ইংলিশ ক্লাব ম্যানচেস্টার সিটি নিজেদের মাঠে একক আধিপত্য বিস্তার করে ম্যাচ জেতে—এটা সবারই জানা। তবে প্রতিপক্ষ যখন স্প্যানিশ জায়ান্ট রিয়াল মাদ্রিদ, ফুটবলপ্রেমীদের ধারণা ছিল লড়াইটা হবে সমানে সমান। কিন্তু মাঠে ওসবের ধার ধারেনি আকাশি–নীল জার্সিধারীরা, সব ধারণাকে স্রেফ তুড়ি মেড়ে উড়িয়ে দিয়েছে পেপ গার্দিওলার দল। কামান দেগে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে রিয়াল মাদ্রিদের বহর।
ম্যাচের ২২ মিনিট ৪২ সেকেন্ডে রিয়াল মাদ্রিদের জালে প্রথমবার বল জড়ান ম্যানচেস্টার সিটির ডান প্রান্তের উইঙ্গার হিসেবে খেলতে নামা বার্নারডো সিলভা। কিন্তু এর আগে ৮১ শতাংশ বল পজেশন নিয়ে রিয়ালকে কোণঠাসা করে রেখেছিল সিটিজেনরা। রিয়ালের মাত্র ২৮টি পাসের বিপক্ষে নিজেরা সাজিয়েছিল ২০২টি পাসের পসরা। আর্লিং হলান্ডের দুইটি নিশ্চিত গোলও বাঁচিয়ে দিয়েছেন মাদ্রিদ গোলরক্ষক থিবো কোর্তোয়া। পরিসংখ্যানের এই আধিপত্য কেবল ২২ মিনিটই নয়, পুরো ম্যাচেই বজায় রেখেছিল ম্যানচেস্টার সিটি।
পরিসংখ্যান দিয়েও আসলে সেমিফাইনালের দ্বিতীয় লেগে সিটির আধিপত্য বোঝানো সম্ভব নয়। খাতা–কলমে ৩-২-৪-১ ফরমেশন হলেও ম্যানচেস্টার সিটির কোনো খেলোয়াড়ই নির্দিষ্ট কোনো পজিশনে আটকে ছিলেন না। প্রথাগত ফুলব্যাক/উইংব্যাক ছাড়া এই ফরমেশন এবারের সিজনে পেপ গার্দিওলার অন্যতম সেরা সংযোজন। সেখানে ম্যান-মার্ক করে সিটিকে প্রথম লেগে আটকে ফেলা মাদ্রিদের বিপক্ষে দ্বিতীয় লেগে ছক কাটলেন টোটাল ফুটবল থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে। খুব দ্রুত পাসিং ও পজিশন পরিবর্তন করে নতুন জায়গায় চলে যাওয়া প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের বিভ্রান্ত করতে এটাই ছিল মূলমন্ত্র। সে জন্য ডিফেন্সিভ মিডে থাকা স্টোনস কখনো হয়ে গেছেন রাইট ব্যাক, কখনো আবার সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার। একটু ওপরে থাকা ডি ব্রুইনা, গুন্ডোগানরা তো খেলেছেন প্রায় মাঠজুড়েই! দুই প্রান্তে থাকা জ্যাক গ্রিলিশ ও বার্নারডো সিলভা যখনই সুযোগ পেয়েছেন, ডি-বক্সে ঢুকে সেকেন্ড স্ট্রাইকারের ভূমিকা পালন করেছেন। তাতে হলান্ডকে মার্ক করতে থাকা ব্যস্ত মাদ্রিদ ডিফেন্ডারদের সামনে প্রায় ফাঁকা অবস্থায় বল পেয়ে গেছেন তাঁরা। বার্নারডো সিলভার প্রথম দুটি গোলের পেছনে এটাই ছিল মূল কারণ।
সিটির এমন ফুটবলে প্রথম গোলের পরই হতাশ হয়ে পড়েন ক্রুস-ভিনিসিয়ুসরা। সাইডলাইনে ছুটে গিয়ে কোচ আনচেলত্তিকে তাই জিজ্ঞেসও করেছেন, ‘এখন আমাদের থেকে কী আশা করেন?’
কোনো একটা জবাবে হয়তো নিজের পরিকল্পনা জানিয়েছেন আনচেলত্তি। কিন্তু দ্বিতীয় গোলের পর হতাশা ছুঁয়ে গেছে তাঁকেও! শূন্য দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থেকেছেন ইতিহাদের মাঠের দিকে।
২-০ গোলে পিছিয়ে থেকে প্রথমার্ধ শেষ করলেও, রিয়াল মাদ্রিদের জন্য কোনো আশাই ছিল না। দ্বিতীয়ার্ধেও একই রকম প্রতি-আক্রমণের শিকার হয়েছেন মদরিচ-বেনজেমারা। রিয়াল চেয়েছিল মদরিচ-ক্রুসদের মাধ্যমে মিডফিল্ডের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ম্যানচেস্টার সিটির আক্রমণের লাগাম টেনে ধরতে। কিন্তু সিটির দুর্দান্ত প্রেসিংয়ের সামনে মিডফিল্ডে মাদ্রিদ সুবিধা করে উঠতে পারেনি, দুই উইঙ্গারও নিষ্ক্রিয় হয়ে থেকেছেন রদ্রি-ওয়াকারের দারুণ প্রেসিং-মার্কিংয়ে। বেনজেমাকে বাক্সবন্দী করে রেখেছেন রুবেন ডিয়াস ও আকানজি। উল্টো দিকে দুর্গের মতো কোর্তোয়া দাঁড়িয়ে না থাকলে ব্যবধান হয়তো বেড়ে যেত আরও! হলান্ডের নিশ্চিত তিনটি গোলকে অসম্ভব দক্ষতায় ফিরিয়েছেন তিনি। শেষ পর্যন্ত নিজ দলের ডিফেন্ডার মিলিতাওয়ের আত্মঘাতী গোলে ব্যবধান বাড়ে। বদলি হিসেবে নামা আলভারেজ ঠুকেছেন শেষ পেরেক। ৪-০ গোলের লজ্জা দিয়ে গত শতাব্দীর সেরা ইউরোপিয়ান দলকে বিদায় জানায় ম্যানচেস্টারের আকাশি-নীল পাড়ার দল।
ম্যাচ শেষে আনচেলত্তিও কৃতিত্ব দিলেন প্রতিপক্ষকে, ‘দারুণ ফুটবল খেলেছে, ফাইনালে যাওয়ার পথ প্রথমার্ধেই তৈরি করে ফেলেছিল তারা। গতবার আমরা সেরা ছিলাম, এবার বলতে দ্বিধা নেই—ওরা আমাদের চেয়ে সেরা।’ চ্যাম্পিয়ন লিগ ইতিহাসের সেরা কোচের থেকে পাওয়া প্রশংসা নিশ্চয়ই অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে ইস্তাম্বুলের ফাইনালের জন্য, যেখানে তারা প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে পাচ্ছে ইতালির ক্লাব ইন্টার মিলানকে।