ছোট ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আসরের উদ্বোধন হয় ২০০৭ সালে। ২০ ওভারের সেই বিশ্বকাপে নিজেদের উপস্থিতি কী দারুণভাবেই না জানান দিয়েছিল বাংলাদেশ! জোহানেসবার্গে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ১৬৪ রান হেলায় পেরিয়ে যায় মোহাম্মদ আশরাফুলের দল। কিন্তু তখন কে জানত, ১৫ বছর পরও ওই জয়ই হয়ে থাকবে টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বলার মতো একমাত্র অর্জন!
২০০৭
স্বাগতিক: দক্ষিণ আফ্রিকা | ধাপ: সুপার এইট | ফল: ম্যাচ ৫, জয় ১, হার ৪
টি–টোয়েন্টি ক্রিকেট কীভাবে খেলতে হয়, সেটি বুঝে ওঠার আগেই দুয়ারে হাজির বিশ্বকাপ। কথাটা শুধু বাংলাদেশের জন্যই বলা নয়। সবচেয়ে অভিজ্ঞ যে দল, সেই ইংল্যান্ডও দক্ষিণ আফ্রিকায় যায় অভিজ্ঞতার ঝুলিতে মাত্র ছয়টি আন্তর্জাতিক টি–টোয়েন্টি নিয়ে। দুম করে শুরু সেই বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে ক্রিকেট দুনিয়াকে চমকে দেয় বাংলাদেশ। মোহাম্মদ আশরাফুলের ব্যাট সেদিন তলোয়ার হয়েছিল। অধিনায়কের ২৭ বলের ৬১ রানে ভর করে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ১৬৪ রান ২ ওভার হাতে রেখেই পেরিয়ে যায় বাংলাদেশ।
সর্বোচ্চ ইনিংসটা খেলেছিলেন অবশ্য আফতাব আহমেদ, ৪৯ বলে করেছিলেন ৬২। বল হাতে ৪ উইকেট নেন সাকিব আল হাসান, বাঁহাতি পেসার সৈয়দ রাসেল ৪ ওভারে দিয়েছিলেন মোটে ১০ রান। ওই জয়ে ক্যারিবীয়দের বিদায় করে সুপার এইটে ওঠাও নিশ্চিত করে ফেলেন আশরাফুলরা।
এরপর টুর্নামেন্ট যত এগিয়েছে, বাংলাদেশকে জাবর কাটতে হয়েছে ওই ম্যাচের স্মৃতিটাই। বাকি চার ম্যাচে গর্ব করে বলার মতো কিছুই ঘটেনি। প্রথম পর্বে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে ৭ উইকেটের হারের পর সুপার এইটে অস্ট্রেলিয়া ও শ্রীলঙ্কার কাছে বড় ব্যবধানে হার। শেষ ম্যাচে ১৪০ রানের পুঁজি নিয়ে পাকিস্তানের বিপক্ষেই যা একটু লড়াই করতে পেরেছিল বাংলাদেশ।
২০০৯
স্বাগতিক: ইংল্যান্ড | ধাপ: প্রথম রাউন্ড | ফল: ম্যাচ ২, জয় ০, হার ২
প্রথম রাউন্ডে বাংলাদেশের গ্রুপ সঙ্গী টি–টোয়েন্টির প্রথম বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ভারত ও আয়ারল্যান্ড। বাংলাদেশ কাগজ–কলমের হিসাব মেলাতে পারেনি। ভারতের কাছে অনুমিতভাবে ও আয়ারল্যান্ডের কাছে অভাবিতভাবে হেরে সুপার এইটে ওঠার স্বপ্ন ধূলিসাৎ বাংলাদেশের।
ট্রেন্ট ব্রিজে প্রথম ম্যাচে ভারতের যুবরাজ সিংয়ের ১৮ বলে খেলা ৪১ রানের ইনিংসটাই পার্থক্য গড়ে দেয়। যুবরাজের ঝড় ভারতকে এনে দেয় ১৮০ রান। বাংলাদেশের শুরুটা খারাপ ছিল না। জুনায়েদ সিদ্দিকের (২২ বলে ৪১ রান) ব্যাটে আস্কিং রানরেটের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই এগোচ্ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু নবম ওভারে দলকে ৭৭ রানে রেখে জুনায়েদ ফিরতেই ধূসর জয়ের স্বপ্ন। বাংলাদেশ পুরো ২০ ওভার খেলে করতে পারে ১৫৫ রান।
ট্রেন্ট ব্রিজে পরের ম্যাচে বাংলাদেশকে ব্যাটিংয়ে পাঠিয়ে ১৩৭ রানে আটকে ফেলে আইরিশরা। মাশরাফি শেষের দিকে ১৬ বলে ৩৩ রান না করলে ওই স্কোরও হয় না। আয়ারল্যান্ড ঠান্ডা মাথায় খেলে ১০ বল ও ৬ উইকেট হাতে নিয়ে ম্যাচটি জিতে বিদায়ঘণ্টা বাজায় বাংলাদেশের।
২০১০
স্বাগতিক: ওয়েস্ট ইন্ডিজ | ধাপ: প্রথম রাউন্ড | ফল: ম্যাচ ২, জয় ০, হার ২
২০০৯ সালের মতো এবার সহজ গ্রুপ পায়নি বাংলাদেশ। আগেরবারের চ্যাম্পিয়ন পাকিস্তান ও অস্ট্রেলিয়া পড়ে বাংলাদেশের গ্রুপে। ফল অনুমিতভাবেই দুই ম্যাচে হেরে প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায়।
সেন্ট লুসিয়ায় প্রথম ম্যাচে পাকিস্তান করে ৩ উইকেটে ১৭২ রান। এই রানের ১৪২–ই আসে সালমান বাট ও কামরান আকমলের উদ্বোধনী জুটিতে। আশরাফুল (৪৯ বলে ৬৫) ও সাকিব (৩১ বলে ৪৭) একটু চেষ্টা করেছিলেন। বাংলাদেশ করতে পারে ৭ উইকেটে ১৫১ রান।
ব্রিজটাউনে পরের ম্যাচে কী সুযোগটাই না হারায় বাংলাদেশ! ১৩ ওভারের মধ্যেই ৬৫ রানে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ৬ উইকেট নেই। কিন্তু এরপর যথারীতি বাংলাদেশের আরেকটি হতাশার গল্প। যে গল্পের নায়ক মাইক হাসি (২৯ বলে অপরাজিত ৪৭), পার্শ্বনায়ক স্টিভ স্মিথ (১৮ বলে ২৭)। অস্ট্রেলিয়া করে ৭ উইকেটে ১৪১ রান। রান তাড়ায় ১৫ রানেই ৪ উইকেট খোয়ানো বাংলাদেশ হাঁচড়েপাঁচড়ে যেতে পারে ১১৪ পর্যন্ত।
২০১২
স্বাগতিক: শ্রীলঙ্কা | ধাপ: প্রথম রাউন্ড | ফল: ম্যাচ ২, জয় ০, হার ২
প্রথম পর্বের সবচেয়ে কঠিন গ্রুপটা এবারও বরাদ্দ রইল বাংলাদেশের জন্য। দুই গ্রুপ সঙ্গী পাকিস্তান ও নিউজিল্যান্ড। ক্যারিবিয়ানে যা–ও একটু প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পেরেছিল বাংলাদেশ, এবার শ্রীলঙ্কায় দুই ম্যাচেই বড় ব্যবধানে হার।
পাল্লেকেলেতে প্রথম ম্যাচে পড়তে হয় ব্রেন্ডন ম্যাককালাম নামের সাইক্লোনের সামনে। উইকেটকিপার ব্যাটসম্যানের ৫৮ বলের ১২৩ রান নিউজিল্যান্ডকে এনে দেয় ১৯১ রান। শেষ ৫ ওভারে নিউজিল্যান্ড তোলে ৬৮ রান। ম্যাচ শেষ সেখানেই। বাংলাদেশ পুরো ২০ ওভার খেলে করে ৮ উইকেট ১৩২ রান।
পাকিস্তানের বিপক্ষে পরের ম্যাচে ব্যাটিং ভালো হলেও বোলিং রইল আগের মতোই। ফল, ১৭৫ রান করেও ৮ উইকেটে হার। ইমরান নাজিরের (৩৬ বলে ৭২) গড়ে দেওয়া ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে পাকিস্তান ম্যাচ জিতে যায় ৮ বল হাতে রেখে। বাংলাদেশের ইনিংসে ৫৪ বলে ৮৪ রান করেছিলেন সাকিব।
২০১৪
স্বাগতিক: বাংলাদেশ | ধাপ: সুপার টেন | ফল: ম্যাচ ৭, জয় ২, হার ৫
দল বাড়ল, বদলে গেল কাঠামো। সুপার এইটের বদলে চালু হলো সুপার টেন। আটটি দল সরাসরি সুপার টেনে সুযোগ পেলেও স্বাগতিক বাংলাদেশকে প্রথম পর্বের বাধা পেরিয়েই জায়গা করে নিতে হলো সেরা দশে।
প্রথম পর্বে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে সুপার টেনে উঠলেও চট্টগ্রামে বাংলাদেশের অর্জনে কালি ছিটিয়ে দেয় পুঁচকে হংকং। আফগানিস্তান ও নেপালকে উড়িয়ে দেওয়া বাংলাদেশ হেরে বসে হংকংয়ের কাছে। ২৩ রানে শেষ ৭ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশ অলআউট ১০৮ রানে। লক্ষ্যটা ২ বল ও ২ উইকেট হাতে রেখে পেরিয়ে যায় নবাগত হংকং।
ওই ম্যাচের রেশই যেন পুরো সুপার টেন পর্বে ধরে রাখে বাংলাদেশ। চারটি ম্যাচেই বড় ব্যবধানে হারে মুশফিকুর রহিমের দল—ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে ৭৩ রানে, ভারতের কাছে ৮ উইকেটে, পাকিস্তানের কাছে ৫০ রানে ও অস্ট্রেলিয়ার কাছে ৭ উইকেটে। মনে রাখার মতো ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সও ছিল না কারোরই।
২০১৬
স্বাগতিক: ভারত | ধাপ: সুপার টেন |ফল: ম্যাচ ৭, জয় ২, হার ৪, ফল হয়নি ১
র্যাংকিংয়ে পিছিয়ে থাকায় এবারও প্রথম পর্ব পেরিয়ে সুপার টেনে যেতে হয় বাংলাদেশকে। এই বিশ্বকাপেই তামিমের ব্যাটে আন্তর্জাতিক টি–টোয়েন্টিতে প্রথম সেঞ্চুরির দেখা পায় বাংলাদেশ। অবশ্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আক্ষেপও ভারতে অনুষ্ঠিত এই বিশ্বকাপেই।
নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে শুরু করা বাংলাদেশ প্রথম পর্বের শেষ ম্যাচে ওমানকে হারিয়ে টিকিট কাটে সুপার টেনের। ধর্মশালায় ওমানের বিপক্ষে বৃষ্টিবিঘ্নিত সেই ম্যাচে সেঞ্চুরি পেয়ে যান তামিম ইকবাল।
সুপার টেনে বাংলাদেশ গ্রুপ সঙ্গী হিসেবে পায় স্বাগতিক ভারত, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও পাকিস্তানকে। প্রথম দুই ম্যাচে পাকিস্তান ও অস্ট্রেলিয়ার কাছে সহজেই হারা বাংলাদেশের জন্য তৃতীয় ম্যাচটা হয়ে আছে চিরদুঃখের প্রতিশব্দ। বেঙ্গালুরুতে ভারতকে ১৪৬ রানে বেঁধে রাখেন বাংলাদেশের বোলাররা। হার্দিক পান্ডিয়ার করা শেষ ওভারে দরকার ছিল ১১ রান। মুশফিকের টানা দুই চারে সমীকরণটা হয়ে গেল ৩ বলে ২ রান। এরপর শুধুই আক্ষেপ। টানা দুই বলে আউট মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহ। শেষ বলে পড়িমরি দৌড়েও রান নিতে পারলেন না শুভাগত ও মোস্তাফিজ। ফল, ১ রানে হার। এরপর কলকাতায় মোস্তাফিজ ৫ উইকেট নিলেও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৭০ রানে অলআউট হয় বাংলাদেশ।
২০২১
স্বাগতিক: ওমান ও আরব আমিরাত । ধাপ: সুপার টুয়েলভ । ফল: ম্যাচ ৮, জয় ২, হার ৬
সুপার টেনের বদলে চালু হলো সুপার টুয়েলভ পর্ব। তবু র্যাঙ্কিংয়ে পিছিয়ে থাকায় বাংলাদেশকে খেলতে হলো আট দলের প্রথম পর্বে। ওমানে সেই পর্বও বাংলাদেশ শুরু করে স্কটল্যান্ডের কাছে হেরে। পরের ম্যাচে চোখ রাঙিয়েছিল ওমানও। তবে ওমান ও পাপুয়া নিউগিনিকে হারিয়ে সুপায় টুয়েলভে জায়গা করে নেয় বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের সুখস্মৃতি অবশ্য ওমানের প্রথম পর্বেরই। আরব আমিরাতে সুপার টুয়েলভে ছয়টি ম্যাচই হারে মাহমুদউল্লাহর দল। এর মধ্যে শুধু শারজায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচটিতেই যা একটু প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়তে পারে বাংলাদেশ, হারে ৩ রানে। শেষ দুই ম্যাচে তো দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১০০–ই করতে পারেনি বাংলাদেশ। টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের সেরা পারফরমার সাকিব আল হাসান অবশ্য চোটের কারণে ছিলেন না শেষের কয়েকটি ম্যাচে। তবে যাওয়ার আগে টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারির রেকর্ডটা করে যান সাকিব।