বিশ্বকাপের শুরুতে যদি বলা হতো কোয়ার্টার ফাইনাল খেলবে মরক্কো, নিশ্চয়ই তোমরা কেউ বিশ্বাস করতে না।
অবশ্য এটা বিশ্বাস করার মতো কোনো কথাও নয়। মরক্কোর যাত্রা শুরু হয় বেশ কঠিন এক গ্রুপ থেকে। গ্রুপ এফে মরক্কোর সঙ্গে ছিল ক্রোয়েশিয়া, বেলজিয়াম আর কানাডা। যার মধ্যে ক্রোয়েশিয়া খেলেছে গত বিশ্বকাপের ফাইনাল, বেলজিয়াম খেলেছে সেমিফাইনাল। ১৯৮৬ সালের পর প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলতে এলেও সমীহ করার মতো দল কানাডাও। তবে সাধারণ মানুষসহ ফুটবলবোদ্ধা—সবাই ভেবেছিলেন যে এফ গ্রুপ থেকে শেষ ষোলোতে উঠবে বেলজিয়াম আর ক্রোয়েশিয়াই।
কিন্তু সব সমীকরণ বদলে যায় বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার পরপরই। প্রথম ম্যাচে ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গে গোলশূন্য ড্র করে আটলাস লায়ন বলে পরিচিত মরক্কো। ক্রোয়াটদের বিপক্ষে ড্র করার পরও সবাই ধরে নিল, আফ্রিকান দলটির বিপক্ষে পরের ম্যাচে বেলজিয়াম জিতবে স্বাভাবিকভাবেই।
২০১৮ সালের পর এবারও বেলজিয়াম নিয়ে এসেছিল তাদের সোনালি যুগের খেলোয়াড়দের। থিবো কোর্তোয়া, কেভিন ডি ব্রুইনা, এডেন হ্যাজার্ড, থরগ্যান হ্যাজার্ড—কে নেই বেলজিয়ান দলে! যা কেউ ভাবেনি, সেই অকল্পনীয় কাজটিই করে বসে মরক্কো। তারকায় ঠাসা বেলজিয়ামকে ২-০ গোলে হারিয়ে গোটা বিশ্বকে স্তব্ধ করে দেয় তারা। শেষ ষোলো তখন মরক্কোর দৃষ্টির নাগালে। সুযোগটা কাজেও লাগায় দলটি। গ্রুপ পর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচে কানাডাকে ২-১ গোলে হারিয়ে খুব ভালোভাবেই উতরে যায় গ্রুপ পর্ব।
ওদিকে আবার গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে সবাইকে চমকে দিয়ে জাপানের কাছে হেরে বসে স্পেন। গ্রুপ রানারআপ হয়ে শেষ ষোলোতে ওঠায় মরক্কোর বিপক্ষে খেলা পড়ে স্পেনের। অনেকে তো বলেছেন যে শেষ ম্যাচে জাপানের কাছে স্পেন হেরেছে ইচ্ছা করে, যেন শেষ ষোলোতে দুর্বল মরক্কোর বিপক্ষে খেলতে পারে লুইস এনরিকের দল!
তবে তারা যে দুর্বল নয়, তা গতকালই দেখিয়ে দিয়েছে মরক্কো। নির্ধারিত সময়ের পর, অতিরিক্ত সময়েও গোল না হওয়ায় স্পেন-মরক্কোর ম্যাচটি গড়ায় টাইব্রেকারে। সেখানেই বাজিমাত করেন মরক্কোর গোলকিপার। স্পেনের নেওয়া তিনটি পেনাল্টিই ঠেকিয়ে দেন তিনি। ফলে স্পেনকে টাইব্রেকারে ৩-০ গোলে হারিয়ে নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার যোগ্যতা অর্জন করে আফ্রিকার দেশটি।
অনেকেই মরক্কোর এ উত্থানে অবাক হলেও, যাঁরা নিয়মিত ক্লাব ফুটবল অনুসরণ করেন, তাঁদের কাছে এটি বেশ স্বাভাবিক। দলটির একাদশের বেশির ভাগ খেলোয়াড়ই খেলেন ইউরোপের বিভিন্ন নামকরা ক্লাবে। কোনো প্রতিপক্ষ এখনো মরক্কোর জালে কোনো গোল দিতে পারেনি। কানাডার বিপক্ষে যে গোলটি মরক্কো হজম করেছে, সেটি ছিল আত্মঘাতী গোল। আটলাসের সিংহদের ডিফেন্স লাইন কতটা শক্তিশালী, তা বোঝার জন্য এটিই যথেষ্ট। ডিফেন্সের প্রাণ আশরাফ হাকিমি খেলেন পিএসজিতে, নায়েফ খেলেন ওয়েস্ট হ্যামে, নুসায়ের বায়ার্নে আর সাইস খেলেন বেসিকতাসে। এই সবগুলোই ইউরোপের অন্যতম সেরা ক্লাব। যে গোলকিপার গতকাল ঠেকিয়ে দিয়েছেন স্পেনের সব কটি পেনাল্টি, সেই বুনু স্পেনের অন্যতম সফল ক্লাব সেভিয়ার গোলকিপার।
হাকিমিকে যদি দলটির ডিফেন্সের প্রাণ বলা যায়, তাহলে দলটির আক্রমণের নায়ক বলতে হবে হাকিম জিয়েশকে। আয়াক্সে নিজের জাত চিনিয়েছেন জিয়েশ, চেলসিতে এসে যার ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছেন। তবে মরক্কোর অন্যতম সেরা এই খেলোয়াড়ের কিন্তু বিশ্বকাপ খেলারই কথা ছিল না। এ বছরের শুরুতে অনুষ্ঠিত আফ্রিকান কাপ অব নেশনসের জন্য ঘোষিত মরক্কোর দল থেকে বাদ পড়েন জিয়েশ। ফলে অভিমানেই অবসর নিয়ে নেন তিনি। আফকনে তেমন ভালোও করতে পারে না মরক্কো, বাদ পড়ে কোয়ার্টার ফাইনালেই। এরপরই টনক নড়ে দেশটির ফুটবল ফেডারেশনের। কোচকে চাকরিচ্যুত করে বোর্ড। নতুন কোচ হিসেবে আসেন ওয়ালিদ রেগ্রাগুই। এসেই প্রথমে ছুটে যান জিয়েশের কাছে, অনুরোধ করেন অবসর ভেঙে দলে ফিরে আসার জন্য। হতাশ করেন না জিয়েশ, ফিরে আসেন জাতীয় দলে। স্পেনের বিপক্ষে নজর কেড়েছেন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার সোফয়ান আমরাবাতও। পুরো মাঠ দাপিয়ে বেড়িয়েছেন ইতালিয়ান ক্লাব ফিওরেন্তিনার এই ফুটবলার।
ফলে যেমন আন্ডারডগ হিসেবে দেখা হয়েছিল মরক্কোকে, দলটা মোটেও তেমন নয়। বরং বড় দলগুলোর সঙ্গে চোখে চোখ রেখে লড়াই করার মতো অভিজ্ঞ দলই বলতে হবে তাদের। বেলজিয়ামের বিপক্ষে মরক্কোর জয়কে যাঁরা প্রথমে অঘটন বলেছিলেন, তাঁরাও এখন বলতে বাধ্য হচ্ছেন যে যোগ্য দল হিসেবেই জিতেছে তারা।
সেমিফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে মরক্কোর প্রতিপক্ষ ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পর্তুগাল। পর্তুগাল যে এখন আর শুধু রোনালদোনির্ভর নয়, তা প্রমাণিত হয়ে গেছে এ বিশ্বকাপেই। ব্রুনো ফার্নান্দেজ, বার্নার্দো সিলভা, হোয়াও ফেলিক্স, রুবেন দিয়াজ, হোয়াও কানসেলো, গনসালো রামোসদের নিয়ে গড়া দলটি এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিপূর্ণ, অনেক বেশি শক্তিশালী। শেষ ষোলোতে সুইজারল্যান্ডকে ৬-১ গোলে উড়িয়ে দিয়ে নিজেদের শক্তির জানান দিয়েছে ফার্নান্দো সান্তোসের দল। বিশ্বকাপের অন্যতম দাবিদার পর্তুগাল চাইবে কোয়ার্টার ফাইনালেও এ ফর্ম ধরে রাখতে।
কিন্তু ছেড়ে কথা বলবে না মরক্কোও। বিশ্বকাপের ইতিহাসে মাত্র চতুর্থ আফ্রিকান দেশ হিসেবে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠা দেশটি সেমিফাইনালে ওঠার জন্য নিংড়ে দেবে নিজেদের সবটুকু।