খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, পুরো ফুটবল–বিশ্ব উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে ছিল সৌদি আরবের দিকে। এবারের গ্রীষ্মকালীন দলবদল মৌসুমের পুরোটাতেই একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল সৌদি আরবের। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে দিয়ে শুরু। এরপর একে একে ফুটবল–বিশ্বের হেভিওয়েট তারকারা যোগ দিয়েছেন সৌদি প্রো লিগে। সৌদি লিগের এমন উত্থান দেখে সবার মনে একটা প্রশ্ন উঁকি দিয়েছিল, ফুটবলের ভবিষ্যৎ কি তবে সৌদি আরব?
সে প্রশ্নের উত্তর অনেকেই ছেড়ে দিয়েছিল সময়ের ওপর। অন্যদের তুলনায় সৌদি এগিয়েছিল সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়েই। নিজেদের দেশের ফুটবলকে উন্নত করতে হলে দরকার নিজেদের লিগকে উন্নত করা। তাই তো ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগকে টক্কর দিতে সেরা খেলোয়াড়দের দলে ভেড়ানো শুরু করে সৌদি আরব। মূল লক্ষ্য অবশ্য ছিল, বিশ্বকাপের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করা। সৌদি আরবকে বিশ্ববাসীর সামনে ফুটবল জায়ান্ট করে তোলা। সে লক্ষ্যে যত টাকা লাগে, ঢালতে বিন্দুমাত্র আপত্তি ছিল না তাদের।
শুরুটাও ছিল বেশ দারুণ। কাতার বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে লাইমলাইটে আসা। অতঃপর বিশ্বকাপের এক দিন আগে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে বরখাস্ত হওয়া রোনালদোকে দলে ভেড়ানো। এক কথায় বিশ্বকাপের সময় যত জোড়া চোখ টিভি পর্দায় ছিল, তাদের সবার চোখ অন্তত একবারের জন্য হলেও আটকে গিয়েছিল সৌদির রাডারে। ছয় মাসের মধ্যেই সৌদি ক্লাবগুলোর নাম একে একে মুখস্থ হয়ে গেল সমর্থকদের। রিয়াল, বার্সা, ইউনাইটেড, লিভারপুলের সঙ্গে এখন পাল্লা দেয় আল নাসর, আল হিলাল, আল ইতিহাদ, আল আহলি নামগুলো।
কাদের টানেনি সৌদি লিগ? বয়সের ভাড়ে নিজেদের হারিয়ে ফেলা খেলোয়াড়রা যেমন ছিলেন, তেমনই ছিলেন নতুন তারকারাও। রোনালদো, বেনজেমা, কান্তে, ফিরমিনো, হেন্ডারসনরা যেমন ছিলেন ক্যারিয়ারের শেষপ্রান্তে, তেমনই নেইমার, লাপোর্তেরা ছিলেন নিজেদের সেরা সময়ে। ইউরোপের হেভিওয়েট তারকাদের ভিড়িয়ে বেশ খুশিই ছিলেন সৌদি লিগের হর্তাকর্তারা। কিন্তু কে জানত, ছয় মাসেই সেই হাসি ফুরিয়ে যাবে হর্তাকর্তাদের মুখ থেকে?
সমস্যা শুধু খেলোয়াড়দের নয়, তাঁদের স্ত্রী-সন্তানদেরও। সম্প্রতি আলজেরিয়ান ফুটবলার রিয়াদ মাহরেজের সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর কথোপকথনের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। সেখানে দেখা যায়, তাঁর স্ত্রী তাঁদের সৌদি গমন, ফুটবল আর লাইফস্টাইল নিয়ে বিশাল আলোচনায় বসেছেন। দিন শেষে ঠিকই আল আহলিতে যোগ দিয়েছেন মাহরেজ। স্ত্রী-সন্তান ম্যানচেস্টারে থাকলেও তিনি থাকছে সৌদি আরবে।
ঠিক যতটা তর্জন–গর্জন নিয়ে শুরু হয়েছিল সৌদির আগ্রাসন, ঠিক সেভাবেই যেন নিভে যাচ্ছে তাদের আবেদন। সৌদি আরবে পা ফেলতে না ফেলতেই বিরক্ত হয়ে উঠেছেন খেলোয়াড়েরা। কারও সমস্যা হচ্ছে সৌদিতে মানিয়ে চলতে, কারও আবার বনিবনা হচ্ছে না পরিবারের সঙ্গে। কারও কাছে সৌদির বিশাল বেতনকে মনে হচ্ছে বোঝা। সৌদি আরবকে নিয়ে এমন অভিযোগ দু–একজনের নয়, ইউরোপ থেকে পারি জমানো অধিকাংশ খেলোয়াড়ের অভিমতই একই রকম।
করিম বেনজেমার কথাই ধরা যাক। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পর সৌদি আরবের সবচেয়ে বড় জয় ছিল করিম বেনজেমাকে ভেড়ানো। একে তো ব্যালন ডি’অরজয়ী খেলোয়াড়, তার ওপর মুসলিম—সব মিলে বেনজেমা ছিলেন সৌদির স্বপ্নের খেলোয়াড়। খেলোয়াড়ি জীবনে শান্তশিষ্ট নিরীহ হিসেবে পরিচিত বেনজেমাই রাতারাতি বদলে গেলেন সৌদি আরবে এসে। কোচের সঙ্গে নিয়মিত গন্ডগোল, খেলায় মনোযোগ না দেওয়া, ট্রেনিং বাদ দিয়ে উধাও হয়ে যাওয়া, ক্লাবের বেঁধে দেওয়া সময়সূচির মধ্যে ট্রেনিংয়ে যোগ না দেওয়া—আল ইতিহাদের বেনজেমার সঙ্গে রিয়াল মাদ্রিদের বেনজেমার যোজন যোজন তফাৎ। বেনজেমার এমন ব্যবহারের অবশ্য কারণও ছিল। এই শীতকালীন দলবদলের মৌসুমে বেনজেমার জন্য বেশ বড় দুটি ক্লাব যোগাযোগ করেছিল। বেনজেমার সামনে সুযোগ ছিল সরাসরি চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলার। কিন্তু নিজেদের দামি রত্নকে কি এভাবে যেতে দেওয়া যায়? দলবদলের ব্যাপারে বারবার ক্লাবকে জানালেও ক্লাব ছিল নির্বাক। একপ্রকার জোর করেই বেনজেমাকে সৌদি আরবে আটকে রাখেন আল ইতিহাদের ক্লাব কর্তারা। এর প্রভাব পড়েছে মাঠে। প্রায় দেড় মাস ট্রেনিং থেকে দূরে ছিলেন বেনজেমা। এমনকি ইনস্টাগ্রাম থেকে ফুটবলবিষয়ক সব পোস্টও ডিলিট করে দিয়েছেন তিনি। যদিও এই মাসের শুরু থেকে আবারও মাঠে ফিরেছেন বেনজেমা, তবে আগের সেই আনন্দ আর খুঁজে পাওয়া যায় না তাঁর চোখে।
একই সমস্যা আরেক ডিফেন্ডার আয়মরিক লাপোর্তের। মাত্র ২৮ বছর বয়সে ইউরোপের আভিজাত্য ছেড়ে সৌদি আরবে পা দিয়েছেন তিনি। লক্ষ্য ছিল নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু ছয় মাস যেতে না যেতেই হাঁপিয়ে উঠেছেন তিনি। রোনালদোর সতীর্থ লাপোর্তে তাই সুযোগ খুঁজছেন ইউরোপে ফেরত আসার।
সমস্যা শুধু খেলোয়াড়দের নয়, তাঁদের স্ত্রী-সন্তানদেরও। সম্প্রতি আলজেরিয়ান ফুটবলার রিয়াদ মাহরেজের সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর কথোপকথনের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। সেখানে দেখা যায়, তাঁর স্ত্রী তাঁদের সৌদি গমন, ফুটবল আর লাইফস্টাইল নিয়ে বিশাল আলোচনায় বসেছেন। দিন শেষে ঠিকই আল আহলিতে যোগ দিয়েছেন মাহরেজ। স্ত্রী-সন্তান ম্যানচেস্টারে থাকলেও তিনি থাকছে সৌদি আরবে।
সাবেক লিভারপুল ও ইংলিশ অধিনায়ক জর্ডান হেন্ডারসনের কথা তো না বললেই নয়। ছয় মাস আগে লিভারপুল ছেড়ে ধুমধাম করে যোগ দিয়েছিলেন সৌদি ক্লাব আল ইত্তিফাকে। তাঁকে বরণ করে নিতে পুরো বিমানবন্দরকে নিজেদের ক্লাবের তোরণে সাজিয়েছিল আল ইত্তিফাক। মহা ধুমধাম করে যে খেলোয়াড়কে বরণ করে নেওয়া, সেই খেলোয়াড় দলের সঙ্গে থাকলেন মাত্র ছয় মাস। হেন্ডারসনের সঙ্গে অবশ্য সৌদির সমস্যাটা অন্য, তবুও এত দাম দিয়ে কেনা খেলোয়াড় ছয় মাসের মধ্যে চুক্তি বাতিল করে চলে যাওয়া; সৌদি লিগের জন্য বেশ খারাপ উদাহরণই হয়ে থাকবে। এই জানুয়ারি মাসেই হেন্ডারসন যোগ দিয়েছেন ডাচ ক্লাব আয়াক্সে।
খেলোয়াড়দের নিজেদের সমস্যা তো আছেই, লিগ চালাতেও বেশ বেগ পোহাতে হচ্ছে সৌদি আরবকে। তারকাদের এনে মাঠভর্তি করার যে পরিকল্পনা ছিল, তার অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছে লিগে। এই মৌসুম থেকে মাঠে দর্শক হারাতে শুরু করেছে সৌদি লিগ। আগের মৌসুমে তারকায় ঠাসা লিগ না হওয়া সত্ত্বেও যে পরিমাণ দর্শক ছিল, তার অর্ধেকও দেখা মিলছে না এই মৌসুমে। বরং খালি মাঠে খেলা চালাতে হচ্ছে সৌদি লিগকে। তবে মাঠ খালি হলে কী হবে, মাঠের বন্দোবস্ত ঠিকই করে ফেলেছে সৌদি। ২০৩৪ বিশ্বকাপের জন্য সৌদির নাম আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে দিয়েছে ফিফা। খেলোয়াড়েরা সৌদিতে থাকুক আর না থাকুক, নিজেদের পরিকল্পনায় ইতোমধ্যে সফল সৌদি আরব। বাকিটা এখন সময়ের হাতেই।