বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে জেন জি কতটা আগ্রহী

বিশ্বকাপ ফুটবলের মৌসুমে বর্ণিল হয়ে ওঠে বাংলাদেশছবি: আশরাফুল আলম

যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া আবাহনীর সমর্থক না মোহামেডানের? প্রশ্নটা এই প্রজন্মের কাছে বেশ খানিকটা অবান্তরই। বিশেষ করে যাঁদের জন্ম ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে, যাঁদের আমরা ‘জেন জি’ বলে ডাকি, তাঁদের কাছে এই প্রশ্ন রীতিমতো অবান্তরই। হবে না–ইবা কেন, এই প্রজন্ম হয়তো আবাহনী–মোহামেডান দ্বৈরথ নিয়ে প্রায় কিছুই জানে না। দেশের এই দুই দলের ফুটবলযুদ্ধ কীভাবে গোটা দেশকে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলত, কীভাবে এই দুই দলের সমর্থকেরা ম্যাচের সময় যুদ্ধংদেহী হয়ে উঠতেন, সে সম্পর্কে তাঁদের সেভাবে ধারণা থাকারই কথা নয়। আবাহনী–মোহামেডানের দ্বৈরথের রোমাঞ্চ জেন জি প্রজন্মের কাছে বড়দের স্মৃতি রোমন্থন ছাড়া আর কিছুই নয়। জুলাই–আগস্টের রক্তাক্ত ছাত্র–জনতার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া এই জেন জি প্রজন্ম যখন নতুন বাংলাদেশ গড়ছে, সেই প্রজন্মেরই এক প্রতিনিধি যখন দেশের ক্রীড়াঙ্গনের প্রধান ব্যক্তি, তখন প্রসঙ্গটা আসেই। আবাহনী–মোহামেডান কিংবা দেশের ফুটবল তাদের কতটা টানে!

প্রশ্নটা অন্যভাবেও করা যায়। এই জেন জি যেন বাংলাদেশের ফুটবল, দেশের ক্লাব ফুটবল, প্রিমিয়ার লিগ, ক্লাব সংস্কৃতি নিয়ে ভাবে, খোঁজখবর রাখে, সে ব্যাপারে আমরাই–বা কতটা কী করেছি। এই প্রজন্ম খেলাপাগল, সেটি নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। রাত জেগে তারা ইউরোপীয় ফুটবল লিগগুলোর খেলা দেখে। এই প্রজন্মের ফুটবলপ্রিয় প্রত্যেকেই ইউরোপের কোনো না কোনো ক্লাবের সমর্থক। কেউ রিয়াল মাদ্রিদ, কেউবা বার্সেলোনা। কারও কারও পছন্দ লিভারপুল, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড বা ম্যানচেস্টার সিটি। এই প্রজন্মকে ইউরো কিংবা কোপা আমেরিকা উদ্বেলিত করে। বিশ্বকাপ তাদের কাছে দারুণ এক উৎসব। আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিল–ভক্ত হিসেবে এই প্রজন্মের ফুটবল–উন্মাদনার সাক্ষী সারা দুনিয়া। কিন্তু দেশের ফুটবলের প্রসঙ্গে এই প্রজন্ম একটু যেন নির্লিপ্ত। তারা এ দেশের ফুটবল নিয়ে সেভাবে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারেনি। বছরের পর বছর প্রিমিয়ার লিগ অনুষ্ঠিত হচ্ছে, কিন্তু তাদের কাছে সেই লিগের খেলার খবর পৌঁছায় না। আবাহনী–মোহামেডান তো বটেই, দেশের ফুটবল লিগে কটি ক্লাব খেলে, সেই তথ্যও সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ রাখে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।

আরও পড়ুন
বাংলাদেশ অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া
বাফুফে

কেন এই অনাগ্রহ, কেন এই নির্লিপ্ততা? আগেই বলা হয়েছে, এটির দায়ভার আমাদেরই। আবাহনী, মোহামেডান দেশের শীর্ষ দুই ক্লাব হিসেবে নতুন প্রজন্মকে কতটা আকৃষ্ট করতে পেরেছে? নিজেদের প্রতি আগ্রহ তৈরি করতে, এই দুই ক্লাবের আদৌ কি কোনো বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে? অতীতের চর্বিত–চর্বণ আর আবেগঘন স্মৃতিচারণা জেন জিকে টানে না, এটা প্রমাণিত। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ বা অন্যান্য ঘরোয়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় ঠিকই, কিন্তু কোনো প্রাণ নেই, এই ঘরোয়া লিগের ম্যাচগুলোকে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন, ভালো ভেন্যু, মাঠ, টেলিভিশন সম্প্রচার—এসব নিয়ে ভাবনা নেই কারোরই। হাতে গোনা দু–একটি ক্লাব ছাড়া আর কারোরই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কোনো উপস্থিতি নেই। ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম যে প্রজন্মের দৈনন্দিন জীবনাচরণের মঞ্চ, সেখানে বাংলাদেশের ফুটবল বলতে গেলে একেবারেই অনুপস্থিত। এই প্রজন্ম টেলিভিশন–নির্ভর নয়, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে অর্থ খরচ করেই এরা কনটেন্ট উপভোগ করে। এই প্রজন্ম নিয়মিত নেটফ্লিক্স, অ্যামাজনের গ্রাহক, অন্যান্য ওটিটি প্ল্যাটফর্মে এরা পছন্দের কনটেন্ট খুঁজে বের করে। কিন্তু এই দেশে দেখুন, ডিজিটাল বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দেশের ফুটবলকে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ খুব সীমিত। ফুটবল কীভাবে পৌঁছাবে এই প্রজন্মের কাছে?

ঢাকা প্রিমিয়ার ফুটবল লিগ একসময় জনপ্রিয় ছিল। টেলিভিশনে একটি–দুটি ম্যাচ সম্প্রচারিত হতো, কিন্তু সেটি যথেষ্ট ভালো অর্থমূল্যেই বিক্রি হতো। শুধু ম্যাচের দিন টিকিটই বিক্রি হতো লাখ লাখ টাকা।

এই মুহূর্তে বসুন্ধরা কিংস আর আবাহনী লিমিটেডের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উপস্থিতি আছে। কিন্তু কার্যক্রম বেশ সীমিত। আবাহনী, মোহামেডান, ব্রাদার্সের মতো ক্লাবগুলোর জন্য একটা সময় মানুষের আবেগ–অনুভূতির কমতি ছিল না। ঘরোয়া ফুটবলে ক্লাবগুলো যখন একে অন্যের মুখোমুখি হতো, ফুটবলপ্রেমী সমর্থকদের আবেগ উছলে পড়ত। অনুশীলনের সময়ও সমর্থকেরা ভিড় করতেন প্রিয় দলের মাঠে। আবেগ অনেক সময় সহিংসতায় রূপ নিত। সময়ের ব্যবধানে সেই আবেগ এখন অতীত। কিন্তু এটি তো হওয়ার কথা ছিল না। দুনিয়ার কোনো ফুটবল খেলিয়ে দেশেই এমনটি হয়নি। ফুটবল মাঠের দ্বৈরথ প্রজন্মান্তরে আবেগ ধরে রেখেছে। কিন্তু বাংলাদেশে সেই চেষ্টাটাই করা হয়নি।

আরও পড়ুন

এটা ঠিক, ইউরোপীয় ফুটবলের মানের সঙ্গে আমাদের ফুটবলের মানের তুলনা করে লাভ নেই। আন্তর্জাতিক ফুটবলে তেমন সাফল্য নেই বাংলাদেশের। অবশ্য এটি একটি কারণ হলেও বড় কারণ নয়। যখন ফুটবল নিয়ে এ দেশের মানুষের আবেগ ছিল, তখনো বাংলাদেশের ফুটবল খুব সফল ছিল না। আসলে টেলিভিশনে ইউরোপীয় ফুটবল দেখাটা সহজ হয়ে যাওয়ার পর থেকেই এ দেশের ফুটবলপ্রেমীরা খেলাটা থেকে আস্তে আস্তে মুখ ফিরিয়ে নেন। বাংলাদেশের ক্রিকেটে যেমন আন্তর্জাতিক তারকাদের সঙ্গে তুলনা করার মতো কিছু তারকা আছেন, ফুটবলে তেমন নাম সেভাবে দেখা যায় না! মেসি–রোনালদো–হল্যান্ড–এমবাপ্পেরাই তাই আস্তে আস্তে ঢুকে পড়েছেন এ দেশের ফুটবলাপ্রেমী মানুষের ঘরে। সেটি অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু বিশ্বখ্যাত তারকাদের সঙ্গে, নিজ দেশের কাউকে নিয়ে উন্মাদনা হবে না, এটা কেমন কথা। জামাল ভূঁইয়া গত এক দশকে নিজেকে তারকা হিসেবে গড়েছেন, এসেছেন শেখ মোরছালিন। কিন্তু আর কটা নাম নিতে পারবেন এই প্রজন্মের ফুটবল–ভক্তরা?

প্রতিভাবান ফুটবলার শেখ মোরছালিন
ছবি: শামসুল হক

বিশ্বব্যাপী ফুটবল একটি বিরাট পণ্য। কিন্তু এই পণ্য তো বিপণনযোগ্য করে তুলতে হবে। আপনি পণ্য নিয়ে ভোক্তার কাছে না গেলে ভোক্তা কেন আগ্রহী হবেন? এ মুহূর্তে দেশের ফুটবলের সবচেয়ে বড় ভোক্তা যাঁরা, সেই নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিদের কাছে ফুটবলকে কোনোভাবেই নিয়ে যাওয়া যায়নি। দেশে প্রিমিয়ার লিগ বা ঘরোয়া ফুটবলকে নিয়ে উদ্ভাবনী কোনো ভাবনা ভাবেননি বাংলাদেশের ফুটবল প্রশাসকেরা। এই ঘরোয়া ফুটবল যেন হতে হবে, তাই হওয়া। কিন্তু এটিকে মোড়কজাত করার ব্যাপারে প্রশাসকদের উদাসীনতার কারণে আগ্রহহীন দেশের ঘরোয়া ফুটবল নিয়ে। ক্রীড়া পণ্যের বিপণন, কীভাবে করতে হয়, সেটির বড় উদাহরণ হতে পারে ভারতের আইপিএল। ১৫ বছরে এই আইপিএলকে ভারতের ক্রিকেট প্রশাসকেরা দুনিয়ার অন্যতম জনপ্রিয়, টেলিভিশন সম্প্রচারিত ক্রীড়া ইভেন্টে পরিণত করেছেন। জনপ্রিয়তার সঙ্গে নিয়ে আসে অর্থও। আইপিএল কিন্তু এই প্রজন্মের কাছে বিপণনের মাধ্যমেই বিশ্বের অন্যতম সেরা অর্থকরি ক্রীড়া আসর।

আরও পড়ুন

ঢাকা প্রিমিয়ার ফুটবল লিগ একসময় জনপ্রিয় ছিল। টেলিভিশনে একটি–দুটি ম্যাচ সম্প্রচারিত হতো, কিন্তু সেটি যথেষ্ট ভালো অর্থমূল্যেই বিক্রি হতো। শুধু ম্যাচের দিন টিকিটই বিক্রি হতো লাখ লাখ টাকা। আশি–নব্বইয়ের দশকে ঢাকা লিগের টিকিট বিক্রির গেটমানি ছিল দেশের ক্লাবগুলোর আয়ের অন্যতম উৎস। কিন্তু এখন এই পেশাদার যুগে, আশপাশে এত উদাহরণ থাকা সত্ত্বেও সবকিছুই হারিয়ে গেছে। মোহামেডান, আবাহনী কিংবা অন্য ক্লাবগুলো কি আগ্রহ ধরে রাখতে কোনো উদ্যোগ নিয়েছে কখনো? উত্তর হচ্ছে, না। নতুন প্রজন্মকে কাছে টানার কোনো উদ্যোগই নেই তাদের।

দুনিয়ার সব ফুটবল ক্লাবই ভার্চ্যুয়াল জগতে সক্রিয়। শুধু সক্রিয়ই নয়, এই ডিজিটাল দুনিয়া ক্লাবগুলোর অর্থ আয়ের উৎসও। সমর্থকদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের এমন সুযোগ হাতছাড়া করেনি কেউই। বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদ, লিভারপুল, পিএসজির মতো ক্লাবগুলোর ফেসবুক, টুইটার পেজ হচ্ছে তথ্যের আধার। বিভিন্ন ধরনের পোস্টে তারা প্রতিনিয়ত যোগাযোগ স্থাপন করে চলেছে তাদের সমর্থকদের সঙ্গে। ম্যাচের তথ্য, বিশ্লেষণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ইস্যু আলোচিত হয় অফিশিয়াল ফেসবুক, টুইটার পেজে। সর্বশেষ ম্যাচের ভিডিও, ছবি—কী নেই এসব পেজে। পেজগুলোর ফলোয়ার সংখ্য ছড়িয়ে আছে সারা পৃথিবীতে। এসব পেজে লাইক দিয়ে ক্লাবের সঙ্গে একধরনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক অনুভব করেন সবাই। ইউরোপের ধনী ক্লাবগুলোর কথা বাদ দিন, আমাদের আশপাশের দেশগুলো, যেমন ভারত, মালদ্বীপ, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াতেও বড় বড় ক্লাব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয়। কলকাতার ইস্ট বেঙ্গল, মোহনবাগানের ফেসবুক, ইউটিউব পেজ ভেরিফায়েড। লাখ লাখ ফলোয়ার এসব পেজে লাইক দিয়ে প্রিয় ক্লাবের প্রতি নিজেদের ভালোবাসা প্রকাশ করছেন।

‘ফ্যানবেজ’ যেটিকে বলে, দেশের ফুটবলে সেটি হারিয়ে গেছে। ফুটবলকে আবারও মানুষের হৃদয়ে ফিরিয়ে আনতে, আলোচনার বিষয় বানাতে এই ফ্যানবেজ তৈরির উদ্যোগের বিকল্প নেই। সেই উদ্যোগ নিতে হবে ১২ থেকে ২৭ বছর বয়সী ফুটবলপ্রেমীদের সঙ্গে নিয়েই।

‘জেন জি’কে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে দেশের ফুটবলকে।

আরও পড়ুন