এমন একজন ক্রিকেটারের নাম বলো, যিনি ক্রিকেট–ফুটবল দুইটারই বিশ্বকাপ খেলেছেন? শুনে অবাক হচ্ছ? দুই খেলায় পারদর্শী অনেকেই আছেন। স্কুলজীবনে এবি ডি ভিলিয়ার্স ছিলেন সব খেলার রাজা। কিন্তু বড় হয়ে বেছে নিয়েছেন ক্রিকেটকে। কিন্তু দুই খেলায় শুধু এক্সপার্ট নন, সর্বোচ্চ পর্যায়ে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করা তো চাট্টিখানি কথা নয়। এমন খেলোয়াড় ইতিহাসে একজনই আছেন—এলিস পেরি।
নারী ক্রিকেটের সঙ্গে পরিচয় থাকলে এত দিনে হয়তো এলিস পেরির নামটা মুখস্থ হয়ে যাওয়ার কথা। ক্রিকেটের এমন কোনো ট্রফি নেই, যাতে পড়েনি তাঁর হাতের ছোঁয়া। এমন কোনো রেকর্ড নেই, যাতে নাম লেখাননি তিনি। ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়া নারী দলকে শীর্ষে তোলার নেপথ্যের কারিগর তিনিই। এমনকি এই মার্চ মাসে শেষ হওয়া উইমেন্স প্রিমিয়ার লিগে প্রথমবারের মতো অধরা আইপিএল ট্রফির স্বাদ দিয়েছেন রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুকে। পুরুষ দল গত ১৬ মৌসুমে যা করতে পারেনি, সেটাই সামনে থেকে দায়িত্ব নিয়ে করে দেখিয়েছেন পেরি।
এই অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারের জন্ম ১৯৯০ সালে সিডনিতে। বাকি সবার মতো স্কুলজীবনেই খেলাধুলায় হাতেখড়ি। সেখানেই পরিচয় আরেক ক্রিকেটার অ্যালিসা হিলির সঙ্গে। ব্যাট হাতে বিক্রফট স্কুলের ভরসা ছিলেন দুজনে। হিলি নিজের সম্পূর্ণ মনোযোগ ক্রিকেটে দিলেও পেরি ছড়িয়ে–ছিটিয়ে ছিলেন সবখানে। ক্রিকেট, ফুটবল, অ্যাথলেটিকস—সব জায়গাতেই তাঁর অবাধ বিচরণ। স্কুলজীবনের গণ্ডি পার করার আগেই ডাক আসে অস্ট্রেলিয়া ফুটবল থেকে। ১৬ বছর বয়সে অভিষেক অস্ট্রেলিয়ার অনূর্ধ্ব-২০ ফুটবল দলে। ডিফেন্সে পেরি ছিলেন দারুণ। অনেকেই অস্ট্রেলিয়ার ফুটবলের ভবিষ্যৎ দেখছিলেন তাঁর মাঝে। কিন্তু এর মাঝেই পেরির ডাক আসে জাতীয় ক্রিকেট দল থেকে। অথচ ঘরোয়া দলে ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা দূরে থাক, কোনো সিনিয়র লেভেলে ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতাও ছিল না পেরির। কিন্তু অলরাউন্ডার ক্যাথরিন ফিজপ্যাট্রিকের আকস্মিক অবসরে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট তখন দিশাহারা। তড়িঘড়ি করে তাই পেরিকে মাঠে নামানো। মাত্র ১৬ বছর ৮ মাস বয়সে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চাপিয়ে ইতিহাস গড়েন তিনি। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ২ উইকেট আর ১৯ রান করলেও দলের জয়ের জন্য যথেষ্ট ছিল না সেটা। নিউজিল্যান্ড সিরিজ শেষ হতে না হতেই আরেক জাতীয় দলের চিঠি এসে পৌঁছায় তাঁর হাতে।
ক্রিকেটে অভিষেকের দুই সপ্তাহের মাথায় অস্ট্রেলিয়া জাতীয় ফুটবল দলেও অভিষেক হয় পেরির। ক্রিকেটের মতো অভিষেকটা মলিন হয়নি তাঁর। বরং ডিফেন্ডার পেরি নিজের অভিষেক স্মরণীয় করে রেখেছেন গোল করে, সেটাও ম্যাচের দ্বিতীয় মিনিটেই। শুরু হয় এলিস পেরির দুই নৌকায় পা দিয়ে এক যুগের পথচলা। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ক্রিকেটের প্রতিটি ফরম্যাটে নিয়মিত হয়ে ওঠেন পেরি। একই সঙ্গে চলতে থাকে ফুটবল–যাত্রাও। শুধু জাতীয় দল নয়, একই সঙ্গে ক্রিকেট ও ফুটবলের ঘরোয়া লিগও খেলতেন পেরি। ক্রিকেটে নিউ সাউথ ওয়েলস আর ফুটবলে ক্যানবেরা ইউনাইটেড। শিডিউল ম্যানেজ করে দুই লিগেই সমানভাবে পারফর্ম করতেন তিনি।
২০০৯ সালে প্রথমবারের মতো ক্রিকেট বিশ্বকাপে ডাক পান পেরি। সুযোগ পেয়েই বাজিমাত, উঁচিয়ে ধরেন শিরোপা। ক্রিকেট বিশ্বকাপ শেষে পেরি টার্গেট করলেন ফুটবল বিশ্বকাপ। অসাধারণ এক মৌসুম কাটিয়ে ঠিকই জায়গা করে নিলেন ২০১১ জার্মানি বিশ্বকাপে। নকআউট পর্বে সুইডেনের বিপক্ষে করা একমাত্র গোলটা এসেছিল তাঁর কাছ থেকেই। যদিও সেই গোল শুধু আফসোসই বাড়িয়েছে অস্ট্রেলিয়ার ফুটবলের। কারণ, বিশ্বকাপ দিয়েই একপ্রকার ইতি টানা হয়ে গিয়েছিল পেরির ফুটবল ক্যারিয়ার।
ক্রিকেট-ফুটবল দুটি সম্পূর্ণ আলাদা জীবন একত্রে কাটানো ছিল একপ্রকার অসম্ভব। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলা খেলোয়াড়ের কাছ থেকে সর্বোচ্চটাই চাইবে নিজের দল। কিন্তু দুই খেলাতে সমান মনোযোগ দেওয়া পেরির জন্য ছিল অসম্ভব। আর শিডিউল নিয়ে টানাটানি তো আছেই। পাঁচ দিনের টেস্ট খেলতে গেলে ফুটবল লিগের ম্যাচ মিস দেওয়া ছাড়া উপায় কী? আস্তে আস্তে ফুটবল থেকে মনোযোগ সরে গিয়েছিল পেরির। সেটা খুব ভালোভাবেই ধরতে পেরেছিলেন ক্যানবেরা ইউনাইটেডের কোচ। পেরির সঙ্গে নতুন চুক্তির আগে তাঁর ক্যারিয়ার নিয়ে আলোচনায় বসেন তিনি। কথা একটাই—ক্লাবে নিজের ক্যারিয়ার দীর্ঘায়িত করতে চাইলে ফুটবল বা ক্রিকেট যেকোনো একটাকে বেছে নিতে হবে। আগে থেকেই এমনটা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন, কিন্তু তখনো কোনো খেলাকে বিদায় বলতে প্রস্তুত ছিলেন না পেরি। ক্যানবেরা ইউনাইটেড ছেড়ে সন্ধানে নামেন নতুন ক্লাবের।
পেরির পরিস্থিতি বুঝে তাঁকে দলে টানে সিডনি এফসি। সিডনির ভেতরেই দুই দলের অবস্থান হওয়ায় অনুশীলনের জন্য খুব একটা বেগ পোহাতে হতো না তাঁকে। বরং কাছাকাছি জায়গায় থেকেই ম্যাচের জন্য প্রস্তুত হতে পারতেন তিনি। কিন্তু শিডিউলের সমস্যা ছিল তখনো। প্রায়ই দুই খেলার শিডিউল পড়ত একই দিনে। সেখান থেকে একটাকে বেছে নিতে হতো পেরিকে। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ফুটবল লিগের সেমিফাইনাল আর নিউ সাউথ ওয়েলসের টি-টোয়েন্টি ফাইনাল পড়ে যায় একই দিনে। অনেক দোটানায় ভুগে পেরি বেছে নেন ক্রিকেটকে।
২০১৪ সালেও একই দোটানা। সেবার অবশ্য বেছে নিয়েছিলেন ফুটবল। কিন্তু এত দোটানায় থাকা খেলোয়াড়কে নিয়ে দল সাজাতে বেশ আপত্তি ছিল অস্ট্রেলিয়ার তৎকালীন ফুটবল দলের কোচ হেস্টেন রয়েসের। তাঁর মতে, ‘কেউ যদি বিশ্বমানের খেলোয়াড় হতে চায়, তবে তাকে সেই খেলার পেছনে অনেক সময় ব্যয় করতে হবে। সে সেই সময়টা দিতে পারছে না। যে কারণে এ মুহূর্তে তাকে দলে ডাকা সম্ভব হচ্ছে না।’ এত কিছুর পরও ফুটবলকে ছাড়তে চাননি পেরি। কিন্তু ২০১৫ সালে উইম্যান’স বিগ ব্যাশ লিগের সূচনা হওয়ার পর বদলে যায় পটভূমি। টি-টোয়েন্টি লিগ, জাতীয় লিগ, জাতীয় দল সামলে ফুটবল খেলাটা বেশ কঠিনই হয়ে পরছিল পেরির জন্য। সব ভেবে ২০১৬ সালে ঘোষণা দেন ফুটবল থেকে অবসরের। ২০১৫ সালের ১৩ ডিসেম্বর উইমেনস লিগের হয়ে খেলা ম্যাচটাই হয়ে থাকে তাঁর খেলা শেষ ফুটবল ম্যাচ।
২০১৬ সাল থেকে পেরির ধ্যানজ্ঞান সবটাই ক্রিকেটে। যার ফলাফলও পেয়েছে অস্ট্রেলিয়া। তাঁর ট্রফি কেবিনেটে বিশ্বকাপের সংখ্যা কত জানো? ৮। ২টি ৫০ ওভারের ক্রিকেট বিশ্বকাপ, ৬টি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। নারী ক্রিকেট বিশ্বে দাপট কাকে বলে, তা বুঝিয়ে দিয়েছেন পেরি। ১৫ বছরের ক্যারিয়ারে পেরির গ্রাফটা শুধু ওপরের দিকেই উঠেছে। একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ১০০০ রান ও ১০০ উইকেটের মালিক তিনি। অ্যাশেজে তাঁর করা অপরাজিত ২১৩ রানের ইনিংস, অস্ট্রেলিয়ার নারী ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বোচ্চ। ক্রিকেটে পেরি শুধু দিয়েই গেছেন। ক্রিকেটও তাঁকে দিয়েছে দুই হাত ভরে। গত দশকের সেরা ক্রিকেটার তিনি, সেটাও দুই ফরম্যাটে (ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি)। অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে সর্বোচ্চ ওয়ানডে খেলার রেকর্ড তাঁর দখলে। এমনকি উইমেনস প্রিমিয়ার লিগে বেঙ্গালুরুর ট্রফি না জেতার দুঃখও ভুলিয়েছেন। অর্জনের বাকি রইল আর কী?
পেরিকে ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার ফুটবলও এগিয়ে গেছে অনেক দূর। ২০২৩ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলেছে অস্ট্রেলিয়া। এশিয়া কাপের রানার্সআপ হয়েছে পরপর দুবার। ফুটবল ছাড়লেও ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা কমেনি পেরির। কিন্তু পেরি জানতেন, কোথায় তাঁকে থামতে হবে। ‘আমি যখন প্রথম খেলা শুরু করি, কোনো খেলাই তেমন পেশাদার ছিল না। যে কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দুই খেলা চালিয়ে যাওয়া খুব একটা কঠিন কিছু ছিল না। কিন্তু যতই দিন গেল, দুটি খেলাই সমানভাবে জনপ্রিয় হতে শুরু করল। একই সঙ্গে দুই খেলা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছিল। তাই শেষ পর্যন্ত বেছে নিয়েছি ক্রিকেটকেই।’
পেরির ক্যারিয়ারকে রূপকথার গল্প বললেও কম বলা হবে। এক দশকের কাছাকাছি সময় একই সঙ্গে দুই খেলায় সময় দিয়েছেন, সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিজের দলকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। মানিয়ে নিয়েছেন পরিবর্তনের সঙ্গে। যখন বাধ্য হয়ে এক খেলাতে মনোযোগ দিতে হয়েছে, তখনো শীর্ষস্থানে পৌঁছেছেন নিজের প্রবল ইচ্ছাশক্তি আর পরিশ্রমের জোরে। পেরিকে রূপকথার রানি বলব না তো, কাকে বলব?