ব্লেন্ডার, রাইসকুকার যখন ম্যান অব দ্য মাচের পুরস্কার
মাঠে ক্রিকেটারদের লড়াই যেমন দর্শকদের রোমাঞ্চিত করে, তেমনি ম্যাচ শেষের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানও থাকে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে। ভালো পারফরম্যান্সের স্বীকৃতিস্বরূপ দেওয়া হয় ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার। সাধারণত যিনি ম্যাচ জয়ে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখেন, তাঁর হাতে ওঠে এই পুরস্কার। ম্যাচসেরার পুরস্কার যেকোনো ক্রিকেটারের জন্যই গর্বের বিষয়। পুরস্কার হিসেবে অর্থ, ট্রফি কিংবা উভয়ই দেওয়া হয়। তবে ক্রিকেট ইতিহাসে এমন কিছু অদ্ভুত ও অপ্রত্যাশিত পুরস্কারও দেখা গেছে, যা খেলোয়াড় এবং দর্শকদের মনে বিস্ময় তৈরি করেছে। তেমনই কিছু ব্যতিক্রমী পুরস্কার নিয়ে আজকের আলোচনা।
১. লুক রাইট পেলেন ব্লেন্ডার
তালিকার শুরুতেই আছে বাংলাদেশের নাম। তবে এই শুরুতে থাকা হয়তো পাঠকদের আনন্দ দেবে না। বলছি ২০১৩ সালের ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের একটি ম্যাচের কথা। গাজী ট্যাংক ক্রিকেটার্সের হয়ে খেলতে নেমেছিলেন ইংল্যান্ডের ক্রিকেটার লুক রাইট। শুরুতে ৩৩ রানের বিনিময়ে নেন ৩ উইকেট। তারপর ব্যাট হাতে ঝড় তুলেছিলেন এই ইংলিশ অলরাউন্ডার। আবাহনীর বিরুদ্ধে ৪৯ বলে ৬৬ রান করে দলকে জয় এনে দেন ডানহাতি এই ব্যাটার। অসাধারণ এই অলরাউন্ড পারফরম্যান্সের কারণে ম্যাচসেরার পুরস্কারও পান তিনি। কিন্তু পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে যা ঘটল, তা ছিল কল্পনাতীত। ট্রফি বা অর্থ পুরস্কারের বদলে লুক রাইটের হাতে তুলে দেওয়া হলো একটি ব্লেন্ডার! এমন অপ্রত্যাশিত পুরস্কার পেয়ে লুক রাইট নিজেও বেশ অবাক হয়েছিলেন। পরে এই ঘটনা ক্রিকেট–বিশ্বে বেশ হাস্যরসের সৃষ্টি করে।
২. ঝাই রিচার্ডসনের জুতার ফিতা ও ব্যাটের গ্রিপ
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও যে অদ্ভুত পুরস্কার দেওয়া হতে পারে, তার প্রমাণ ২০১৯ সালে ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার ওয়ানডে সিরিজে। সিরিজের প্রথম ম্যাচে অস্ট্রেলিয়া প্রথমে ব্যাট করে ২৮৮ রান করে। সেই ম্যাচে পেসার ঝাই রিচার্ডসনের বোলিং–তোপে ধ্বসে যায় ভারতের ব্যাটিং লাইনআপ। তাঁর গতির ঝড়ে ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা দিশাহারা হয়ে পড়েন। সে ম্যাচে ১০ ওভার বল করে মাত্র ২৬ রান দিয়ে ৪ উইকেট নেন রিচার্ডসন। স্বভাবতই রিচার্ডসন ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার জেতেন। কিন্তু পুরস্কার হিসেবে তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয় একজোড়া জুতার ফিতা এবং একটি ব্যাটের গ্রিপ! এমন পুরস্কার আন্তর্জাতিক মঞ্চে সত্যিই বিরল। কিছুটা অপ্রত্যাশিতও বটে।
৩. রবিন উথাপ্পার রেসলিং বেল্ট
২০২৩ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে নতুন টি-টোয়েন্টি লিগ শুরু হয়। নাম দেওয়া হয় ইন্টারন্যাশনাল লিগ টি-টোয়েন্টি। পুরস্কারের ক্ষেত্রেও এই টুর্নামেন্টে কিছু নতুন প্রথা চালু হয়। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের মতো এই লিগেও সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক, সর্বোচ্চ উইকেটশিকারিসহ বেশ কয়েকটি অভিনব পুরস্কার চালু করে। তবে এখানে আইপিএলের মতো অরেঞ্জ বা পার্পল ক্যাপ ছিল না। দেওয়া হয়েছিল বিশেষ একধরনের বেল্ট। যারা রেসলিং দেখে অভ্যস্ত, তারা এই বেল্টের সঙ্গে পরিচিত। টুর্নামেন্টে মোট পাঁচ ধরনের বেল্ট দেওয়া হয়। সবুজ, সাদা, কালো, লাল ও নীল বেল্ট। সবুজ বেল্ট দেওয়া হয় টুর্নামেন্টের সবচেয়ে বেশি রান করা ব্যাটসম্যানকে। আর সাদা বেল্ট পান যিনি সবচেয়ে বেশি উইকেট নেন। রবিন উথাপ্পা ৪৬ বলে ৭৯ রানের দারুণ একটা ইনিংস খেলে প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে জেতেন সবুজ বেল্ট। অন্যান্য বেল্টের মধ্যে কালো বেল্ট দেওয়া হয় চ্যাম্পিয়ন দলের মালিককে। লাল বেল্ট পান টুর্নামেন্টের সবচেয়ে মূল্যবান খেলোয়াড়। আর সবশেষ নীল বেল্ট দেওয়া হয় টুর্নামেন্টের সেরা স্থানীয় খেলোয়াড়কে। আরব আমিরাতের কোনো ক্রিকেটারই পান এই পুরস্কার।
৪. এউইন মরগানের রাইসকুকার
এউইন মরগানের এই পুরস্কারের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের নাম। ২০১৩ সালে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ যেন অদ্ভুত পুরস্কার বিতরণের এক উর্বর ক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল। গাজী ট্যাংক ক্রিকেটার্স মুখোমুখি হয়েছিল প্রাইম দোলেশ্বর স্পোর্টিং ক্লাবের। সেদিন ইংল্যান্ডের তারকা ব্যাটসম্যান এউইন মরগান ছিলেন অসাধারণ ফর্মে। ব্যাট হাতে তিনি প্রতিপক্ষের বোলারদের ওপর চড়াও হন এবং ৭১ বলে ৮৪ রানের একটি দারুণ ইনিংস খেলেন। গাজী ট্যাংকের অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহও সেই ম্যাচে হাফ সেঞ্চুরি করেছিলেন। এই দুই ব্যাটসম্যানের চমৎকার ব্যাটিংয়ের ভর করে গাজী ট্যাংক ২৯৫ রান তোলে। জবাবে প্রাইম দোলেশ্বর ২৩৫ রানে অলআউট হয়ে যায়। ম্যাচ শেষে সেরা ম্যাচের পুরস্কার ওঠে মরগানের হাতে। কিন্তু পুরস্কার হিসেবে তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয় একটি রাইসকুকার!
৫. ঝুড়িভর্তি স্ন্যাকস
ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগ শুরু হয় ২০১৩ সালে। এই লিগে স্পনসরদের প্রচারের জন্য বেশ অভিনব পন্থা চালু করেছিল। ২০১৭ সালের আসরে এই লিগের অন্যতম স্পনসর ছিল সানশাইন স্ন্যাকস। তাদের প্রচারণার অংশ হিসেবে ম্যাচের সেরা শট খেলা খেলোয়াড়দের পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হতো সানশাইন স্ন্যাকসের বিভিন্ন ধরনের মুখরোচক খাবারের একটি ঝুড়ি। নিঃসন্দেহে এটি স্পনসরদের জন্য দারুণ প্রচার কৌশল, কিন্তু ক্রিকেটারদের জন্য ট্রফি বা অর্থ পুরস্কারের বদলে স্ন্যাকসের ঝুড়ি পাওয়াটা কতটা আনন্দের ছিল, তা বলা মুশকিল। ড্যারেন ব্রাভো, মার্টিন গাপটিল, অ্যান্টন ডেভচিচের মতো অনেক বিখ্যাত খেলোয়াড় এই পুরস্কার জিতেছিলেন।
ক্রিকেট মাঠের ধুন্ধুমার লড়াইয়ের পর এমন অপ্রত্যাশিত এবং অদ্ভুত পুরস্কারগুলো মাঝেমধ্যে খেলোয়াড় এবং দর্শকদের মুখে হাসি ফোটায়। আয়োজকদের বাজেট স্বল্পতা, কিংবা স্পনসরদের অভিনব প্রচারণার কৌশল—কারণ যাই হোক না কেন, ক্রিকেটের ইতিহাসে এই ব্যতিক্রমী পুরস্কারগুলো হয়তো মানুষ অনেক দিন মনে রাখবে।
সূত্র: ক্রিকট্র্যাকার ডটকম