কেমন হলো বাংলাদেশের আফগান–পরীক্ষা
সামনেই বিশ্বকাপ; দর্শক, সমালোচক থেকে শুরু করে খেলোয়াড়—টাইগারদের নিয়ে আশার শেষ নেই কারোর। ১৯ নভেম্বরের জন্য কেউ কেউ এখন থেকেই লিখতে শুরু করেছেন কাব্যগাথা। যে বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে এত জল্পনা-কল্পনা, তার প্রস্তুতিটাও হওয়া চাই সে রকমই। বাংলাদেশের ইচ্ছা ছিল আফগানিস্তানকে দিয়ে বিশ্বকাপের একটা ড্রেস রিহার্সাল সেরে ফেলার। শিডিউল অনুযায়ী এশিয়া কাপের আগে আর কোনো খেলা নেই টাইগারদের, তাই আফগানিস্তানকে ডেকে তড়িঘড়ি করে সিরিজ আয়োজন। যাতে করে প্রস্তুতিটাও সম্পন্ন হয়, সঙ্গে সঙ্গে আত্মবিশ্বাসটাও বাড়ে। কিন্তু বাড়া ভাতে ছাই ঢেলে দিল আফগানরা।
আফগানদের সঙ্গে শুরুটা হয়েছিল তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ দিয়ে। বৃষ্টিবিঘ্নিত প্রথম ওয়ানডে ম্যাচে জয় তুলে নিল আফগানরা। শোরগোল পড়ে গেল বাংলাদেশের ক্রিকেটে। পরদিনই বোমা ফাটালেন অধিনায়ক তামিম ইকবাল। ঘোষণা দিলেন, বাংলাদেশের জার্সিতে আর থাকছেন না তিনি। বিশ্বকাপের আগে যে দলকে ভাবা হচ্ছিল ডার্ক হর্স, সমর্থকদের শত আশা ভরসার স্থান; তাদের অধিনায়কই কিনা বিশ্বকাপের মাস কয়েক আগে ঘোষণা দিলেন অবসরের।
মুহূর্তের সিদ্ধান্তে ভেঙে পড়ল বাংলাদেশের ক্রিকেট, তামিম ইকবালকে ডেকে পাঠালেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। অধিনায়ককে দলে ফেরানোর শেষ চেষ্টা যেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব ফেরানোর উপায় ছিল না তামিমের। এক দিনের মাথায় ফিরলেনও। কিন্তু তত দিনে নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে দলের আত্মবিশ্বাস। দ্বিতীয় ম্যাচে লজ্জাজনক এক হার দিয়ে প্রথমবারের মতো আফগানিস্তানের কাছে সিরিজ হারের লজ্জা পেল বাংলাদেশ। গত আট বছরে দ্বিতীয় দল হিসেবে বাংলাদেশের দুর্গ ভাঙল আফগানরা। শেষ দলটি ছিল বিশ্বজয়ী ইংল্যান্ড। নিয়মরক্ষার ম্যাচে জয় বাংলাদেশকে শুধু মিথ্যা আশ্বাসই দিল। আফগানিস্তানের কাছে সিরিজ হার নাড়িয়ে দিয়েছে অনেক সমর্থকের আত্মবিশ্বাস। টি-টোয়েন্টি সিরিজে বাংলাদেশের হারের শঙ্কাও জেঁকে বসল সমর্থকদের মনে।
টি-টোয়েন্টিতে বরাবরই শক্তিশালী দল আফগানিস্তান। রশিদ খান, মুজিব-উর-রহমান, রহমানুল্লাহ গুরবাজরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন বিশ্বের বিভিন্ন টি-টোয়েন্টি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলো। রেকর্ডেও আফগানরা যোজন যোজন এগিয়ে। সিরিজের আগে মোট ৯ বার মুখোমুখি হয়েছিল দুই দল। তাতে বাংলাদেশের জয় ছিল মাত্র ৩টিতে। আফগানিস্তানের জয় ৬টিতে। আফগানদের বিপক্ষে কখনোই টি-টোয়েন্টি সিরিজ জেতা হয়নি বাংলাদেশের। সব মিলিয়ে ফেবারিট হিসেবেই সিরিজ শুরু করেছিল রশিদ খানের দল।
সিলেটে অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের লক্ষ্য ছিল একটাই, ব্যর্থ ওয়ানডে সিরিজের পর যেভাবেই হোক টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়।
প্রথম ম্যাচের শুরু থেকেই আফগানদের টুঁটি চেপে ধরল টাইগাররা। ১৪ ওভারে ৫ উইকেট হারিয়ে মাত্র ৮৮ রান। বাকি ছয় ওভার আটকে রাখতে পারলেই নিশ্চিত জয়ের হাতছানি। এরপরেই যেন লাগাম ছেড়ে দিলেন বোলাররা, রান থামল ১৫৪-তে। ব্যাটিংয়ে শুরুতেই ধসে পড়ল বাংলাদেশ। ৭ ওভারে ৪১ রান, তাতেই দুজন প্যাভিলিয়নে। এরপর বৃষ্টি–বাধা। বৃষ্টি যেন নতুন করে প্রাণ দিল বাংলাদেশের ইনিংসে। তাওহিদ হৃদয় আর শামীম পাটোয়ারী পৌঁছে দিলেন জয়ের দ্বারপ্রান্তে।
জিততে দরকার ৬ বলে ৬ রান, হাতে ৫ উইকেট—সহজ সমীকরণ।কিন্তু সহজ গল্পটা কঠিন করা টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের স্বভাব যেন।প্রথম বলে ৪, বাকি রইল ৫ বলে ২।এরপর কী হলো কে জানে! আসা-যাওয়ার মিছিলে শামিল হলেন সবাই।শুরুটা করলেন মিরাজ।শর্ট মিড উইকেটে তুললেন সহজ ক্যাচ।তাঁর পথ ধরে হাঁটলেন তাসকিন।বাংলাদেশের তখন দরকার ৩ বলে ২! বাংলাদেশের প্রত্যেক দর্শকের সামনে তখন ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের স্মৃতি।কীভাবে বাংলাদেশের সেরা দুই ব্যাটসম্যান ক্রিজে থেকেও ৩ বলে ২ নিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন! দ্যেজা ভ্যু দেখার অপেক্ষায় যেন বাংলাদেশ।নাসুম দেখালেনও।এলোপাতাড়ি ব্যাট চালিয়ে থার্ডম্যানে ক্যাচ, করিম জান্নাতকে হ্যাটট্রিক উপহার দিলেন।তাঁর প্রথম হ্যাটট্রিক।অন্য প্রান্তে ৪৭ রানে অপরাজিত তাওহিদ দেখছেন, একের পর এক ব্যাটসম্যানদের আসা-যাওয়ার মিছিল।দরকার ২ বলে ২, শরিফুল কোনো ঝুঁকি নিলেন না।শান্তভাবে ব্যাট চালালেন, বাউন্ডারি মেরে দলকে উপহার দিলেন জয়।সিরিজ হারের শঙ্কা পাকাপাকিভাবে কাটিয়ে ফেলল টাইগাররা।
দ্বিতীয় ম্যাচের শুরুতেই পরিবর্তন। ওপেনার রনি তালুকদারকে বসিয়ে যুক্ত করা হলো আফিফকে। বিপিএলের আফিফ-লিটন জুটি অবশেষে পাখা মেলল টাইগারদের জার্সিতে। অপেক্ষা শুরু ইনিংস শেষের। তার আগেই বোলাররা শুরু করে দিয়েছিলেন নিজেদের কাজ। বৃষ্টি নামার আগেই নিয়েছেন দুই উইকেট। বৃষ্টিতে কাটা গেল ৩ ওভার, অন্যদিকে বাংলাদেশি বোলারদের তোপের মুখে ১৭ ওভার শেষে আফগানদের রান দাঁড়াল ১১৬। ডাকওয়ার্থ লুইস পদ্ধতিতে টার্গেট ১১৯!
লিটন-আফিফ জুটি ফিরিয়ে আনলেন তাঁদের বিপিএলের ফর্ম। পাওয়ারপ্লেতে ৫০ রান, ওপেনিং জুটি ভাঙল ৬৭ রানে। দুই ওভারে তিন উইকেটের পতনের পর হাল ধরলেন তাওহিদ হৃদয় আর অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। একটা সময় মনে হচ্ছিল পেন্ডুলামের মতো দুলছে ম্যাচ। আর তখনই রশিদ খানকে ছয় মেরে ম্যাচকে নিজের আয়ত্তে নিয়ে এলেন সাকিব। তাওহিদ আউট হয়ে গেলেও শামীম পাটোয়ারীকে নিয়ে জয়ের বন্দরে পৌঁছে গেলেন সাকিব। প্রথমবারের মতো আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ জয়ের স্বাদ পেল বাংলাদেশ।
এই নিয়ে টানা চার টি-টোয়েন্টি সিরিজে জয়ের মুখ দেখল বাংলাদেশ। যদিও ফরম্যাটটা ভিন্ন, তবু বিশ্বকাপের আগে আগে এই জয় বাড়তি আত্মবিশ্বাস যোগ করবে খেলোয়াড়দের মনে। এশিয়া কাপের আগে প্রায় দেড় মাসের জন্য ছুটিতে বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের জন্য এই জয়ের গুরুত্ব অনেক বেশিই।