুটবল খেলতাম, ভুলে যেতাম কোথায় আছি, কেমন আছি। অর্থহীন হয়ে যেত বাকি সব। বলতে পারো, ফুটবল খেলা আমার কাছে নেশার মতো। সত্যি বলতে, ফুটবলই আমার জীবন।
জেঙ্কে প্রথম বছর আমি ছিলাম বোর্ডিং স্কুলে। খুব ছোট একটা রুম ছিল, আসবাবপত্র বলতে একটা বিছানা আর একটা টেবিল। পরের বছর ক্লাবের মাধ্যমে একটা পরিবার আমাকে দত্তক নেয়। মোট তিনজন একসঙ্গে সেই বাসায় উঠি। বোর্ডিং স্কুলের সেই বদ্ধ ঘর ছাড়তে পেরে একটু স্বস্তি পাই।
নতুন বাসায়ও বেশির ভাগ সময় আমি নিজের মতোই থাকতাম। স্কুল আর ফুটবল মিলিয়ে আমার সময়টা বেশ ভালোই কাটছিল। এক বছর চলে যায় প্রায় নির্বিঘ্নই। বছর শেষে স্কুল বেশ কিছুদিনের জন্য ছুটি দিল। বাড়িতে যাওয়ার আগে দত্তক নেওয়া মা–বাবা বললেন, ছুটির পর আবার দেখা হবে। খুশিমনে বাড়ির পথ ধরি আমি।
কিন্তু খুশিটা বেশিক্ষণ থাকেনি।
বাসায় এসে দেখি, আমার মা কাঁদছেন। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করায় মা বললেন, ‘তোমাকে যাঁরা দত্তক নিয়েছিলেন, তাঁরা তোমাকে রাখতে চাচ্ছেন না।’
আমি আকাশ থেকে পড়লাম। তিন ঘণ্টা আগেই তো সব ঠিক ছিল, এর মধ্যে আবার কী হলো!
মা বললেন, ‘তুমি খুব চুপচাপ। তেমন কথা বলো না। এ জন্যই তোমাকে নিতে চাচ্ছেন না।’
আমি হতভম্ব হয়ে বসে থাকলাম। নিজের মতো থাকার কারণে আমাকে বের করে দেওয়া হয়েছে, এটা মেনে নিতে পারছিলাম না।
ক্যারিয়ারের ওই সময় এটা ছিল বিশাল ধাক্কা। আমি তখনো খুব পরিচিত কোনো ফুটবলার নই, ফলে ক্লাব থেকে নতুন কোনো দত্তক পরিবারের জন্য টাকা দিতে চাইল না। আমাকে ফিরে যেত হলো সেই আগের জায়গায়, বোর্ডিংয়ের সেই ছোট্ট ঘরে।
গ্রীষ্মের ছুটির পর আমি জেঙ্কে ফিরে যাই। সবেমাত্র ক্লাবের দ্বিতীয় সারির দলে ঢুকেছি। বিশাল ওই ক্লাবের কাছে আমি ছিলাম খুবই নগণ্য। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, দুই মাসের মধ্যে আমাকে জেঙ্কের মূল দলে ঢুকতে হবে, যেভাবেই হোক।
স্পষ্ট মনে আছে, ঠিক কোন সময়টায় বদলে যায় আমার জীবন।
শুক্রবার রাত। ম্যাচের শুরুর একাদশে আমি ছিলাম না, বদলি হিসেবে নামলাম দ্বিতীয়ার্ধ্বে। মুখে কিছু না বললেও ভেতরে ভেতরে ফুঁসছিলাম। মাঠে নামার পর আর কিছুই মনে ছিল না। মাথায় ঘুরছিল একটাই কথা—
আমাকে বের করে দিয়েছে, কারণ আমি নিজের মতো ছিলাম।
প্রথম গোল।
‘ওরা তোমাকে আর রাখতে চায় না।’
দ্বিতীয় গোল।
‘তুমি অনেক চুপচাপ।’
তৃতীয় গোল।
‘তোমাকে সামলানো কঠিন।’
চতুর্থ গোল।
‘তুমি যেমন, তেমনভাবে থাকার জন্যই তোমাকে বের করে দিয়েছে।’
পঞ্চম গোল।
হ্যাঁ, সে রাতে পরপর পাঁচটা গোল করি আমি, ম্যাচের অর্ধেকটা সময় খেলে। সঙ্গে সঙ্গেই যেন বদলে গেল সবকিছু। দুই মাস ধরেছিলাম, এরও কম সময়ে সুযোগ পেয়ে যাই মূল দলে। বোর্ডিং ছেড়ে ক্লাব থেকে আবারো সুযোগ করে দেওয়া হয় দত্তক পরিবারের সঙ্গে থাকার।
ফুটবলে একটা ব্যাপার খুবই মজার। যখন আপনি ভালো খেলবেন, দেখবেন আশপাশের সবার আচরণ কেমন বদলে যাচ্ছে। যাঁরা আমাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছিলেন, আমি মূল দলে চলে আসার পর আমাকে আবার দত্তক নিতে চাইলেন তাঁরাই।
আমি সরাসরি ‘না’ বলে দিয়েছিলাম। যাঁরা খারাপ সময়ে আমাকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন, তাঁদের সঙ্গে থাকার প্রশ্নই ওঠে না।
হয়তো ভাবছ, এর পর থেকে হয়তো আমার জীবন খুবই সহজ হয়ে যায়। বাস্তবে এমনটা ঘটেনি মোটেও। জেঙ্ক থেকে চেলসির সঙ্গে চুক্তি হয় আমার। চেলসি আমাকে প্রথম মৌসুমে জার্মান ক্লাব ওয়ের্ডার ব্রেমেনে পাঠিয়ে দেয়, ধারে। দারুণ একটা মৌসুম কাটাই সেখানে। পরের বছর আরও বেশ কয়েকটি জার্মান ক্লাব আমার প্রতি আগ্রহ দেখায়। ভাবলাম, চেলসির মূল দলে হয়তো খেলতে পারব না, জার্মানিতেই আমার যাওয়া উচিত।
তখন চেলসির কোচ ছিলেন হোসে মরিনহো। তিনি ঘটা করেই একদিন জানালেন, ‘তুমি থাকছ। তোমাকে দলে চাই আমি।’
ফলে ক্লাব ছাড়ার জন্য আর পীড়াপিড়ি করলাম না।
মোট চার ম্যাচ খেলার সুযোগ পাই আমি। খুব যে দারুণ খেলেছি, তা নয়। তবে আমার কাছে মনে হয়েছিল, আমি মোটামুটি ভালোই করেছি। কিন্তু এরপর দলে আর সুযোগই পেলাম না। কেন সুযোগ পাচ্ছি না, এ নিয়ে পেলাম না কোনো ব্যাখ্যাও। হুট করেই ক্লাবে যেন অদৃশ্য হয়ে গেলাম।
এই সময়ে যদি আমার সঙ্গে এমনটা ঘটত, তাহলে খুব সহজেই মানিয়ে নিতাম। নিজের মতো অনুশীলন করতাম, ফিট থাকতাম। চেলসিতে যখন খেলতাম, আমার বয়স মাত্র ২১। স্বাভাবিকভাবেই নিজের খেয়াল নিতে শিখিনি তখনো। ফলে কিছুদিন পর লিগ কাপে সুইনডন টাউনের বিপক্ষে যখন খেলতে নামলাম, বুঝতে পারি যে আমার চেলসি অধ্যায় শেষ।
পরের মৌসুমে যোগ দিলাম জার্মান ক্লাব উলফসবার্গে। আবার সেই পুরোনো জেদ ফিরে আসে, দত্তক মা–বাবা আমাকে বের করে দেওয়ার পর যেমনটা হয়েছিল, ঠিক তেমন। বেশ ভালো খেলেছিলাম সে বছর, ৫১ ম্যাচে ১৫ গোল আর ২৩ অ্যাসিস্ট।
আবারও বড় ক্লাবগুলো আগ্রহ দেখানো শুরু করে। পিএসজি, ম্যানসিটি, বায়ার্ন মিউনিখ—সবাই।
শেষ পর্যন্ত যাই ম্যানচেস্টার সিটিতে। এর পেছনে বড় প্রভাব ছিল ভিনসেন্ট কোম্পানির (বেলজিয়াম ফুটবল দলের তৎকালীন অধিনায়ক)। তারা প্রতিদিন আমাকে টেক্সট করে সিটিতে আসতে বলত। দিন শেষে আমার জন্য ভালোই হয়েছে, বিশেষ করে পেপ গার্দিওলা আসার পর।
ফুটবল নিয়ে গার্দিওলার চিন্তা অনেকটা আমার মতোই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমার চেয়ে গাঢ় আর তীব্র। সব সময় খেলাটা নিয়ে তিনি এত চিন্তিত থাকেন, না দেখলে বোঝার উপায় নেই। আমাকে প্রথম দেখায় তিনি বলেন, ‘কেভিন, শোনো। খুব সহজেই তুমি পৃথিবীর সেরা পাঁচ ফুটবলারদের মধ্যে একজন হতে পারবে। খুবই সহজে।’
হতভম্ব হয়ে ভাবলাম, লোকটা বলে কী! কিন্তু চোখেমুখে এমন বিশ্বাস নিয়ে তিনি কথাটা বলেছিলেন, নিজেও বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম। এরপরের ঘটনা তো সবারই জানা।
ছোট একটা গল্প দিয়ে শেষ করি।
মিশেল (আমার স্ত্রী) মাঝেমাঝেই বলে, আমার মধ্যে কোনো সমস্যা আছে। প্রায় সাত বছর ধরে একসঙ্গে থাকি আমরা। কোনো দিনই আমাকে কাঁদতে দেখেনি ও। এমনকি ঘনিষ্ঠ কারও মৃত্যুসংবাদ শুনলেও আমার কান্না আসে না।
কিছুদিন পরই, ফুলহ্যামের বিপক্ষে খেলতে নেমে চোট পাই লিগামেন্টে। চিকিৎসক জানান, আমাকে বেশ কিছুদিন পুরোদমে বিছানায় থাকতে হবে। পায়ে প্লাস্টার করা, নিজে নিজে জামা পরারও উপায় নেই। এর আগের দিন আবার আমাদের দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম হয়েছে। চোটে পড়ার জন্য এর চেয়ে খারাপ সময় আর হতেই পারে না।
হাসপাতাল থেকে মিশেলকে ভিডিও কল দিলাম, চোটের খবর জানানোর জন্য।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘শরীর কেমন তোমার? আমাদের ছেলে কেমন আছে?’
কিছুক্ষণ চুপ থেকে মিশেল বলল, ‘সব ঠিকঠাক। কিন্তু তুমি কি কাঁদছ?’
নিজের অজান্তেই হয়তো চোখে পানি চলে এসেছিল। বললাম, ‘হাঁটুতে আবার চোট পেয়েছি। তোমাকে কিছুদিন তিনটা বাচ্চার যত্ন নিতে হবে।’
এরপরই কান্নায় ভেঙে পড়ি। কিছুতেই থামাতে পারিনি নিজেকে। কোনো কথা বলতে পারছিলাম না, শুধু ফোঁপাচ্ছিলাম বোকার মতো।
চোখভরা অবিশ্বাস নিয়ে মিশেল আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। শুনতে পাচ্ছিলাম ওর চিৎকার, ‘কেভিন!! আমাদের বিয়ের দিনও তোমার কান্না আসেনি। বাচ্চা হওয়ার পরও না! এক বাচ্চার তো জন্মই হয়েছে গতকাল…’
বিয়ে, মৃত্যু কিংবা বাবা হওয়া—এগুলো আমার কাছে কিছুই না।
কিন্তু ফুটবলই আমার জীবন। ফুটবল ছাড়া থাকতে পারব না কখনোই।
ফুটবলকে আমি এতটাই ভালোবাসি।