মাত্র গত সপ্তাহের কথা, চ্যাম্পিয়নস লিগের ম্যাচে ঘরের মাঠে ৩-০ গোলে এগিয়ে থাকার পরও শেষ পর্যন্ত ড্র নিয়ে মাঠ ছাড়তে হয়েছে ম্যানচেস্টার সিটিকে। এ ঘটনার পর আর নিজেকে সামলে রাখতে পারেননি দলের কোচ পেপ গার্দিওলা। নখের আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত করেছেন কপাল-নাক-মুখ। গার্দিওলার সেই ছবি ইন্টারনেটে ভাইরাল হতে সময় নেয়নি। সবাই যখন তাঁকে নিয়ে বিদ্রূপ করায় ব্যস্ত, তখন খুঁজে দেখা যাক এই দুর্দশার পেছনের কারণ!
গত সেপ্টেম্বর মাসে আর্সেনালের বিপক্ষে ইনজুরিতে পড়ে মাঠ ছাড়েন ম্যান সিটির মধ্যমাঠের প্রাণভোমরা রদ্রি। অসাধারণ নৈপুণ্যে সিটিজেনদের ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ জেতানোর পাশাপাশি স্পেনকে জিতিয়েছেন ইউরো। এবারের ব্যালন ডি’অরও উঠেছে তাঁর হাতে। কিন্তু ভাগ্যের কী নিদারুণ পরিহাস! মৌসুমের শুরু থেকে চোটের কারণে মাঠের বাইরে তিনি। যখনই বা সুস্থ হয়ে ফিরেছেন, সঙ্গে সঙ্গে নতুন ইনজুরিতে মাঠ ছাড়তে হলো।
সেরা মিডফিল্ডারকে হারানোর পরও কোনোমতে দলকে সামলে নিচ্ছিলেন গার্দিওলা। তবে বিধিবাম! একের পর এক ইনজুরিতে ছিটকে পড়তে লাগলেন দলের প্রথম একাদশের খেলোয়াড়েরা। ওয়াকার, জ্যাক গ্রিলিশ, কেভিন ডি ব্রুইনা, জেরেমি ডকুর ইনজুরির পর ম্যাচের একাদশ বানাতে হিমশিম খেতে হচ্ছিল এই স্প্যানিয়ার্ড কোচকে। ওদিকে সিটির সামনে তখন একের পর এক ম্যাচের শিডিউল। লিগ, কাপ, চ্যাম্পিয়নস লিগ—সব মিলিয়ে একটানা খেলতে থাকা বাকি খেলোয়াড়রাও ক্লান্তিতে অবসন্ন। এর মধ্যে আবার ইনজুরি এসে হানা দিল আকাশি–নীল শিবিরে।
এবার ডিফেন্ডারদের মধ্যে রুবেন ডিয়াজ, স্টোনস, আকানজি হয়ে পড়লেন অনিশ্চিত। ওদিকে রদ্রির জায়গায় থিতু হতে থাকা কোভাচিচও ছিটকে গেলেন দলের বাইরে। পেপ গার্দিওলার ম্যানচেস্টার সিটিকে এখন একটা হাসপাতাল বললে ভুল হবে না।
দলে যখন ইনজুরির সমস্যা প্রকট, তখন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে দলের স্ট্রাইকার আরলিং হলান্ডের অফ ফর্ম। ক্লাবের জার্সিতে গত আট লিগ ম্যাচে হলান্ড গোল করেছেন মাত্র দুটি। গোলের সুযোগ তার সামনে ধুলোয় লুটোয়, কিন্তু বারবার বাজে ফিনিশিংয়ে লক্ষ্য ফসকাচ্ছেন তিনি। অথচ লিগের প্রথম ৫ ম্যাচে ১০ গোল করে এই লক্ষ্যভেদকেই যেন ডালভাত বানিয়ে ফেলেছিলেন নরওয়েজীয় স্ট্রাইকার!
গার্দিওলার হারের বৃত্ত শুরু হয়েছিল, ইংলিশ ক্যারাবাও কাপে টটেনহামের কাছে হেরে। তারপর সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে শেষ সাত ম্যাচের ছয়টি ম্যাচ হেরেছে তারা, আরেকটি ম্যাচে ৩-০ গোলে এগিয়ে থেকেও ড্র করার পরের চিত্র তো সবার জানা।
তবে কেবল যে ইনজুরির কারণে ম্যান সিটির এমন দুর্দশা, এ কথা মানতে নারাজ ফুটবল পণ্ডিতরা। তাঁদের মতে, সিটিজেনদের দলে ত্রিশোর্ধ্ব খেলোয়াড়ের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ফিটনেসের ঘাটতিতে পড়তে হচ্ছে দলটিকে। কেভিন ডি ব্রুইনা, বার্নার্ডো সিলভা, কাইল ওয়াকার, এডারসন, জন স্টোনস, কোভাচিচরা পৌঁছে গেছেন তিরিশের কোঠায়। এমনকি এই সিজনে ফ্রি খেলোয়াড় হিসেবে সিটিতে ফিরে আসা গুন্ডোগানের বয়সও ছুঁয়েছে ৩৪ বছর। সাম্প্রতিক সময়ের ব্যস্ত ফিকশ্চারে তাই নিয়মিত ফিট এবং পূর্ণোদ্যমে খেলার মতো একাদশ তৈরি করা কঠিন হয়ে পড়েছে তাদের জন্য।
গোল করা যেমন বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে সিটির জন্য, কঠিন হয়ে উঠেছে গোল ঠেকানোর কাজটাও। নিয়মিত ডিফেন্ডার নেই, বাধ্য হয়ে খেলাতে হচ্ছে রিজার্ভ থেকে আসা ডিফেন্ডারদের। তাঁদের ছোট ভুল কিংবা অসতর্কতার সুযোগ নিয়ে প্রতিপক্ষ গোল করে যাচ্ছে। ইনজুরির কারণে কোনো ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার না থাকাও আরেকটি বড় কারণ। প্রতিপক্ষের পায়ে বল থাকলে সেটা রিকভারির জন্য নির্ভরযোগ্য কেউ নেই মাঝমাঠে। খেলার গতি ধীর হওয়ায় স্পিড দিয়ে প্রতিপক্ষের রক্ষণে ভাঙন ধরাতেও ব্যর্থ হচ্ছে তারা।
এমন সংকটকালে কাজে লাগছে না পেপ গার্দিওলার খামখেয়ালি ট্যাকটিক্যাল পরীক্ষা–নিরীক্ষাও। গত ম্যাচে লিভারপুলের বিপক্ষে অ্যানফিল্ডে তিনি দলকে নামিয়েছিলেন কোনো প্রথাগত উইঙ্গার ছাড়া। মিডফিল্ড নিয়ন্ত্রণে নিয়ে লিভারপুলের আক্রমণের গতির লাগাম টেনে ধরবেন বলে ফন্দি এঁটেছিলেন পেপ। কিন্তু হিতে বিপরীত হয়ে উল্টো মুহুর্মুহু আক্রমণ হজম করতে হয়েছে তাদের। ভাগ্য সঙ্গে থাকলে লিভারপুল অনায়াসে ২-০ গোলের চেয়ে বেশি ব্যবধানে জিততে পারত।
নিজের কোচিং ক্যারিয়ারে কখনো এত লম্বা সময় জয়বিহীন থাকেননি গার্দিওলা। তাই একেবারে দিশাহারা অবস্থায় আছেন এই স্প্যানিশ কোচ। লিভারপুলের বিপক্ষে হারের কারণে পয়েন্ট টেবিলের পাঁচে নেমে গেছে দল। লিগ শিরোপার লড়াই থেকে তারা একপ্রকার ছিটকে গেছে বলা যায়, ১৩ ম্যাচ শেষে ১৩ পয়েন্টের ব্যবধান সামনে! এমনকি তাঁকে বরখাস্ত করার রবও উঠেছে ফুটবল–দুনিয়ায়। তবে দুঃসহ এ সময়ে বোধ হয় আরও কিছুদিন পাশে পাচ্ছেন ম্যান সিটি ম্যানেজমেন্টকে। ক্লাবের কিংবদন্তি বনে যাওয়া এই ম্যানেজারকে হঠাৎই বরখাস্ত করার সাহস দেখাবে না তারা। কিন্তু সেটাও বা কত দিন? আপাতত ওই উত্তর সময়ের হাতে তোলা থাকুক।