রদ্রি কি আসলেই ব্যালন ডি’অরের যোগ্য ছিলেন?
জর্জ উইয়াহর চোখেমুখে ছিল বিস্ময়। ব্যালন ডি’অর বিজয়ীর নাম তাঁর হাতে। অথচ হলজুড়ে বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আরেকটি নাম। এমনটা দেখা যায়নি আগে কখনো। সাধারণত ব্যালন ডি’অর জেতার সপ্তাহখানেক আগেই জয়ীদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয় আমন্ত্রণপত্র, নেওয়া হয় সাক্ষাৎকার। এবার সেটা হয়নি। বরং ফ্রেঞ্চ ফুটবল অপেক্ষা করেছে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। খাম খোলার আগে পর্যন্ত জানার উপায় নেই কে হচ্ছেন এ মৌসুমের ব্যালন ডি’অর বিজয়ী তারকা। আর তাতেই জন্ম নিল সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে জমজমাট ব্যালন ডি’অর অনুষ্ঠানের। সবাইকে চমকে ব্যালন ডি’অর নিজের করে নিলেন স্প্যানিশ মিডফিল্ডার রদ্রিগো হার্নান্দেস কাসকান্তে। ফুটবলপ্রেমীরা অবশ্য তাঁকে চেনেন রদ্রি নামে।
এবারের ব্যালন ডি’অরকে ঘিরে আয়োজনের কমতি ছিল না। উয়েফার সঙ্গে মিলে ভিন্ন কিছু করার পরিকল্পনা ছিল ফ্রেঞ্চ ফুটবলের। এক দশক আগেও ব্যালন ডি’অরকে ঘিরে যে পরিমাণ উত্তেজনা আর আলোচনা ছিল, সেটা কমে গেছে অনেকটাই। প্রথমবারের মতো মেসি-রোনালদো ছাড়া ব্যালন ডি’অর, তাতে সেই পুরোনো আলোচনা–উত্তেজনা সবটাই যেন ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিল তারা। কয়েক বছর ধরে ব্যালন ডি’অর উত্তেজনায় একটু ভাটা পড়েছিল বটে। আগে থেকেই বিজয়ীদের জানিয়ে দেওয়া, সাক্ষাৎ নেওয়া। যতই গোপনীয়তা রক্ষা করার চেষ্টা করা হোক না কেন, জানাজানি হয়েই যেত। তাই এবারের আয়োজন ছিল নিশ্ছিদ্র, খাম খোলার আগে জানার উপায়ই ছিল না কে হতে যাচ্ছেন গত মৌসুমের সেরা খেলোয়াড়।
সবার নজর ছিল রিয়াল তারকা ভিনিসিয়ুস জুনিয়রের দিকে। গত মৌসুমে সব আলো কেড়ে নিয়েছিলেন ২৪ বছর বয়সী এই ব্রাজিলিয়ান। কার্যত একাই রিয়াল মাদ্রিদকে এনে দিয়েছেন চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা। গোলের দেখা পেয়েছেন ফাইনালে, হয়েছেন প্লেয়ার অব দ্য ফাইনাল ও টুর্নামেন্ট। রিয়াল মাদ্রিদের জার্সিতে জিতেছেন লা লিগা, স্প্যানিশ সুপারকোপা। দর্শক–সমর্থক থেকে শুরু করে ফুটবল–পণ্ডিত—সবার পছন্দ ছিলেন ভিনিসিয়ুস জুনিয়র। এমনকি খোদ ম্যানচেস্টার সিটির কোচ পেপ গার্দিওলাও ধরে নিয়েছিলেন, ট্রফি উঠতে যাচ্ছে ভিনিসিয়ুসের হাতেই। যে কারণে সাক্ষাৎকারে সরাসরি বলেই দিয়েছেন, ‘ব্যালন ডি’অর নিয়ে আমি একমুহূর্ত ভাবি না।’ অথচ ভাগ্যের কী ফের, তাঁর দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেনানী, নিজের কার্বনকপি দাবি করেন যাঁকে, সেই রদ্রির হাতেই জায়গা করে নিল স্বর্ণালি গোলকটা।
রদ্রি যে খুব একটা পিছিয়ে ছিলেন, তা নয়। তবে রদ্রি এমন এক পজিশনে খেলেন, যেখানে লাইমলাইটে আসার প্রয়োজনই পড়ে না তাঁর। আড়ালে থেকেই কাজ করে যান তিনি। আর রদ্রি আড়ালে থেকে কাজ করে যেতে পারেন বলেই তাঁর দল খেলে যেতে পারে নিশ্চিন্তে। কথাটা শুধু পেপ গার্দিওলার ম্যানচেস্টার সিটির জন্য নয়, জাতীয় দলের ক্ষেত্রেও সত্য। ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে তাঁর কাজটাই থাকে আড়াল থেকে সবটা সামলে রাখা। দুই দলেই নিজের কাজটা ঠিকভাবে করে এসেছেন রদ্রি। ম্যানচেস্টার সিটির জার্সিতে গত বছর মাত্র একটা ম্যাচ হেরেছেন তিনি, সেটাও এফএ কাপের ফাইনালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে। চ্যাম্পিয়নস লিগে বাদ পড়েছেন রিয়াল মাদ্রিদের কাছে টাইব্রেকারে হেরে (ম্যাচ টাইব্রেকারে গড়ালে সেটি ড্র হিসেবে গণ্য হয়)। জিতেছেন প্রিমিয়ার লিগ আর কারাবাও কাপ। ভিনির সঙ্গে তাঁর লড়াইটা ছিল সমানে সমান।
কিন্তু রদ্রি এগিয়ে গেছেন জাতীয় দলে তাঁর পারফরম্যান্স দিয়ে। কোপা আমেরিকার মতো বড় মঞ্চে নিজেকে মেলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন ভিনি। হলুদ কার্ড দেখে নিষিদ্ধ হয়েছিলেন গুরুত্বপূর্ণ কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে। যার মাশুল দিতে হয়েছে ব্রাজিলকে উরুগুয়ের কাছে টাইব্রেকারে হেরে। অন্যদিকে পুরো ইউরোতে দলের ঢাল হিসেবে দাঁড়িয়ে ছিলেন রদ্রি। চোটের কারণে ফাইনালের প্রথমার্ধ শেষে তাঁকে তুলে নেওয়া হলেও নিন্দুকের নজর এড়িয়ে যাননি এই মিডফিল্ডার। মাত্র ১ গোল করে বাগিয়ে নিয়েছেন ইউরোর সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার। ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হয়েও ৬৩ ম্যাচে নামের পাশে যুক্ত করেছেন ১২ গোল ও ১৫ অ্যাসিস্ট।
ব্যালন ডি’অরের দৌড়ে ছিলেন ইংলিশ মিডফিল্ডার জুড বেলিংহাম, আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার লাওতারো মার্তিনেজ, স্প্যানিশ ডিফেন্ডার দানি কার্ভাহালও। কিন্তু দিন শেষে সবটাই নির্ভর করে ভোটের ওপর। ফিফা র্যাংকিংয়ের শীর্ষ ১০০-তে থাকা প্রতিটি দেশের একজন নির্বাচিত সাংবাদিক পান ভোট দেওয়ার সুযোগ। ৩০ জনের শর্টলিস্ট থেকে বেছে নিতে পারেন যেকোনো ৫ জনকে। প্রথমজন ৬ পয়েন্ট, দ্বিতীয়জন ৪, তৃতীয়জন ৩, চতুর্থ ২ ও পঞ্চম জন পান ১ পয়েন্ট। আর সেখানেই সাংবাদিকেরা বছরের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে বেছে নিয়েছেন রদ্রিকে।
এত গোপনীয়তার পরও আটকে রাখা যায়নি ব্যালন ডি’অর বিজয়ী খেলোয়াড়ের নাম। অনুষ্ঠানের চার-পাঁচ ঘণ্টা আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, ব্যালন ডি’অর জিততে যাচ্ছেন রদ্রি। কানাঘুষা আছে, স্বয়ং ম্যানচেস্টার সিটি থেকেই রিয়াল মাদ্রিদকে জানানো হয়েছে রদ্রির ব্যালন ডি’অর জেতার কথা। সেখান থেকেই সেটা ছড়িয়ে পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এ ছাড়া রোনালদো নাজারিওকে ব্যালন ডি’অর দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ করা হলেও শেষ মুহূর্তে সেটাও বাতিল করা হয়। এতেই মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল ভিনিসিয়ুস নয়, অন্য কারও হাতে উঠছে ব্যালন ডি’অর। অথচ এই ব্যালন নিয়ে ছিল কত না কত পরিকল্পনা। রিয়াল মাদ্রিদ থেকে প্রায় ৫০ জনের বহর তৈরি ছিল প্যারিসের উদ্দেশে রওনা দেওয়ার জন্য। নাইকি, রিয়াল মাদ্রিদ, ব্রাজিল দল, এমনকি ভিনিসিয়ুস জুনিয়রও পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন ব্যালন ডি’অর পার্টির। সবকিছু নস্যাৎ করে উৎসবে মেতেছেন রদ্রি। ১৬ বছর পর প্রিমিয়ার লিগের কোনো তারকার হাতে উঠেছে ব্যালন ডি’অর। সেটাও আবার একজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার। পাদপ্রদীপের আলোর নিচে থাকা রদ্রি, ব্যালন ডি’অর দিয়েই জায়গা করে নিলেন ইতিহাসের পাতায়।