১৯৭৫ সালে ইংল্যান্ডে আয়োজিত হয় প্রথম ওয়ানডে বিশ্বকাপ। প্রথম দুটি বিশ্বকাপ ঘরে তোলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপের আসর গড়িয়েছে ১২ বার। বিশ্বকাপ জিতেছে মোট পাঁচটি দেশ। অস্ট্রেলিয়া সর্বোচ্চ পাঁচবার, ভারত ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ দুইবার এবং পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও ইংল্যান্ড একবার করে বিশ্বকাপ জিতেছে। তবে বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার দেওয়া শুরু হয়েছে ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ থেকে। টুর্নামেন্টে সবচেয়ে ভালো খেলা ক্রিকেটারকে দেওয়া হয় এ পুরস্কার। শুধু নিজেই ভালো খেললেই হবে না, দলকেও এগিয়ে নিতে হবে নিজের মহিমায়। অর্থাৎ যে খেলোয়াড়ের অসাধারণ নৈপুণ্যে একটি দল সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলতে পারে, সাধারণত তাঁকেই দেওয়া হয় এ পুরস্কারটি। আট মৌসুমে এখন পর্যন্ত ছয় দেশের আটজন খেলোয়াড় জিতেছেন এ পুরস্কার। তাঁদের নিয়েই এ আয়োজন।
মার্টিন ক্রো, নিউজিল্যান্ড (১৯৯২)
বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথম সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতেছেন নিউজিল্যান্ডের মার্টিন ক্রো। তাঁর অসাধারণ ব্যাটিং নৈপুণ্যে সেবার সেমিফাইনাল খেলেছিল নিউজিল্যান্ড। পুরো আসরে তিনিই করেছিলেন সবচেয়ে বেশি ৪৫৬ রান। ১১৪ গড়ে ও ৯২ স্ট্রাইক রেটে ৯ ম্যাচে একটি শতকের পাশাপাশি করেছিলেন ৪টি অর্ধশতক। সেবার নিউজিল্যান্ডকে দারুণ নেতৃত্বও দিয়েছিলেন ক্রো। তবে দুর্ভাগ্যবশত সেমিফাইনালে পাকিস্তানের কাছে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয় তাঁর দল। সেবার ইংল্যান্ডকে হারিয়ে প্রথমবার বিশ্বকাপ জিতেছিল পাকিস্তান।
সনাৎ জয়াসুরিয়া, শ্রীলঙ্কা (১৯৯৬)
১৯৯৬ সালে বিশ্বকাপ আয়োজন করে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা। ফাইনাল খেলে শ্রীলঙ্কা ও অস্ট্রেলিয়া। অস্ট্রেলিয়ার দেওয়া ২৪১ রানের টার্গেটে সহজেই পৌঁছে যায় লঙ্কানরা। ৭ উইকেটে ম্যাচটা জিতে যায় শ্রীলঙ্কা। এই জয়ের পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল সনাৎ জয়াসুরিয়ার। পুরো টুর্নামেন্টে ব্যাটে–বলে দারুণ খেলেছিলেন তিনি। ২২১ রানের পাশাপাশি নিয়েছিলেন ৬টি উইকেট। শুধু পরিসংখ্যান দিয়ে হয়তো তাঁর গুরুত্বটা সেভাবে বোঝা যাবে না। দলের বিপর্যয়ের সময় ব্যাট হাতে তুলে নিয়েছেন দুটি অর্ধশতক। আবার বোলিংয়ে হাত ঘুরিয়েও পেয়েছেন উইকেট। চারবার ম্যাচসেরার পুরস্কার পেয়েছিলেন জয়াসুরিয়া। গ্রুপ পর্বের প্রথম দুটি ম্যাচ ছিল অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। কিন্তু নিরাপত্তার কারণে কোনো দলই খেলায় অংশগ্রহণ করেনি। ফলে না খেলেই জয় পেয়েছিল শ্রীলঙ্কা। কারণ, তারা মাঠে উপস্থিত ছিল। প্রথম ম্যাচ খেলে ভারতের বিপক্ষে। সে ম্যাচে জয়াসুরিয়া ৭৯ রানের ইনিংস খেলে ম্যাচসেরা হয়েছিলেন। অবশ্য টুর্নামেন্ট সবচেয়ে বেশি ৫২৩ রান করেছিলেন ভারতের শচীন টেন্ডুলকার। আর সর্বোচ্চ ১৫ উইকেট নিয়েছিলেন ভারতের অনিক কুম্বলে। তবে শ্রীলঙ্কার কাছে হেরেই সেবার বিদায় নিয়েছিল ভারত। জয়াসুরিয়া সেই ম্যাচে নিয়েছিলেন ৩টি উইকেট।
ল্যান্স ক্লুজনার, দক্ষিণ আফ্রিকা (১৯৯৯)
বাংলাদেশের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছে ১৯৯৯ বিশ্বকাপ। এ বিশ্বকাপেই যে বাংলাদেশ প্রথম খেলেছিল। স্কটল্যান্ড ও পাকিস্তানের বিপক্ষে জয়ও পেয়েছিল। সেবার ব্যাট–বলে আলো ছড়িয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার ল্যান্স ক্লুজনার। যদিও সেমিফাইনালে দুর্ভাগ্যবশত গড় রান রেটের দৌড়ে এগিয়ে যায় অস্ট্রেলিয়া। বিদায় নেয় দক্ষিণ আফ্রিকা। আসলে ম্যাচটি টাই হয়েছিল। তখনো সুপার ওভারের চল শুরু হয়নি। তাই গড় রান রেটে এগিয়ে থাকার কারণে ফাইনালে চলে যায় অস্ট্রেলিয়া। সেই দুর্ভাগ্য এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি দলটি। তা না হলে চার চারবার বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলেও কেন ফাইনাল খেলা হবে না প্রোটিয়াদের! তবে ২৮১ রানের পাশাপাশি ১৭ উইকেট নিয়ে ঠিকই বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হয়েছিলেন ক্লুজনার। গ্রুপ পর্বের প্রথম দুই ম্যাচেই ভারত ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তিনটা করে উইকেট। কেনিয়াকে তো একাই ধসিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। ২১ রানে নিয়েছিলেন ৫ উইকেট। সব মিলিয়ে দারুণ ছন্দে ছিলেন এই প্রোটিয়া অলরাউন্ডার।
শচীন টেন্ডুলকার, ভারত (২০০৩)
২০০৩ বিশ্বকাপে ব্যাটিংয়ে অনেকটা একাই আলো ছড়িয়েছিলেন শচীন টেন্ডুলকার। এক বিশ্বকাপে রেকর্ড সর্বোচ্চ ৬৭৩ রান করেছিলেন তিনি। গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে অর্ধশতক পাওয়া শচীন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে খেলেন ৮১ রানের ইনিংস। নামিবিয়ার বিপক্ষে তাঁর ব্যাট আরও জ্বলে ওঠে। ১৫২ রানের ইনিংস খেলে ম্যাচসেরা। পাকিস্তানের বিপক্ষেও সেঞ্চুরি থেকে ২ রান পেছনে ছিলেন মাত্র। তাঁর অসাধারণ ব্যাটিং নৈপুণ্যে ভারত ফাইনাল খেলেছিল। তবে অস্ট্রেলিয়ার পাহাড়সম ৩৫৯ রান তাড়া করতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলেছিল ভারত।
গ্লেন ম্যাকগ্রা, অস্ট্রেলিয়া (২০০৭)
এক বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ২৬ উইকেট নেওয়ার রেকর্ডটা ২০১৯ বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত ছিল ম্যাকগ্রার দখলে। গত বিশ্বকাপে ২৭ উইকেট নিয়ে তাঁর রেকর্ড ভেঙেছেন সতীর্থ মিচেল স্টার্ক। ম্যাকগ্রা এ কীর্তি গড়েছিলেন ২০০৭ বিশ্বকাপে। সেবার অজিরা চতুর্থবারের মতো পায় বিশ্বকাপের স্বাদ। ফাইনাল খেলেছিল অস্ট্রেলিয়া ও শ্রীলঙ্কা। ফাইনালে অ্যাডাম গিলক্রিস্ট ১০৪ বলে ১৪৯ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলেছিলেন। এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপের ফাইনালে এটাই একক সর্বোচ্চ রান। কিন্তু টানা তৃতীয়বার বিশ্বকাপ জিততে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল ম্যাকগ্রা। ১১ ম্যাচে তিনি ১৩.৭৩ গড়ে নিয়েছিলেন ২৬ উইকেট।
যুবরাজ সিং, ভারত (২০১১)
২০১৯ বিশ্বকাপের কথা বাদ দিলে সেরা অলরাউন্ড নৈপুণ্য ছিল ২০১১ সালে যুবরাজ সিংয়ের। ২০১৯ বিশ্বকাপ কেন বাদ দিলাম, তা নিয়ে একটু পরেই আসছি। পুরো টুর্নামেন্টে ব্যাট–বলে দারুণ ছন্দে ছিলেন যুবরাজ। শচীন টেন্ডুলকার, বীরেন্দার শেবাগ কিংবা ভিরাট কোহলি—তাঁদের সঙ্গে জ্বলে উঠেছিল যুবরাজের ব্যাট। অধিনায়ক মাহেন্দ্র সিং ধোনির নেতৃত্বে ২০১১ বিশ্বকাপটাই তো ঘরে তুলেছিল ভারত। ২৮ বছর পর ভারতের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জয়। সেখানে যুবরাজ সিং ৩৬২ রানের পাশাপাশি নিয়েছিলেন ১৫টি উইকেট। করেছিলেন ১টি শতকের পাশাপাশি ৪টি অর্ধশতক। ৩১ রানে ৫ উইকেট তাঁর ওই বিশ্বকাপের সেরা বোলিং। সেরা খেলোয়াড়ের দৌড়ে কিং সিংয়ের ধারেকাছেও ছিলেন না কেউ।
মিচেল স্টার্ক, অস্ট্রেলিয়া (২০১৫)
পঞ্চমবারের মতো অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপ জেতে ২০১৫ সালে। সেই দলের গর্বিত সদস্য ছিলেন মিচেল স্টার্ক। বল হাতে প্রতিপক্ষকে একাই গুড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। ওই বিশ্বকাপে তাঁর বোলিংয়ের পরিসংখ্যান চোখে পড়ার মতো। ৮ ম্যাচে নিয়েছেন সর্বোচ্চ ২২ উইকেট। ইকোনমি মাত্র সাড়ে তিন। ২৮ রানে ৬ উইকেট তাঁর ওই বিশ্বকাপের সেরা বোলিং। নিউজিল্যান্ডের ট্রেন্ট বোল্টও পেয়েছিলেন ২২ উইকেট। কিন্তু ফাইনালে নিউজিল্যান্ড হেরে যায় অজিদের কাছে। এ কারণেই হয়ত সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারটি পাননি বোল্ট। তাছাড়া বোল্টের চেয়ে স্টার্কের পরিসংখ্যান ভালো ছিল। ওই বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ৫৪৭ রান করেছিলেন কিউই ব্যাটসম্যান মার্টিন গাপটিল। আর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৫৪১ রান ছিল লঙ্কান কিংবদন্তি কুমার সাঙ্গাকারার।
আগেই বলেছি, ২০১৯ বিশ্বকাপে ২৭ উইকেট নিয়ে এক বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ উইকেট পাওয়ার রেকর্ড গড়েন স্টার্ক। অর্থাৎ পরপর দুটি বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি তিনি। এরকম একজন খেলোয়াড় দলে থাকলে বিশ্বকাপ জয়ের পক্ষে অনেকটাই এগিয়ে যাওয়া যায়।
কেন উইলিয়ামসন, নিউজিল্যান্ড (২০১৯)
২০১৯ সালে বিশ্বকাপ জেতে ইংল্যান্ড। অনেকের মতে গত বিশ্বকাপের ফাইনালটি ছিল ইতিহাসের সেরা ওয়ানডে ম্যাচ। অনেক নাটকীয়তার পর ফাইনাল ম্যাচ টাই হয়। এরপর সুপার ওভার। নাটকীয়তা তখনো শেষ হয়নি। সুপার ওভারও হয় টাই। শেষে বেশি বাউন্ডারি মারার কারণে বিশ্বকাপ পেয়ে যায় স্বাগতিক ইংল্যান্ড। সেরা খেলোয়াড়ের দৌড়ে এগিয়ে ছিলেন অনেকেই। সর্বোচ্চ ৬৪৮ রান করেন ভারতের ওপেনার রোহিত শর্মা। তাঁর চেয়ে এক রান কম, ৬৪৭ করেন অস্ট্রেলিয়ার ডেভিড ওয়ার্নার। বল হাতে ইতিহাসের সর্বোচ্চ ২৭ উইকেট স্টার্কের। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নিউজিল্যান্ডের লকি ফার্গুসনের ২১ উইকেট। কিন্তু বিশ্বকাপের ইতিহাসে সেরা অলরাউন্ডিং পারফরম্যান্স যিনি করেছিলেন, তিনি বাংলাদেশের সাকিব আল হাসান। বিশ্বকাপের ইতিহাসে এ রকম দুর্দান্ত পারফম্যান্স নেই আর কোনো ক্রিকেটারের। ৬০৬ রানের পাশাপাশি নিয়েছেন সাকিব নিয়েছেন ১১ উইকেট। যেকোনো বিচারে সেরা খেলোয়াড় হওয়ার জোর দাবি রাখেন সাকিব। কিন্তু সেরা খেলোয়াড় হয়েছিলেন নিউজিল্যান্ডের কেন উইলিয়ামসন।
কেন তিনি সেরা খেলোয়াড় হলেন? তোমাদের হয়তো মনে আছে, একদম ওপরে একটি কথা বলেছিলাম। শুধু নিজে ভালো করলেই হবে না, তাঁর নিজের মহিমায় দলকেও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এতক্ষণ যাঁদের কথা বললাম, তাঁরা কেউ নিজের দলকে ফাইনালে নিতে পারেননি। সবেচেয়ে ভালো খেলা সাকিব নিজের দলকে কোয়ার্টার ফাইনালেও নিতে পারেনি। বাকিরা অবশ্য সেমি থেকে বিদায় নিয়েছে। কিন্তু কেন উইলিয়ামসন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে দলকে সামনের থেকে নেতৃত্ব দিয়ে জয় এনে দিয়েছেন। নিজে করেছেন ৯ ম্যাচে ৫৭৮ রান। কিন্তু দলকে ফাইনালে তুলে তিনি এগিয়ে গেছেন সবাইকে ছাড়িয়ে।