শুরুটা তো খুব সরল এক উদ্দেশ্যে। গ্যালারিতে বসে ঠিকঠাক চেনা যায় না খেলোয়াড়দের, গায়ের জার্সিতে একটা সংখ্যা থাকলে বুঝতে কিছুটা সুবিধা। কিন্তু সেই সংখ্যাই যে খেলোয়াড়দের সঙ্গে এমন সেঁটে যাবে, কে জানত! ‘সেভেন’ বললে এখন তো আর ‘এইট’ মনে পড়ে না, সবার আগে মাথায় খেলে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো নামটাই। রোনালদো যে ৭ নম্বর জার্সি পরে খেলেন!
১১ নম্বর জার্সিটা ৭ কিংবা ১০–এর মতো অত মহার্ঘ্য হয়ে উঠতে পারেনি ঠিক, তবে এই সংখ্যা পিঠে নিয়ে মাঠ মাতানো ফুটবলার-ক্রিকেটারের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়। কিশোর আলোর ১১তম জন্মদিনে ১১ নম্বর জার্সি পরে দুনিয়া মাতানো ১১ ক্রীড়াবিদকে নিয়েই আমাদের এ আয়োজন।
শুরুতেই একটু চমকে দেওয়া গেল, নাকি? ৭ নম্বর আর ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো সমার্থকই হয়ে গেছে, বানিয়ে ফেলেছেন ‘সিআর সেভেন’ ব্র্যান্ডও, সেই রোনালদোও নাকি খেলেছেন ১১ নম্বর জার্সি পরে! কথা সত্যি, যদিও মাত্র ৪৫ মিনিটের জন্যই। ম্যাচটা ছিল রিয়াল মাদ্রিদ কিংবদন্তি রাউলের বিদায়ী ম্যাচ। তাঁকে সম্মান জানাতেই ঘরের মাঠ সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে কাতারি ক্লাব আল সাদকে আমন্ত্রণ জানায় রিয়াল, রাউলের পরবর্তী গন্তব্য হওয়ার কথা ছিল যেখানে। রোনালদো মাদ্রিদে আসার আগে ৭ নম্বর জার্সিটা রাউলেরই ছিল, ওই বিশেষ দিনে রোনালদো নম্বরটা ছেড়ে দিয়েছিলেন রাউলকে। ম্যাচের প্রথমার্ধে রিয়ালের হয়ে খেলা রাউল তাই চাপিয়েছিলেন ৭ আর রোনালদোর পিঠে জ্বলজ্বল করছিল ১১। তবে দ্বিতীয়ার্ধে ক্লাব বদলে রাউল হয়ে গিয়েছিলেন আল সাদের, নিজের ৭ নম্বর জার্সি ফেরত পেয়েছিলেন রোনালদো। ম্যাচটা রিয়াল জিতেছিল ৫-০ গোলে।
রোনালদো আর করিম বেনজেমার সঙ্গে মিলে রিয়াল মাদ্রিদে যে ‘বিবিসি’ গড়ে তুলেছিলেন গ্যারেথ বেল, তখন বেলের গায়ে উঠেছিল ১১ নম্বর জার্সিই। রিয়ালে আসার আগেই অবশ্য ১১ নম্বর জার্সি গায়ে তুলেছিলেন তিনি। জাতীয় দল ওয়েলসের হয়ে প্রথম ১১ নম্বর পরেছিলেন ২০১০–১১ মৌসুমে, ক্লাবের হয়ে প্রথমবার এর এক বছর পর। সেই থেকে ৫৫৪ ম্যাচ আর ১৮৫ গোলের ক্লাব ক্যারিয়ারের সিংহভাগ খেলেছেন এই নম্বর নিয়েই।
রোনালদোর কথা এল, মেসির কথা না এলে মেসি-ভক্তদের একটু মন খারাপ হতেই পারে। না, মন খারাপের দরকার নেই। মেসি-ম্যারাডোনার কারণে ১০ নম্বর যদি আর্জেন্টিনা সমর্থকদের হৃদয় হয়, তো সেই হৃদয়ের প্রকোষ্ঠে একটু জায়গা ১১ নম্বর জার্সিকেও দিতে হবে। ২০০৮ সালের অলিম্পিক থেকে শুরু করে ২০২১ সালের কোপা আমেরিকা কিংবা ২০২২-এর বিশ্বকাপ, ১১ নম্বর জার্সির আনহেল দি মারিয়াকে ভোলার সুযোগ কোথায় আর্জেন্টাইনদের?
২০, ২২, ১৪, ৩৭—ক্যারিয়ারের শুরুতে নানা সংখ্যা গায়ে জড়ালেও ২০১৫–১৬ মৌসুম থেকে মোটামুটি ১১ নম্বরেই ধাতস্থ তিনি। এই জার্সি পরেই কোপার ফাইনালের পর বিশ্বকাপের ফাইনালে গোল, এর মধ্যে গোল করেছেন ফিনালিসিমাতেও।
বিশ্বকাপে গোলের কথা উঠবে আর মিরোস্লাভ ক্লোসা আসবেন না, তা কি হয়? বিশ্বকাপ ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা ক্লোসা ক্যারিয়ারের বেশির ভাগ সময় গায়ে চাপিয়েছেন ১১ নম্বর জার্সিই। লাৎসিও, বায়ার্ন মিউনিখ, ভেরডার ব্রেমেনে খেলা এই ফুটবলার ৬৬৮ ম্যাচে করেছেন ২৫৮ গোল, রয়েছে ১৩৪ অ্যাসিস্টও।
আফ্রিকান সুপারস্টার দিদিয়ের দ্রগবাও গায়ে চাপাতেন ১১ নম্বর জার্সি। কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিলেন চেলসির জার্সিতে, আইভরি কোস্টকে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে তুলেছিলেন ২০০৬ সালে। সব মিলিয়ে ক্লাবের হয়ে ৬৮৮ ম্যাচে ৩০২ আর জাতীয় দলের হয়ে ১০৫ ম্যাচে ৬৫ গোল করা দ্রগবাকে পৃথিবী মনে রেখেছে মানবিক কারণেও। তাঁর কারণেই তো গৃহযুদ্ধ থেমে গিয়েছিল আইভরিকোস্টে।
এখনকার ফুটবলের পোস্টার বয় হিসেবে কয়েকজনের নাম বললে ‘ইজিপশিয়ান কিং’ মোহাম্মদ সালাহর নাম আসবেই। মিসর দীর্ঘ ২৮ বছর পর রাশিয়া বিশ্বকাপে উঠেছিল তাঁর হাত ধরেই। ক্লাব ফুটবলেও সমান জনপ্রিয় তিনি। চেলসি, রোমার মতো ক্লাবে খেলে এখন মাতাচ্ছেন লিভারপুলের অ্যানফিল্ড। উয়েফা চ্যাম্পিয়ন লিগ, প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা জিতিয়ে এরই মধ্যে ঢুকে গেছেন অল রেডদের হল অব ফেমে।
ফুটবলের মতো ক্রিকেটে জার্সি নম্বর অত প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারেনি কখনোই, টেস্ট ক্রিকেটে জার্সি নম্বর ব্যবহারের প্রচলন শুরুই হলো কয়েক বছর আগে। তবে কিছু কিছু ব্যতিক্রম তো ঘটেছেই। ক্রিকেটারের সঙ্গে সঙ্গে আমরা মনে রেখেছি তাদের জার্সি নম্বরও।
নিখুঁত বোলিংয়ের শেষ কথা বলে মানা গ্লেন ম্যাকগ্রা গায়ে তুলতেন ১১ নম্বর জার্সি। ৫৬৩ টেস্ট আর ৩৮১ টেস্ট উইকেটের মালিক ম্যাকগ্রা অস্ট্রেলিয়াকে জিতিয়েছেন টানা তিনটি বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপে ৩৯ ম্যাচ খেলে নিয়েছেন ৭১ উইকেট, এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ।
সাঙ্গাকারার অনেক পরিচয়। আইনের ছাত্র, সফল মেন্টর, দারুণ ধারাভাষ্যকার...ওহ্, ক্রিকেটটাও একটু ভালোই খেলতেন। প্রায় ৬০০ ম্যাচের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার, রান করেছেন ২৭ হাজারের বেশি। টেস্টে সবচেয়ে কম ইনিংসে ৯, ১০, ১১ আর ১২ হাজার রানের ক্লাবে ঢোকার কৃতিত্ব তাঁর, ওয়ানডে থেকে অবসর নিয়েছেন সবচেয়ে বেশি ডিসমিসালের (৪৮২) রেকর্ড সঙ্গী করে। রঙিন পোশাকে শ্রীলঙ্কার স্বর্ণযুগটাও তাঁর হাতেই লেখা। ২০০৭ আর ২০১১ ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালে তুলেছিলেন দলকে, দ্বিতীয়বার অধিনায়ক হিসেবে। ২০০৯ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনাল হারের দুঃখ ভুলেছিলেন ২০১৪ সালে জিতে।
নিপাট সৌম্যদর্শন ভদ্রলোক বলতে যা বোঝায়, ড্যানিয়েল ভেট্টোরি ছিলেন ঠিক তা-ই। ক্রিকইনফো তো তাঁকে বলছে, ‘একুশ শতকের প্রথম ১৫ বছরে নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে মূল্যবান ক্রিকেটার।’ সর্বকনিষ্ঠ কিউই ক্রিকেটার হিসেবে টেস্টে অভিষেক হয়েছিল তাঁর, খেলে গেছেন ২০১৫ সাল পর্যন্ত। ১৮ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে পেয়েছেন ৭০৫ উইকেট, রয়েছে প্রায় ৭ হাজার রানও। অষ্টম ক্রিকেটার হিসেবে টেস্টে ৩০০ উইকেট আর ৩০০০ রানের ডাবলও আছে তাঁর ঝুলিতে।
এখনো অবসর নেননি, তবে কিংবদন্তিদের তালিকায় নিজের নামটা এরই মধ্যে লিখে ফেলেছেন ভারতীয় এই পেসার। ২০১৩ সালে অভিষেকের পর থেকে ভারতের পেস ইউনিটকে তুলেছেন নতুন উচ্চতায়, তাঁর নিখুঁত সিম প্রেজেন্টেশনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ গোটা ক্রিকেট-দুনিয়া। গেল বিশ্বকাপে তো মুড়িমুড়কির মতো উইকেট নিয়ে ঘুম হারাম করেছিলেন প্রতিপক্ষ দলগুলোর, ৭ ম্যাচেই নিয়েছিলেন ২৪ উইকেট। এখন পর্যন্ত ২২৯ টেস্ট উইকেটের মালিক বুটজোড়াকে বিশ্রামে পাঠানোর আগে কপিল দেবকে ছুঁতে পারেন কি না, সেটাই এখন দেখার।
এমনিতে ৭৭ নম্বর জার্সিতেই সাবেক লেফট আর্ম অর্থোডক্স স্পিনার মোহাম্মদ রফিককে চিনে থাকার কথা তোমার। তবে বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপে মোহাম্মদ রফিক গায়ে তুলেছিলেন ১১ নম্বর জার্সি। ইংল্যান্ডের পেস-সহায়ক কন্ডিশনে খুব বেশি ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি, ২ ম্যাচে নিয়েছিলেন ২ উইকেট। তবে এর একটা ছিল ওয়াকার ইউনিসের, বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারিয়ে চমকে দেওয়ার ওই ম্যাচে।