চ্যাম্পিয়নস লিগের সবচেয়ে দীর্ঘতম রাত

লিগ মৌসুমের সবচেয়ে বড় রাত কোনটি? এই প্রশ্নের একটাই উত্তর। না, এল ক্লাসিকো বা রেড ডার্বি নয়, উত্তরটা উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল। পুরো মৌসুমের ইতি টানা ম্যাচটার অপেক্ষায় থাকে পুরো বিশ্বের ফুটবলপ্রেমী। শত কোটি চোখ বন্দি থাকে একই স্টেডিয়ামে ইউরোপিয়ান শ্রেষ্ঠত্ব নিজেদের করে নেওয়ার লড়াই নিজ চোখে উপভোগ করতে। 

এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগ অবশ্য পালটে ফেলেছে নিজেদের ঢং। গ্রুপ পর্ব নেই, বরং আছে বিশাল এক লিগ পর্ব। দলের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩৬, পরিবর্তন এসেছে ফরম্যাটে, খেলার সংখ্যাতেও। হোম-অ্যাওয়ে সিস্টেমে মুখোমুখি হবার বালাই নেই, বরং প্রতিপক্ষের দেখা পাওয়া যাবে মাত্র একবার। কত জল্পনা-কল্পনা; চ্যাম্পিয়নস লিগের ফরম্যাট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যদি আমেজটাও ঢাকা পরে যায়? কিন্তু দিনশেষে রাতটা চ্যাম্পিয়নস লিগের। সে ট্রফির ফরম্যাট থেকে দল, সব বদলে গেলেও উত্তেজনা বদলায় না বিন্দুমাত্র। যত রাত গভীর হয়, তত বাড়তে থাকে উত্তেজনা। বৃষ্টিভেজা রাতে চ্যাম্পিয়নস লিগ পরিণত হয় এক থ্রিলারে, দেখানে বড় পর্দার দস্যি ডিরেক্টররাও ডাহা ফেইল। 

টেবিলের শীর্ষে থাকায় বড় তারকাদের ছাড়াই মাঠে নামছে লিভারপুল।
ছবি: এক্স

কিন্তু আজকের গল্পটা চ্যাম্পিয়নস লিগের সবচেয়ে বড় রাত নিয়ে নয়। বরং সবচেয়ে দীর্ঘতম রাতের গল্প। শুধু চ্যাম্পিয়নস লিগ বললে ভুল হবে, পুরো ফুটবল দুনিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘতম রাত বললেও খুব একটা ভুল হবে না। আজ রাতে একসঙ্গে মাঠে গড়াতে যাচ্ছে আঠারোটি ম্যাচ। ভুল পড়োনি। একই সঙ্গে চ্যাম্পিয়নস লিগের বাঁশি বাজবে ইউরোপের আঠারো প্রান্তে, লিগ পর্বের শেষ ম্যাচ খেলতে নামবে ৩৬ দল। পুরো বিশ্বে লিগ ফরম্যাটের নিয়ম অবশ্য এটাই। লিগের শেষ ম্যাচে প্রতিটি দল একই সঙ্গে মাঠে নামে। কারণটা খুঁজতে ফিরে যেতে হবে ৪৩ বছর আগে, ১৯৮২ বিশ্বকাপে। 

তারিখটা ছিল ২৫ জুন, ১৯৮২। স্পেনের গিহনে গ্রুপ ২-এর শেষ ম্যাচে মুখোমুখি জার্মানি ও অস্ট্রিয়া। ম্যাচে ঢোকার আগে গ্রুপের অবস্থানটা একবার দেখে আসা যাক। গ্রুপের শীর্ষে তখন অস্ট্রিয়া। ২ ম্যাচে ২ জয়, ৪ পয়েন্ট আর +৩ গোলব্যবধান নিয়ে টেবিল টপার তারা। গোলব্যবধানে (০) পিছিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে আলজেরিয়া, ৩ ম্যাচে তাদেরও সংগ্রহ ২ জয়। ২ ম্যাচে ১ জয় আর ১ হার নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে পশ্চিম জার্মানি। তাদের অবশ্য গোল ব্যবধান ভালো (+২) আর কোনো পয়েন্ট না নিয়েই বাড়ির পথ ধরেছে চিলি। শেষ ম্যাচে নামার আগে সমীকরণটা একটু জটিল। জার্মানি জিতলে টিকিট কাটবে পরবর্তী পর্বের, অস্ট্রিয়ার পরবর্তী পর্বে যেতে জয় বা ড্র, একটা হলেই হবে। আবার হারলেও হবে, যদি সেটা তিন গোলের কম ব্যবধানে হয়। কারণ গোলব্যবধানে আলজেরিয়া থেকে এগিয়ে তারা। আলজেরিয়াকে যেতে হলে হয় জার্মানিতে পয়েন্ট খোয়াতে হবে, নইলে জিততে হবে ৪ গোলের বিশাল ব্যবধানে। 

আরও পড়ুন
'ডিগ্রেস অফ গিহন’-এর একমাত্র গোলদাতা পশ্চিম জার্মানির হর্স্ট উরবেশ।
ছবি: এক্স

কিন্তু ভাগ্য সেদিন আলজেরিয়ার পক্ষে ছিল না। ভাগ্য বললে ভুল হবে, দল দল সেদিন জোট বেঁধে নেমেছিল আলজেরিয়াকে হারাতে। ইউরোপের দুই প্রতিবেশি চায়নি তাদের হটিয়ে আফ্রিকান কোনো দল পরবর্তী পর্বে জায়গা করে নিক। ফলে জার্মানিকে ১-০ গোলে জেতার সুযোগ করে দেয় অস্ট্রিয়া। ম্যাচের ১১ মিনিটে পশ্চিম জার্মানির হয়ে গোল করেন হর্স্ট উরবেশ। ম্যাচের বাকি ৮০ মিনিট নিজেদের মধ্যে পাস করেই কাটিয়ে দেয় দুই দল। সেদিন আলজেরিয়ার জন্য সমব্যথী ছিল পুরো বিশ্ব, সকলের চোখের সামনে পাতানো ম্যাচ হলেও প্রমাণের অভাবে কিছু করতে পারেনি ফিফা। ২৫ জুন, ১৯৮২ ফুটবল ইতিহাসে লেখা হয়ে আছে ‘ডিগ্রেস অফ গিহন’ হিসেবে। 

ফিফা তখন কিছু না করতে পারলেও পরবর্তী বিশ্বকাপ থেকে বদলে যায় গ্রুপ পর্বের নিয়ম। রাউন্ড রবিন ভিত্তিতে খেলা যেকোনো টুর্নামেন্টের শেষ ম্যাচ মাঠে নামবে একই সঙ্গে। যে কারনে প্রতিটি লিগের শেষ ম্যাচ মাঠে গড়ায় একই সময়ে। বিশ্বকাপ থেকে শুরু করে ইউরো, সব টুর্নামেন্টের গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় একই সঙ্গে। 

সে আয়োজন হয় চার কিংবা ছয় দলে সীমাবদ্ধ ছিল একদিন। লিগের শেষ ম্যাচে দেখা মিল ১০ ম্যাচের মহারণ। সেখানে অবশ্য নজর সীমাবদ্ধ থাকতো গুটি কয়েক দলের দিকে। বেশিরভাগ সময় ফুটবলপ্রেমীরা নজর রাখেন অবনমনের সারিতে লড়তে থাকা দলগুলোর দিকে। লিগ শিরোপার জন্য শেষদিনেও হাড্ডাহাড্ডি লড়াই, এমনটা দেখা যায় কালেভদ্রে। আজকের রাতটা বোধহয় এজন্যই বেশি গুরুত্বপূর্ণ, আঠারো ম্যাচের কোনোটিই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। প্রত্যেকেই লড়ছে নিজেদের অবস্থান টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে।

আরও পড়ুন
রাফিনহায় ভর করে প্রত্যাবর্তনের গল্প লিখেছে বার্সা।
ছবি: এক্স

চ্যাম্পিয়নস লিগের মঞ্চে আজ রাতে খেলা হবে মোট ১৬২০ মিনিট। সেটাও অতিরিক্ত সময়ের রোমাঞ্চ বাদে। এই ১৬২০ মিনিটে কপাল পুড়বে কারো, কেউ আবার জায়গা করে নিবে শেষ ২৪-এ। এই মৌসুমের জন্য ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্বক্লে বিদায় বলবে কেউ, কেউ নতুন করে স্বপ্ন দেখবে ইউরোপ জয়ের। গতবারের কোয়ার্টার ফাইনাল খেলা ম্যান সিটির কথাই ধরো না। ৭ ম্যাচ শেষে সিটির সংগ্রহ মাত্র ৮ পয়েন্ট। ক্লাব ব্রুগের বিপক্ষে জিততে না পারলে এই ম্যাচ শেষে বিদায় বলতে হবে ইউরোপকে। পিএসজি, স্পোর্টিং সিপি, বেনফিকার মতো দল ঝুলে আছে খড়কুটো ধরে। সবার সংগ্রহ ১০ পয়েন্ট। আজকে ম্যাচে ফলাফল একটু এদিক সেদিক হলেই কাটা পরবে ইউরোপ থেকে। 

আরও পড়ুন

আবার হেভিওয়েটদের কথাই ধরো না। রিয়াল মাদ্রিদ, বায়ার্ন মিউনিখ, জুভেন্টাসের মতো দল আছে ১৫, ১৬, ১৭তম অবস্থানে। সরাসরি দ্বিতীয় পর্বের টিকইট কাটা হচ্ছে না তাদের। শীর্ষ আটে যাওয়ার সুযোগ এখনও আছে বোইকি, কিন্তু সেজন্য পাড়ি দিতে হবে সমীকরণের পাহাড়। না সেই পাহাড় পাড়ি না দিতে পারলে? বাছাইপর্বের বাধায় কাটা পরবে হেভিওয়েটরা। আবার লিভারপুলকে দেখ না, ৭ ম্যাচে ৭টি জিতে এতটাই চূড়ায় উঠেছে যে দলের সব তারকাদের বিশ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছে এই ম্যাচের জন্য। কোচ আর্নে স্লট পিএসভির বিপক্ষে ম্যাচটা নিয়ে এতটাই নিশ্চিন্ত। নিশ্চিন্ত হয়ে আছে বার্সেলোনা, ইন্টার, মিলান, আতলেতিকো আর আর্সেনালও। বাদবাকি সকলের কপালে স্থান পেয়েছে চিন্তার বলিরেখা। কী জানে কী হয়? 

সিটিকে হারিয়ে পিএসজির বুনো উল্লাস।
ছবি: এক্স

চ্যাম্পিয়নস লিগ আজীবনই, ‘কে জানে কী হয়’-এর খেলা। এখানে কোত্থেকে কী হয়, কোথাকার জল কোথায় গড়ায়, তা বোঝা বড় দায়। কথায় আছে না, বাস্তব ফিকশনের থেকেও বেশি রোমাঞ্চকর, গত সপ্তাহ যেন ছিল তার প্রমাণ। বেনফিকার বিপক্ষে নিশ্চিত হারা ম্যাচ বের করে এনেছে বার্সেলোনা, ১-৩ গোলে পিছিয়ে পরা ব্লাউগ্রানারা শেষ মিনিটের ম্যাজিকে জয় ছিনিয়ে এনেছে ৫-৪ গোলে। মুদ্রার উল্টোপিঠ দেখেছে ম্যান সিটি। প্রথমার্ধের ২ গোলের লিড হারিয়ে উল্টো পরে গিয়েছে সঙ্কটে। পিএসজির বিপক্ষে জিততে পারলে হয়তো আরাম আয়েশ করে শেষ ম্যাচে নামতো তারা। অথচ ভাগ্যের লিখন, না যায় খন্ডন। ২ গোলে এগিয়ে থেকেও ম্যাচ হারতে হয়েছে ২-৪ গোলে। টগবগ করে এগিয়ে গিয়েছে পিএসজি, পরবর্তী রাউন্ডে উঠার দৌড়ে এক ধাপ এগিয়ে। ফেয়েনূর্দের কাছে বায়ার্নের হার যেন ছিল কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে। 

এতসব রোমাঞ্চ দিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ যেন বারবার প্রমাণ করে, এমন টুর্নামেন্ট পৃথিবীতে আছে একটাই। যতই হুমকিও ধামকি আর পরিবর্তন আসুক না কেন, চ্যাম্পিয়নস লিগের বিকল্প শুধু চ্যাম্পিয়নস লিগই। মৌসুমের দীর্ঘতম রাত হাত মেলে ডাকছে সবাইকে। প্রস্তুত তো আজ রাত ২ টার জন্য? 

নকআউট পর্বে যারা, আর কারাই–বা বাদ পড়েছে

শেষ ষোলো নিশ্চিত
লিভারপুল ও বার্সেলোনা
অন্তত প্লে-অফ নিশ্চিত
আর্সেনাল, অ্যাস্টন ভিলা, আতালান্তা, আতলেতিকো মাদ্রিদ, বায়ার্ন মিউনিখ, ব্রেস্ত, সেল্টিক, বরুসিয়া ডর্টমুন্ড, ফেইনুর্ড, ইন্টার মিলান, জুভেন্টাস, লেভারকুসেন, লিল, এসি মিলান, মোনাকো ও রিয়াল মাদ্রিদ।
প্রথম পর্ব থেকে বিদায়
বোলোনিয়া, রেড স্টার, জিরোনা, লাইপজিগ, সালজবুর্গ, স্লোভান ব্রাতিস্লাভা,স্পার্তা প্রাগ, স্টুর্ম গ্রাৎস ও ইয়াং বয়েজ

পয়েন্ট তালিকা

আরও পড়ুন