সেই ছবিটা সানজিদার কাছ থেকে নিয়ে গিয়েছিলেন রাজিয়া
সানজিদা আক্তারের খুব আফসোস হচ্ছে। কেন যে সেই ছবির আরেকটা কপি নেই তাঁর কাছে! ভয়ংকর মন খারাপও হচ্ছে তাঁর। ছবিটার আরও একটি কপি পাওয়ার যে কোনোই সম্ভাবনাই নেই। যাঁর সঙ্গে ছবিটা, তিনিই তো নেই দুনিয়ায়।
এক মাসও হয়নি দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন রাজিয়া খাতুন, মেয়েদের জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক খেলোয়াড়। গত ১৪ মার্চ সন্তান জন্ম দিয়ে মৃত্যু হয় রাজিয়ার। তাঁর মৃত্যুর খবর সানজিদা পেয়েছেন কলকাতায় বসে। ভারতের নারী ফুটবল লিগে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের হয়ে খেলতে গিয়েছিলেন জাতীয় দলের এই উইঙ্গার। হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন সানজিদা খবরটা শুনে, ‘আমি খবরটা যখন প্রথম দেখি। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ার পর রাজিয়া সাতক্ষীরায় চলে গিয়েছিল। বিয়েও করেছিল। এত চমৎকার একটা মেয়ে এভাবে মারা যাবে, ভাবতেই পারি না।’
বয়সে প্রায় সমসাময়িক সানজিদা আর রাজিয়া, ‘আমরা একসঙ্গে বয়সভিত্তিক দলে খেলেছি, জাতীয় দলেও খেলেছি। ফর্মের কারণে বাদ পড়েছিল রাজিয়া। ওকে বলেছিলাম, তুই অনুশীলন চালিয়ে যা, আবার ফিরবি, কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সে বাড়িতে ফিরে গিয়ে বিয়ে করল। জানি না, সন্তান জন্ম দিতে মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না।’
রাজিয়ার সঙ্গে একটা ছবি ছিল সানজিদার। ছবিটা প্রিন্ট করানো হয়েছিল। কিন্তু সেটির কোনো কপি নেই। রাজিয়া যাওয়ার সময় নিয়ে গিয়েছিলেন। ছবিটা খুব দেখতে ইচ্ছা করে সানজিদার, ‘রাজিয়ার সঙ্গে আমার ওই একটা ছবিই ছিল। কোনো কপি নেই। কেন যে ওকে দিয়ে দিয়েছিলাম। খুব দেখতে ইচ্ছা করে ছবিটা। ওর সঙ্গে আমার আর কোনো স্মৃতি নেই। ফোনে ওর নম্বরটা সেভ করা আছে। মাঝেমধ্যে খুলে দেখি। আর কোনো রাজিয়াকে যেন এভাবে চলে যেতে না হয়, এটাই চাই।’
রাজিয়ার মৃত্যুই সানজিদাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে সব দিক দিয়ে। সে কারণেই বোধ হয় ঈদ নিয়ে খুব বেশি ভাবনা নেই, ‘কলকাতায় ঈদকে সামনে রেখেই কিছু কেনাকাটা করেছিলাম। এর মধ্যে রাজিয়ার মৃত্যুর সংবাদটা পেয়ে মন ভেঙে গেছে। ঈদ নিয়ে আর ভাবতেই ইচ্ছা করছে না। তবে ছুটিতে বাড়িতে এসেছি যখন, তখন সবাইকে কিছু না কিছু গিফট দেব। নিজের জন্য আর কিছু কিনব না। এখন অন্যকে দিয়েই ঈদের আনন্দ।’
ছোটবেলার ঈদ আর এখনকার ঈদের মধ্যে অনেক পার্থক্য সানজিদার। এখন ঈদকে দায়িত্বই মনে হয় তাঁর, ‘ছুটিতে বাড়িতে এসে ঈদ করি। পুরো সময়টা পরিবারের সঙ্গেই কাটাতে চাই। সবাইকে নিয়েই ঈদ করি। এটাই আনন্দ। ঈদের আনন্দ।’
ঈদে রান্নাবান্নাও করতে হয় সানজিদাকে, ‘খুব বেশি রান্না পারি না, তবে চেষ্টা করি। মাকে সাহায্য করি। নিজেও টুকটাক রান্না করি। সবাই তো খেয়ে ভালোই বলে। তবে আমি স্বীকার করি, রান্না খুব একটা পারি না আমি।’
ভারতের লিগে খেলার অভিজ্ঞতাটা এবার দুর্দান্ত সানজিদার। যদিও তাঁর দল ইস্টবেঙ্গল একেবারেই ভালো করতে পারেনি লিগে, ‘ইস্টবেঙ্গল অনেক দুর্বল দল ছিল অন্যান্য দলের তুলনায়। তারপরও আমরা চেষ্টা করেছি, লড়াই করেছি। দল ভালো না করায় হতাশা আছে আমার, যেকোনো খেলোয়াড়ই নিজের চেয়ে দলের পারফরম্যান্সকে এগিয়ে রাখে। তাই ইস্টবেঙ্গল খারাপ করায় আমি নিজের পারফরম্যান্সকে সামনে আনতে চাই না।’
অনেক দিন পর মেয়েদের ফুটবল লিগ শুরু হবে ঈদের পরপরই। সেটি নিয়ে ভাবছেন সানজিদা। এবার খেলবেন নাসরিন স্পোর্টস একাডেমির হয়ে। গোটা জাতীয় দলই যেন দলে ভিড়িয়েছে এই নাসরিন স্পোর্টস একাডেমি। দলটির হয়ে নতুন ইতিহাস রচনার অপেক্ষায় সানজিদারা, ‘ঈদের পরপরই লিগ। সে কারণে একটু সতর্ক থাকতে হবে, খাওয়াদাওয়ায় বিশেষ করে। এবার নাসরিন স্পোর্টস একাডেমিতে খেলব। সাবিনা আপু, ঋতুপর্ণা মাসুরা, সুমাইয়া, মারিয়া, আনাই—সবাই আছে এই দলে। ভালো দল। চাইব চ্যাম্পিয়ন হতে। বাকিটা মাঠের খেলার ওপর নির্ভর করবে।’
ঈদ আসবে ঈদ যাবে, শুরু হবে লিগ। সানজিদা ব্যস্ত হয়ে যাবেন ফুটবল নিয়ে। কিন্তু ঘুরে–ফিরে রাজিয়া থাকবেন তাঁর মানসপটে, স্মৃতিতে। একসঙ্গে থেকেছেন–খেয়েছেন যাঁর সঙ্গে, তাঁর এভাবে চলে যাওয়া কি সহজে মেনে নেওয়া যায়?
সানজিদা ভুলতেই পারেন না রাজিয়াকে…