ভিনিসিয়ুস জুনিয়র পাসটা বাড়িয়েছিলেন কিলিয়ান এমবাপ্পের উদ্দেশেই। ঠিকমতো ধরতে না পারায় বলটা পৌঁছায় জুড বেলিংহামের কাছে। মার্ক করা ডিফেন্ডারকে নিয়ে যতক্ষণে টেনে নিচে নামলেন, ততক্ষণে বেলিংহাম একজনকে কাটিয়ে আলতো করে বাড়িয়ে দিয়েছেন বল। ফেলে আসা জায়গা কাভার করে শট। দুই ডিফেন্ডারের মাঝ দিয়ে বল জড়াল জালে। অতঃপর দৌড়ে এসে নিজের ট্রেডমার্ক উদ্যাপন করলেন এমবাপ্পে।
এত দিন পর্যন্ত দৃশ্যটা স্বপ্নই ছিল রিয়াল সমর্থকদের জন্য। বছরের পর বছর একই বৃত্তে ঘুরতে থাকা সমর্থকেরা একটা সময় আশাও ছেড়ে দিয়েছিলেন। ছয় বছর ধরে একই বৃত্তে ঘুরপাক খেয়েছে ফুটবল–বিশ্ব, কিলিয়ান এমবাপ্পে আটকে ছিলেন পিএসজিতে। স্বপ্ন আর সত্যির মাঝে যেন এক অসম বাধা। এমবাপ্পের এই স্বপ্ন ছয় বছরের বললে ভুল হবে, শুরুটা ২০১২ সালে। ফেসবুকে ঘাঁটলে কিলিয়ান এমবাপ্পের বেশ পুরোনো প্রোফাইল পাওয়া যায়। তাতে লেখা Works at Real Madrid CF। রোনালদোর সঙ্গে হাস্যোজ্বল ছবি জ্বলজ্বল করছে তাঁর প্রোফাইলে। ২০১২ সালে ১৪ বছর বয়সে প্রথমবার এসেছিলেন রিয়াল মাদ্রিদে, জিনেদিন জিদানের কথায় ট্রায়ালও নিয়েছিল রিয়াল। কিন্তু যুব দলে জায়গা করে নিতে পারেননি কিশোর এমবাপ্পে। ফ্রান্সে ফিরে যান তিনি, নিজের জাত চেনাতে শুরু করেন মোনাকোতে।
২০১৬-১৭ মৌসুম ছিল এমবাপ্পের ব্রেক আউট সিজন। সবার নজর কাড়তে শুরু করেন এ মৌসুমে। মোনাকোতে অসাধারণ এক মৌসুম কাটানো এমবাপ্পের প্রথম পছন্দ তাই ছিল পুরোনো প্রেম রিয়াল মাদ্রিদ। এটা হওয়াই খুব স্বাভাবিক, রিয়াল মাদ্রিদ তখন ইউরোপের ত্রাস। আইডল ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো তখন বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়, যাঁর ছবি এমবাপ্পের ঘরের প্রতিটি কোণে। কিলিয়ান এমবাপ্পের মন–প্রাণ তখন রিয়াল মাদ্রিদে। কিন্তু বাংলা সিনেমার ভিলেনের মতো বাদ সাধল প্যারিস সেন্ট জার্মেই। ১৭ বছর বয়সী কিলিয়ান এমবাপ্পেকে কিনতে মোনাকোকে ১৮০ মিলিয়ন দিতেও রাজি ছিল তারা। ফলাফল, প্রথমে এক মৌসুমের জন্য ধার; তারপর ১৮০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে পিএসজির কাছে বিক্রি। সেখান থেকে শুরু। তার পর থেকে প্রতিবার দলবদলের মৌসুম এসেছে, রিয়াল-এমবাপ্পে শুধু পত্রিকার কাটতিই বাড়িয়েছে। এডেন হ্যাজার্ডের আগমনে উত্তেজনা একটু কমলেও ‘এমবাপ্পে-রিয়াল সাগা’ নিয়ম করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠত প্রতি মৌসুমেই। লড়াইটা যতটা না রিয়াল মাদ্রিদ আর পিএসজির, তার থেকে বেশি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ আর নাসের আল খেলাইফির ইগোর। দুই প্রেসিডেন্টই ছিলেন নিজেদের জায়গায় অনড়। ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ চান এমবাপ্পেকে সঙ্গে নিয়ে নিজের তৃতীয় গ্যালাক্টিকোস সম্পন্ন করতে। আর নাসের আল খেলাইফি চান এমবাপ্পেকে সঙ্গে নিয়ে ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরতে। দুই মহারথীর লড়াইয়ে আটকে গলার কাঁটা হয়ে বিঁধে ছিলেন এমবাপ্পে। যদিও ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ আস্তে আস্তে নিজের গ্যালাক্টিকোস ঠিকই সাজিয়ে নিচ্ছিলেন, কিন্তু বস্তা বস্তা টাকা ঢেলেও ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্ব নিজের করতে পারছিলেন না নাসের আল খেলাইফি। পেরেজ তাই ছিলেন অপেক্ষায়।
অপেক্ষাটা এমবাপ্পের চুক্তি শেষ হওয়ার। এমবাপ্পে যে পিএসজিতে আজীবন থাকবেন না, সেটা সবাই জানত। আর পিএসজিও যে রিয়াল মাদ্রিদের কাছে এমবাপ্পেকে সহজে ছাড়বে না, সেটাও সবার জানা। একটা উপায়ই বাকি ছিল, চুক্তি শেষে এমবাপ্পেকে বিনা মূল্যে দলে ভেড়ানো। সে অপেক্ষাতেই ছিলেন পেরেজ। এমবাপ্পের চুক্তি ছিল ২০২৪ পর্যন্ত। ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি এমানুয়েল মাখোঁর অনুরোধে ২০২২ সালে দুই বছরের জন্য চুক্তি করেছিলেন এমবাপ্পে। সেটা বাড়ানোর কোনো ইচ্ছাই ছিল না তাঁর, রিয়ালও আগ বাড়িয়ে পিএসজির সঙ্গে দরদাম করতে যায়নি। ফলাফল? চুক্তি শেষ হওয়া মাত্রই রিয়ালে এমবাপ্পে।
জুন ৩, ২০২৪। কিলিয়ান এমবাপ্পের চুক্তি শেষ হয়েছে, দিন তিনেক পার হয়েছে। রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকেরা তখনো নিজেদের ১৫তম চ্যাম্পিয়নস লিগ উদ্যাপনে ব্যস্ত। সঙ্গে রয়েছে এক দশক ধরে মাঝমাঠের হাল ধরে রাখা টনি ক্রুসকে বিদায় দেওয়ার শোক। এরই মাঝে দরজায় কড়া নাড়ল খবর। কিলিয়ান এমবাপ্পে এখন আনুষ্ঠানিকভাবে রিয়াল মাদ্রিদের। তা–ও আবার একদম বিনা মূল্যে। গত ছয় বছরের জল্পনাকল্পনা, প্রতিটি ট্রান্সফার উইন্ডোতে প্রতীক্ষা, পিএসজি-রিয়ালের ‘বিডিং ওয়ার’; সবকিছুর সমাধান মিলল ৩ জুন। এমবাপ্পের রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দেওয়া খুব সম্ভবত ফুটবল–দুনিয়ার সবচেয়ে দুর্লভ দলবদলের একটি, যা বছরের পর বছর ধরে সবাই জানত, কিন্তু আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগ পর্যন্ত কেউ বিশ্বাস করতে পারেননি। কিলিয়ান এমবাপ্পের সঙ্গে রিয়ালের চুক্তিটা পাঁচ বছরের। প্রতিবছর পাবেন ১৫ মিলিয়ন ইউরো। রিয়াল মাদ্রিদের সর্বোচ্চ বেতনধারী হলেও বড় বড় তারকার চেয়ে বেশ পিছিয়েই আছেন তিনি। তবে তাঁকে পুষিয়ে দিয়েছে বোনাস। শুধু রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দেবেন বলে প্রায় ১৫০ মিলিয়ন ইউরোর কাছাকাছি বোনাসও পেয়েছেন তিনি। যদিও টাকার অঙ্কটা কমবেশি হতে পারে, তবে তিন অঙ্ক ছাড়িয়েছে তা নিশ্চিত। ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ প্রতীজ্ঞা করেছিলেন, এমবাপ্পের জন্য পিএসজিকে একটা পয়সাও দেবেন না। সেটির প্রতিফলন ঘটিয়েছেন কাজ দিয়ে।
হতাশাজনক এক ইউরো শেষে ঘোষণা করা হয় এমবাপ্পের প্রেজেন্টেশনের দিন। সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে ৮০ হাজার দর্শকের সামনে এমবাপ্পেকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হবে রিয়াল মাদ্রিদের খেলোয়াড় হিসেবে। যাঁর জন্য এত বছরের অপেক্ষা, তাঁকে দেখার জন্য টিকিট বিক্রি হয়ে গিয়েছিল ১০ মিনিটের মাথায়। একে তো স্পেনের ইউরো জয়ের আনন্দ, সঙ্গে কিলিয়ান এমবাপ্পে—দুইয়ে মিলে মাদ্রিদ সমর্থকদের আনন্দ ছাড়িয়ে গিয়েছিল বহুগুণ। অবশেষে ১৬ জুলাই বার্নাব্যুতে পা রাখলেন এমবাপ্পে, নতুন বার্নাব্যু নতুন করে সেজেছিল নতুন রাজার আগমনে। এর আগেও বার্নাব্যুতে পা পড়েছে, সেটা প্রতিপক্ষ হিসেবে। মাঠ ছেড়েছেন দুয়ো শুনে। এবার আগমন রিয়ালের রাজা হয়ে। অতঃপর ৮০ হাজার মানুষের সামনে রিয়াল মাদ্রিদের জার্সিতে আগমন ঘটল এমবাপ্পের। গায়ে ৯ নম্বর জার্সি, দর্শকদের মুহুর্মুহু চিৎকার আর উল্লাস। সবকিছু মিলিয়ে সবাই যেন ফেরত গিয়েছিল ১৫ বছর আগে। যেখানে একই জার্সি পরে একইভাবে রিয়ালে আগমন ঘটেছিল আরেক মহারথীর। সে আর কেউ নয়, এমবাপ্পের আইডল ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো।
এমবাপ্পে যেন রোনালদোকেই অনুসরণ করলেন। ঠিক সেভাবেই আগমন, অতঃপর পুরো বার্নাব্যুর উদ্দেশ্যে সেই বহু পুরোনো সেই ধ্বনি, যা দিয়ে রোনালদো প্রথম দিনই জিতে নিয়েছিলেন পুরো মাদ্রিদবাসীর মন। ‘উনো, দোস, ত্রেস; আলা মাদ্রিদ’ এমবাপ্পের প্রেমে নতুন করে পরল বার্নাব্যুবাসী।
এরপর পাক্কা এক মাসের অপেক্ষা। এক মাস ধরে রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকেরা অপেক্ষা করেছেন এমবাপ্পেকে রিয়াল মাদ্রিদের জার্সিতে দেখার জন্য। প্রাক্-মৌসুমে বাকি খেলোয়াড়েরা খেললেও এমবাপ্পে ছিলেন ছুটিতে। কিন্তু এই ছুটি বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলতে পারেনি তাঁর পারফরম্যান্সে। প্রমাণ? ইউয়েফা সুপার কাপের ফাইনাল। এমবাপ্পের রিয়ালের জার্সিতে অভিষেক ছিল ইউরোপিয়ান ট্রফির ফাইনালে। যে ইউরোপিয়ান ট্রফি জেতার স্বপ্ন এমবাপ্পের আজীবনের। রিয়ালের জার্সিতে প্রথম ম্যাচেই সে স্বপ্নপূরণ? তা–ও তাঁরই গোলে? স্বপ্নের ষোলকলা পূর্ণ হতো তাতে। আর এমবাপ্পে তো এসেছেনই স্বপ্ন পূরণ করতে। ফাইনালেই গোল, অতঃপর শিরোপা। এমন অভিষেকের কথা হয়তো এত দিন এমবাপ্পে স্বপ্নেই দেখেছেন। সত্যি হয়ে মর্ত্যে নেমে আসবে কে ভেবেছিল! নিজের ক্লাব ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় ট্রফিটা বাগিয়ে নিলেন নিজের অভিষেকেই।
ইউরোপে অভিষেকটা যতটা রঙিন হয়েছিল, লা লিগার পথচলাটা তেমন মসৃণ হয়নি। প্রথম তিন ম্যাচে এমবাপ্পে ছিলেন নিজের ছায়া হয়ে। গোল, অ্যাসিস্ট, কোনো কিছুতেই তাঁর নাম নেই। রিয়ালও নেই তাদের ছন্দে। সব মিলিয়ে নিন্দুকেরা সুযোগ পেয়েছেন, মুখও খুলতে শুরু করেছেন ধীরে ধীরে। কিন্তু কোচ থেকে দর্শক—সবাই ভরসা রেখেছিলেন, এমবাপ্পে ফিরলে নিজের মতো করেই ফিরবেন। লা লিগার লো ব্লকের সঙ্গে মানিয়ে নিতে একটু সময় লাগছে, কিন্তু যখন ফিরবেন, একেবারে ভেঙেচুরেই ফিরবেন। বেতিসের সঙ্গে ফিরলেন সেভাবেই। ২ গোল করে দলকে জিতিয়ে মাঠ ছাড়লেন। রিয়ালে ‘এমবাপ্পে সাগা’ যেন শুরু হলো মাত্র। সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে নিজের ট্রেডমার্ক সেলিব্রেশন সঙ্গে মুহুর্মুহু ধ্বনি। এই ধ্বনি বার্নাব্যুতে কত দিন প্রতিধ্বনিত হয়, সেটাই জানার অপেক্ষা সবার।