জর্জর শরীর নিয়েও রূপকথার মতো ইনিংস, এমন ব্যাটিং আগে দেখেনি কেউ

গ্লেন ম্যাক্সওয়েল
ছবি: এএফপি

জীবনে এমন কিছু দিন আসে, যা শব্দের বাঁধনে বাঁধা অসম্ভব। ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক জায়গায় বসে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে শুধু তাকিয়ে থাকাটাই বরং শেষ সম্বল। মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে গ্লেন ম্যাক্সওয়েল যা করলেন, তা শব্দের বেড়াজালে বাঁধা দুনিয়ার সবচেয়ে কষ্টকর কাজগুলোর একটি!

ওয়াংখেড়ের ম্যাক্সওয়েলকে কি শব্দের বেড়াজালে বেঁধে ফেলা সম্ভব? হ্যাঁ, খুব সম্ভব। বাংলা অভিধানের বিশাল ভান্ডারে ম্যাক্সওয়েলের জন্যও আলাদা করে শব্দ তোলা রয়েছে, ‘সংশপ্তক’! অভিধানের ভাষায় যার অর্থ—জয়লাভের জন্য জীবনপণ যুদ্ধ করতে প্রস্তুত যে সৈনিক। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কলমে অবশ্য সংশপ্তকের ব্যাখ্যা বড্ড সাধারণ, ‘জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার; তবু মাথা নোয়াবার নয়’। ম্যাক্সওয়েলের জন্য অবশ্য এত কিছুও অনেক কম। হাজারো বিশেষণ লুটিয়ে পড়েছে তাঁর পদতলে, কিন্তু কোনোটাই যথেষ্ট নয়। যতই বলা হোক, ততই মনে হয় কম হয়ে যাচ্ছে না তো?

ম্যাক্সওয়েল যতক্ষণে ক্রিজে পা রেখেছেন, ততক্ষণে অজিদের ইনিংসকে কার্যত শেষ বলেই ধরে নিয়েছেন সবাই। পরপর দুই বলে ওয়ার্নার আর ইংলিসের পতন, হ্যাটট্রিক বলের সামনে দাঁড়িয়ে ম্যাক্সওয়েল। ব্যাটের কানায় লেগেছিল বটে, কিন্তু বলটা উইকেটকিপার পর্যন্ত পৌঁছায়নি। পৌঁছালে হয়তো শুরুতেই ইতি টানতে হতো ম্যাক্সওয়েল–অধ্যায়ের। কিন্তু ইতিহাস কখন কী হতে পারত ভেবে লেখা হয় না। লেখা হয়, যা হয়েছে তা নিয়ে।

আর সে কারণেই দুটি ক্যাচ মিস, দুটি এলবিডব্লিউ থেকে বাঁচা—সবটাই ছুড়ে ফেলা হয়েছে ইতিহাস থেকে। বরং ইতিহাসে ঠাঁই পেয়েছে ৩৫ বছর বয়সী ম্যাক্সওয়েলের হার না মানার গল্প, ক্লান্তজর্জর শরীর ভেঙে গুঁড়িয়ে পড়েছেন, কিন্তু হাল ছাড়েননি। দুনিয়ার সবচেয়ে আশাবাদী মানুষটাও হয়তো আশা ছেড়ে বসে ছিলেন; উইন প্রেডিকটর বলছিল, এখান থেকে মাত্র শূন্য দশমিক ৪৬ ভাগ সুযোগ আছে ম্যাচটা অস্ট্রেলিয়ার নিজের করে নেওয়ার। সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ম্যাক্সওয়েলের অ-ম্যাক্সওয়েলীয় এক ইনিংস। ৯১ রানে যখন সপ্তম উইকেটের পতন ঘটল, ম্যাক্সওয়েলের ঝুঁড়িতে তখন রান মাত্র ২৯ বলে ২৬!

নতুন ব্যাটসম্যান হিসেবে অপর প্রান্তে তখন অধিনায়ক প্যাট কামিন্স। ব্যাটটা যে প্যাট কামিন্স ভালো চালাতে পারেন, সেটা সবারই জানা। কিন্তু অস্ট্রলিয়ার রান তখন ৭ উইকেটে ৯১। ব্যাট চালানো পরের কথা, মান বাঁচাতেই খোলসে ঢুকে পড়লেন কামিন্স। নিজের অর্ধশতক পর্যন্ত মোটামুটি শান্তই ছিলেন ম্যাক্সওয়েল। হাতে মাত্র ৩ উইকেট, স্কোরবোর্ডে চাই আরও ১৬০ রান। পাহাড়সম এই টার্গেট পূরণ করতে চাইলে রচনা করতে হবে নতুন এক রূপকথা। অধিনায়ক কামিন্স পাশ থেকে পিঠ চাপড়ে কী যেন বললেন, মুহূর্তেই ফার্স্ট গিয়ারের ম্যাক্সওয়েল উঠে এলেন ফিফথ গিয়ারে। প্রথম ৫০ পার করতে বল খেলেছিলেন ৫১টি, আর সেখানে শতক পূরণ করলেন ৭৬ বলে! কিন্তু ততক্ষণে হানা দিয়েছে পেশির পুরোনো চোট। পানিশূন্যতায় ক্র্যাম্পের কবলে পড়ল শরীরের বিভিন্ন পেশি। ঠিকভাবে পা-ই নাড়াতে পারছিলেন না। এভাবে কতক্ষণই–বা টিকে থাকা যায়? শত রান পার করতে না করতেই ভেঙে পড়ল ম্যাক্সওয়েলের জর্জর শরীর। ধারাভাষ্যকক্ষ থেকে ঘোষণা এল, হয়তো ম্যাক্সওয়েল-রূপকথা থামতে যাচ্ছে আজ এখানেই। ওয়াংখেড়ের সিঁড়ি বেয়ে অ্যাডাম জাম্পাকে নামতে দেখে সবাই ধরেই নিয়েছিলেন এই ম্যাক্সওয়েলের গল্পটা ফুরাল! তখনো ম্যাক্সওয়েলের গল্পটা রূপকথা নয়, নিঠুর বাস্তবতা। রূপকথায় অনেক সময়ই লাগাম টানতে হয়, বাস্তবে সে ভাবনা নেই। তাই তো মাটিতে লুটিয়ে থাকা ম্যাক্সওয়েল লাফ দিয়ে উঠলেন। শরীরের যুদ্ধকে নিয়ে গেলেন মনে। কিছুক্ষণ আগেই যে ম্যাচটা ছিল ম্যাক্সওয়েল বনাম আফগানিস্তান, মুহূর্তেই সেটা পরিণত হলো ম্যাক্সওয়েল বনাম মাংসপেশির টানে।

জয়ের পর গ্লেন ম্যাক্মওয়েলকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন প্যাট কামিন্স
ছবি: এএফপি

রশিদ-মুজিব-নূররা ততক্ষণে বুঝে গিয়েছেন সেমিফাইনাল আর তাদের মাঝে দূরত্ব শুধু এক উইকেটের। সঙ্গে এটাও বুঝে গিয়েছেন, যে ম্যাক্সওয়েলের শরীর যেখানে নস্যি, সেখানে প্রকাণ্ড ঘূর্ণিঝড় এনে দিলেও ম্যাক্সওয়েল তা অনায়াসে টপকে যাবেন। দৌড়ে রান নেওয়ার ক্ষমতা তো অনেক আগেই থমকে গিয়েছে, থেমে গিয়েছে ম্যাক্সওয়েলের পা নাড়ানোর ক্ষমতাও। তাঁর সামনে তখন সমীকরণ একটাই—হয় ডট নয়তো বল সীমানা ছাড়া। বাকি সব সমীকরণ তখন ছুড়ে ফেলা হয়েছে ডাস্টবিনে।

ম্যাক্সওয়েল কখনোই কোনো ব্যাকরণ মানা ব্যাটসম্যান ছিলেন না। উইকেটে এসেই মিডল স্টাম্পে গার্ড নেন না, কাভার ড্রাইভ, হুক-পুল কোনোটাই তিনি নিয়ম মেনে করেন না। তিনি যেভাবে খেলেন, সেটাই তাঁর কাছে ক্রিকেটের অভিধান। ব্যাটিংয়ের বেসিক ভুলে পেছনের পা এক জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে রেখে লড়েছেন। শেষ ৫০ রানের পুরোটাই এসেছে নিজের পেশির শক্তিতে। পায়ের পেশি কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে তো কী হয়েছে, দুই হাত তো আর থামেনি। পা যত আড়ষ্ট হয়েছে, ততই হাত খুলে খেলেছেন ম্যাক্সওয়েল। শেষ ওভারের ২২ রান, একবারের জন্য মিডল স্টাম্পের সামনে থেকে পা সরাননি ম্যাক্সওয়েল। মিড উইকেটের ওপর দিয়ে শেষ ছক্কাটা লুটিয়ে পড়ল সীমানার বাইরে। দুই হাত তুলে ম্যাক্সওয়েল জানান দিলেন, তিনি পেরেছেন। অজিরা কখনো হারার আগে হারে না—ম্যাক্সওয়েল সেটাই প্রমাণ করলেন নতুন করে। পরপর উইকেটের পতন, আড়ষ্ট শরীর, বিশাল টার্গেট—ম্যাক্সওয়েলের কাছে কোনোটাই বাধা নয়। বাস্তবের ম্যাক্সওয়েল ব্যাট হাতে লিখতে পারেন জলজ্যান্ত রূপকথা, যা অবিশ্বাস্য হলেও সত্য।

পায়ের ব্যথায় বেশ কয়েকবার মাঠে শুয়ে পড়েন ম্যাক্সওয়েল
ছবি: এএফপি

ম্যাক্সওয়েলের অপরাজিত ২০১ কি এক দিনের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা ইনিংস? সে প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে মুখোমুখি হতে হবে হাজারো ইতিহাসের, হাজারো পরিসংখ্যানের। পরিবেশ, পরিস্থিতি, রেকর্ড ঘেঁটে কাগজে–কলমে হয়তো সে গল্প লেখা সম্ভব। সে গল্প না হয় তোলা থাকল অন্য কোনো দিনের জন্য। আজকের দিনটা শুধু ম্যাক্সওয়েলকে উদ্‌যাপন করার দিন।

ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের নর্থ স্ট্যান্ডকে ধরা হয় ক্রিকেটের সবচেয়ে উত্তাল গ্যালারি। টস থেকে শুরু করে প্রেজেন্টেশন পর্যন্ত, উৎসবে মুখর থাকে সে গ্যালারি। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, যুদ্ধজয়ী ম্যাক্সওয়েল যখন সিঁড়ি ভেঙে ড্রেসিংরুমে উঠছেন, তখন দর্শকেরা তাঁকে ছুয়ে দেখার শেষ চেষ্টা করছেন। কপিল দেব, শচীন, ধোনি থেকে কোহলি দেখেছেন, কিন্তু ম্যাক্সওয়েলের মতো কাউকে দেখা হয়নি। আরব সাগরের তীর ঘেঁষে তখন শুধু একটি স্লোগান, ‘ম্যাক্সি, ম্যাক্সিইই’! সেই স্লোগানই জানান দেয়, মহাকালের মঞ্চ বরাদ্দ শুধু ম্যাক্সওয়েলদের জন্যই, বাকিরা সেখানে শুধুই দর্শক!