ফ্রান্স ফুটবল কেন ব্যালন ডি’অর দেয়
গত ২৯ অক্টোবর প্যারিসের থিয়েটার দু শাতলেতে বসেছিল ব্যালন ডি’অরের ৬৮তম আসর। মৌসুমের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন এই মঞ্চ থেকেই। ১৯৫৬ সাল থেকে শুরু হয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় বিরতিহীনভাবেই সেরা ফুটবলার নির্বাচনের কাজ করে আসছে ফ্রান্স ফুটবল। কিন্তু কারা এই ফ্রান্স ফুটবল? এত বছর ধরে তারাই কেন নির্বাচন করে আসছে মৌসুমের সেরা খেলোয়াড়ের খেতাব?
ব্যালন ডি’অরের সূচনা খুঁজতে গেলে ফেরত যেতে হবে সেই ১৯৫৫ সালে। সেটাকে ইউরোপিয়ান ফুটবলের দিক বদলে দেওয়া বছর বললেও খুব একটা ভুল হবে না। সে বছরই সূচনা হয়েছিল বর্তমান ইউরোপের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ টুর্নামেন্ট, চ্যাম্পিয়নস লিগের। তখন অবশ্য নাম চ্যাম্পিয়নস লিগ ছিল না, তখন এটাকে ডাকা হতো ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নস কাপ। চ্যাম্পিয়নস লিগ তৈরির পেছনে অন্যতম বড় অবদান ছিল তৎকালীন রিয়াল মাদ্রিদ প্রেসিডেন্ট সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর। আর সান্তিয়াগো বার্নাব্যুকে পেছন থেকে সার্বক্ষণিক সমর্থন দিয়ে এসেছিলেন দুজন। গাব্রিয়েল হ্যানোট আর জ্যাক ফেরান।
ফুটবল ইতিহাসে এই দুজন ব্যক্তির কথা বেশ ভালোভাবেই মনে রাখতে হবে। খেলোয়াড়ি জীবনে গ্যাব্রিয়েল হ্যানোট ছিলেন ডিফেন্ডার, ফ্রান্সের জার্সিতে অলিম্পিক খেলেছেন, ১২ ম্যাচে করেছেন ৩ গোল। বিমান দুর্ঘটনায় অসময়েই থেমে যায় তাঁর ফুটবল ক্যারিয়ার। ফুটবল ছেড়ে মনোযোগ দেন সাংবাদিকতায়। সেখানেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় জ্যাক ফেরানের। জ্যাক ফেরান পুরোদস্তুর সাংবাদিক। দুজনেই কাজ করতেন আরেক ফ্রেঞ্চ পত্রিকা লে’কিপ-এ। লাতিন আমেরিকায় ঘুরতে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করেন ‘সাউথ আমেরিকান চ্যাম্পিয়নশিপ অব চ্যাম্পিয়নস’ নামের এক টুর্নামেন্ট। যেখানে লাতিন আমেরিকার প্রতিটি দেশ থেকে আসা দল মুখোমুখি হয়েছিল একে অপরের। কেমন হয় যদি একই আয়োজন ইউরোপে করা যায়? সেখান থেকেই সূচনা হয় ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নস কাপের। প্রথম টুর্নামেন্টের ড্রাফট থেকে শুরু করে আয়োজন সবটাই ফেরানের অবদান।
হ্যানোট আর ফেরান দুজনের তখন লে’কিপের পাশাপাশি কাজ করতেন ফ্রান্স ফুটবল নামের এক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনে। ফ্রান্স ফুটবলের সূচনা হয়েছিল ১৯৪৬ সালে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মানুষকে ফুটবলের খবরাখবর আর বিশ্লেষণ জানাতে। ‘ট্যুর ডে ফ্রান্স’-এর প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক গডেটের হাত ধরে সূচনা হয় ম্যাগাজিনের। লে’কিপ পত্রিকার সঙ্গে সরাসরি সংযোগ না থাকলেও অনেক সাংবাদিকই কাজ করতেন এই ম্যাগাজিনে।
হ্যানোট আর ফেরানের মাথায় বুদ্ধি খেলে যায় এখান থেকেই। প্রথম ইউরোপিয়ান কাপের আয়োজন শেষ হয়েছে সফলভাবে। শিরোপা জিতে নিয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ। কেমন হয়, যদি এখান থেকেই ইউরোপের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচন করা যায়? যেই ভাবা সেই কাজ। ১০ বছর ধরে প্রতিটি ম্যাচের হিসাব-নিকাশ, খেলোয়াড়দের বিশ্লেষণ সবটাই পুঙ্খনাপুঙ্খভাবে করে আসছে ফ্রান্স ফুটবল। বছরের সেরা খেলোয়াড় বের করতে খুব একটা কাঠখড় পোড়াতে তো হবে না। আবার নিজেরা নিজেরা ঘোষণা দিলেও তো হয় না, সবার সম্মতির ব্যাপারও তো আছে। ইউরোপের বড় বড় পত্রিকার ক্রীড়া সাংবাদিকদের কাছে চিঠি দিল ফ্রান্স ফুটবল। সে বছরের ইউরোপের সেরা তিনজন খেলোয়াড়ের নাম পাঠাতে। প্রথমজনের জন্য ৫ পয়েন্ট, দ্বিতীয়জনের জন্য ৩ ও তৃতীয়জনের জন্য ১ পয়েন্ট।
তবে একটা মানদণ্ড ঠিক করে দিয়েছিল ফ্রান্স ফুটবল। যেহেতু ইউরোপের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার, সেহেতু ইউরোপিয়ান বাদে অন্য কাউকে ভোট দেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। ডি স্তেফানোর ছিল স্প্যানিশ পাসপোর্ট। আর্জেন্টাইন হয়েও মনোনয়ন পেয়েছিলেন তিনি। ইউরোপিয়ান কাপ জিতলেও ইউরোপের সেরা খেলোয়াড় হতে পারেননি স্তেফানো। তাঁকে টপকে ইতিহাসের প্রথম ব্যালন ডি’অর জিতে নিয়েছিলেন ইংলিশ খেলোয়াড় স্ট্যানলি ম্যাথিউস। ৪১ বছর বয়সে জিতে নিয়েছিলেন ইতিহাসের প্রথম ব্যালন ডি’অর। তখন অবশ্য এর নাম ছিল ‘ইউরোপিয়ান ফুটবলার অব দ্য ইয়ার’। আলফ্রেডো ডি স্তেফানোকে ৪৭-৪৪ ভোটে হারিয়ে প্রথম ব্যালন ডি’অর নিজের করে নেন ব্ল্যাকপুলের ফরোয়ার্ড।
১৯৯৫ সালে এসে নিজেদের অবস্থান কিছুটা পরিবর্তন করে ফ্রান্স ফুটবল। ব্যালন ডি’অরকে ইউরোপের কারাগার থেকে মুক্ত করে ছড়িয়ে দেয় পুরো বিশ্বে। প্রথমবারের মতো ইউরোপের বাইরের খেলোয়াড়েরাও পান ব্যালন ডি’অরের মনোনয়ন। তবে মনোনয়ন পাওয়ার জন্য তাঁকে অবশ্যই কোনো ইউরোপিয়ান কাপে খেলতে হবে। সে মৌসুমেই প্রথম ও একমাত্র আফ্রিকান খেলোয়াড় হিসেবে ব্যালন ডি’অর জিতে নেন লাইবেরিয়ার জর্জ উইয়াহ। দুই বছর পর সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে জেতেন রোনালদো নাজারিও।
২০০৭ সালে এসে ব্যালন ডি’অরকে আরও উন্মুক্ত করে দেয় ফ্রান্স ফুটবল। পুরো পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের খেলোয়াড় নিজের যোগ্যতা দিয়ে লড়তে পারবেন ব্যালন ডি’অরের জন্য। কোন দেশের কোন ক্লাবে খেলছেন, তা আর ব্যালন ডি’অরের জন্য মুখ্য নয়। ২০১০ সালে আরও একটি বড় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায় ব্যালন ডি’অর। ফিফার সঙ্গে চুক্তি করে ফিফা ও ফ্রান্স ফুটবল একসঙ্গে নির্বাচন করে বছরের সেরা খেলোয়াড়ের খেতাব। ফলে অ্যাওয়ার্ডের আনুষ্ঠানিক নাম হয় ফিফা ব্যালন ডি’অর। কিন্তু এই পুরস্কার এবার আর সাংবাদিকদের ভোটে নয়, নির্বাচিত হয়েছে কোচ ও অধিনায়কদের ভোটে। ২০১৬ সালে ফিফার সঙ্গে চুক্তি শেষ হলে আবারও পুরোনো নিয়মে ফেরত আসে ব্যালন ডি’অর।
১৯৯৮ সালে ইউরোপিয়ান সেরা খেলোয়াড়ের অ্যাওয়ার্ড নতুনভাবে শুরু করে ইউয়েফা। প্রথমে ইউয়েফা ক্লাব ফুটবলার অব দ্য ইয়ার নামে শুরু করলেও ২০১১ সালে নাম বদলে হয় ইউয়েফা মেন’স প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার। সাংবাদিকদের ভোটে নির্বাচন করা হতো ইউরোপের সেরা খেলোয়াড়। এই বছর থেকে ফ্রান্স ফুটবলের সঙ্গে চুক্তি করে ব্যালন ডি’অর ও ইউয়েফা মেন’স প্লেয়ার অব দ্যা ইয়ার একসঙ্গে দেওয়া শুরু করেছে ইউয়েফা।
২০২০ সালে প্রথমবারের মতো আয়োজন করা হয়নি ব্যালন ডি’অরের আসর। করোনা পরিস্থিতিতে বিশ্বের অনেক জায়গাতেই কমিয়ে আনা হয়েছিল ফুটবলের পরিধি। ফ্রান্সই করোনা পরিস্থিতিতে বন্ধ করে দিয়েছিল ফ্রেঞ্চ লিগ। যে কারণে সে বছর দেওয়া হয়নি ব্যালন ডি’অর।
২০২২ সালে আরেকটি বড় পরিবর্তন এনেছে ফ্রান্স ফুটবল। প্রায় ৬৫ বছর ধরে ব্যালন ডি’অর দেওয়া হতো বছরের সেরা খেলোয়াড়কে। তবে গত তিন বছর ধরে মৌসুমের সেরা খেলোয়াড়ের হাতে উঠছে ব্যালন ডি’অর। ব্যালন ডি’অরজয়ীকে তাই আর বছরের সেরা খেলোয়াড় নয়, বরং বলতে হবে মৌসুমের সেরা খেলোয়াড়।
প্রায় চার দশকের কাছাকাছি সময় ধরে ফ্রান্স ফুটবলের ‘অল ইউরোপিয়ান’ নিয়ম অনেকটাই পিছিয়ে দিয়েছিল ব্যালন ডি’অরকে। পেলে, ম্যারাডোনার মতো তারকা খেলোয়াড় কখনো বুঝে পাননি তাঁর প্রাপ্য সম্মান। যদিও ২০১৬ সালে ব্যালন ডি’অরের ৬০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে একটি ইন্টারন্যাশনালাইজড রেভল্যুশন করে ফ্রান্স ফুটবল। ৪০ বছর ধরে ইউরোপের বাইরের যেসব খেলোয়াড় ব্যালন ডি’অর বঞ্চিত ছিলেন, তাঁদের দেওয়া হয় সম্মানসূচক ব্যালন ডি’অর। সে তালিকায় ছিলেন পেলে, ম্যারাডোনা, গারিঞ্চা, মারিও কেম্পেস ও রোমারিওর মতো খেলোয়াড়দের নাম।
৬৮ বছর পেরিয়ে ব্যালন ডি’অর এখন বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়ের মানদণ্ড। কোনো খেলোয়াড়ের হাতে ব্যালন ডি’অর আছে মানেই কখনো না কখনো ফুটবল বিশ্বের সম্রাট ছিলেন তিনি। তবে এত বছর পেরিয়ে গেলেও কম সমালোচনা হয়নি মর্যাদাপূর্ণ এই পুরস্কার নিয়ে। কারও কারও কাছে এটি কোনো পুরস্কার নয় বরং জনপ্রিয়তার প্রতিযোগিতা। ১৯৫৬ থেকে শুরু করে ২০২৪—এই ৬৮ বছরে ব্যালন ডি’অর নিয়ে প্রশ্ন তোলার মানুষ কম হয়নি। আলফ্রেডো ডি স্তেফানো থেকে শুরু করে থিয়েরি অঁরি, ওয়েসলি স্নাইডার, ফ্র্যাংক রিবেরি, ভ্যান ডাইক, রবার্ট লেওয়ান্ডভস্কি কিংবা ভিনিসিয়ুস জুনিয়র। যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও ব্যালন ডি’অর পাননি এমন নামের তালিকাটা বিশাল। তবুও বছর শেষে সব তীক্ষ্ণ নজর রাখেন ফ্রান্সে, পুরো দুনিয়ার চোখে কে হতে যাচ্ছেন বিশ্বের সেরা ফুটবলার। এ বছর এই পুরস্কার উঠেছে স্প্যানিশ মিডফিল্ডার রদ্রির হাতে।