আর্জেন্টিনা মানে ফুটবল। আর্জেন্টিনা মানে সারা ‘ফুটবলের ঈশ্বর’ ম্যারাডোনা। আর্জেন্টিনা মানে মেসি, ‘সর্বকালের সেরা’ (গ্রেটেস্ট অব অল টাইম) লিওনেল মেসি। আর্জেন্টিনা মানে লাখো লাখো ফুটবল ফ্যান। ২০২২ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের আর্জেন্টাইন ফুটবলভক্তরা সে দেশের সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন বাংলাদেশের নামও। বাংলাদেশিদের ভালোবাসার জবাবে আর্জেন্টাইনরাও ‘বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের আর্জেন্টাইন ভক্ত’ (Fans argentinos de la selección de cricket de Bangladesh) নামে একটি ফেসবুক গ্রুপ খুলেছে।
বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম জনপ্রিয় ফুটবল দল আর্জেন্টিনা ছাড়া ফুটবল বিশ্বকাপ কল্পনা করা কঠিন। আবার ক্রিকেট বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা খেলছে, এমনটা ভাবাও সহজ নয়। কারণ, দেশটির একটি ক্রিকেট দল থাকলেও খেলাটা সে দেশে মোটেও জনপ্রিয় নয়। অথচ দেশটিতে ফুটবলের আগে ক্রিকেটের প্রচলন ঘটেছিল। হ্যাঁ, অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, দেশটিতে সবার আগে ক্রিকেট খেলার চর্চা ও ক্রিকেট মাঠ গড়ে উঠেছিল, যা এখনো বিদ্যমান। আর আর্জেন্টিনায় অনুষ্ঠিত প্রথম ফুটবল ম্যাচও অনুষ্ঠিত হয়েছিল বুয়েনস এইরেসের ক্রিকেট খেলার মাঠেই।
আর্জেন্টিনায় ক্রিকেট, ফুটবল, রাগবি, ঘোড়দৌড়, টেনিস খেলার প্রচলন হয় ব্রিটিশদের মাধ্যমে। দেশটিতে প্রথম ক্রিকেট খেলার ইতিহাস পাওয়া যায় ১৮০৬ সালে। সে সময় ব্রিটিশরা আর্জেন্টিনা দখল করতে গিয়ে পরাজিত হয়ে ফিরে আসে। সে সময় অবশ্য এলাকাটি আর্জেন্টিনা নয়, রিও দে লা প্লাতা নামে পরিচিত ছিল, ইংরেজরা যাকে রিভার প্লেটের যুদ্ধ নামে অভিহিত করে। এ যুদ্ধে প্রথমে ইংরেজরা বুয়েনস এইরেস ৪৬ দিন দখল করে রাখলেও পরে পরাজিত হয়ে পালিয়ে আসে। সে সময় এ যুদ্ধে বন্দী ইংরেজরা দেশটির উত্তরে অবস্থিত সান আন্তেনিও দে আরেকোতে ক্রিকেট খেলার সূচনা করে।
১৮৩১ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশ নয়, এমন জায়গার মধ্যে আর্জেন্টিনাতেই সবচেয়ে বেশি ব্রিটিশ নাগরিক বাস করত। তাদের মধ্যে একজন জেমস ব্রিটাইন। আর্জেন্টিনার প্রথম ব্যাংক ‘ব্যাংক অব বুয়েনস এইরেস’-এর প্রতিষ্ঠাতা ব্রিটাইন ছিলেন দেশটির অন্যতম প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও ক্রিকেটপ্রেমী। তাঁর উদ্যোগে দেশটিতে বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের (মূলত ব্রিটিশ) মাঝে ক্রিকেট খেলা শুরু হয়। সে সময় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় দেশটিতে একটি ক্রিকেট ক্লাব গঠন করার। দিনটি ছিল ৫ নভেম্বর ১৮৩১। বুয়েনস এইরেসের রেকোলেতা নামক জায়গায় ‘বুয়েনস এইরেস ক্রিকেট ক্লাব’-এর পতাকা ওড়ানো হয়। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে ক্লাবের গোড়াপত্তন হয় ১৮৬৪ সালে। ১৮৬৮ সালে আর্জেন্টিনা জাতীয় ক্রিকেট দল গঠন করা হয়। আর সে বছর দলটি উরুগুয়ে ক্রিকেট টিমের মুখোমুখি হয়।
আর্জেন্টিনায় ফুটবলের যাত্রাও ব্রিটিশদের হাত ধরে। ব্রিটেনের এক কোম্পানি আর্জেন্টিনায় রেললাইন স্থাপন করতে যায়। সেই সঙ্গে নিয়ে যায় একদল ব্রিটিশ কর্মী ও শ্রমিক। সেটা ১৮৬৭ সালের কথা। ব্রিটিশ রেলের ম্যানেজার ও শ্রমিকদের মধ্যে ফুটবল খেলা বেশ জনপ্রিয় ছিল। তারা সে দেশে খালি মাঠ পেলেই ফুটবল নিয়ে খেলায় মেতে উঠত। ক্রমে খেলাটি জনপ্রিয় হতে শুরু করে। ৯ মে ১৮৬৭ থমাস ও জেমস হগ নামের দুই ব্রিটিশ অভিবাসী ফুটবল খেলা নিয়ে বুয়েনস এইরেসে একটি সভার আয়োজন করে। সেই সভায় জন্ম নেয় বুয়েনস এইরেস ফুটবল ক্লাব। সে বছরই ২০ জুন ক্লাবের উদ্যোগে আর্জেন্টিনায় একটি ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করা হয়। এটিই আর্জেন্টিনায় অনুষ্ঠিত প্রথম ফুটবল ম্যাচ হিসেবে স্বীকৃত। এ খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল বুয়েনস এইরেস ক্রিকেট ক্লাব মাঠে।
এরপর আর্জেন্টিনায় ফুটবলকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৮৮৪ সালে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো থেকে আসা শিক্ষক আলেকজান্ডার ওয়াটসন হাটন সে দেশের সেন্ট অ্যান্ড্রুজ স্কুলে ফুটবল খেলা শেখাতে থাকেন। তিনি স্থানীয়দের মাঝে এ খেলাকে জনপ্রিয় করার উদ্যোগ নেন। এ কারণে তাঁকে আর্জেন্টাইন ফুটবলের জনক বলা হয়। ১৯০২ সালে আর্জেন্টিনা জাতীয় ফুটবল দল প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে, বিপক্ষে ছিল তাদের প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচের প্রতিপক্ষ উরুগুয়েই।
ব্রিটিশদের হাত ধরে চালু হওয়া দুটি খেলার প্রথমটি এখনো টিমটিম করে চালু আছে। আর দ্বিতীয়টি তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে দেশটিতে ক্রিকেট খেলা তেমন গতি লাভ করতে না পারলেও সেই বুয়েনস এইরেস ক্রিকেট ক্লাব এখনো টিকে আছে ‘বুয়েনস এইরেস ক্রিকেট অ্যান্ড রাগবি ক্লাব’ নামে। বিপরীতে দেশটিতে ফুটবল খেলা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য যে ক্লাব কাজ শুরু করেছিল, সেই বুয়েনস এইরেস ফুটবল ক্লাব বন্ধ হয়ে যায় ১৮৮১ সালে, অর্থাৎ আর্জেন্টিনা তাদের প্রথম আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলার আগেই।