২০১৪ বিশ্বকাপ: আরেক ব্রাজিল-ট্র্যাজেডি
৬৪ বছর পর আবারও বিশ্বকাপ ফিরল ব্রাজিলে। ১৯৫০ সালে শেষবারের মতো নিজেদের দেশে বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ পেয়েছিল ব্রাজিল। সেবার এক ট্র্যাজেডি দিয়ে শেষ হয়েছিল ব্রাজিলের যাত্রা। সেই ট্র্যাজেডির হাত ধরে একে একে পাঁচবার বিশ্বকাপ শিরোপা ঘরে এনেছে সেলেসাওরা। নিজেদের মাটিতে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ আয়োজন তাদের আরেক ট্র্যাজেডির মুখোমুখি করবে, তা হয়তো ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি কেউ।
প্রতি মহাদেশে একটি বিশ্বকাপ—এই মন্ত্র নিয়ে শুরু হওয়া ফিফার বিশ্বকাপ রোটেশন পলিসিতে ৩৬ বছর পর বিশ্বকাপ ফেরে লাতিন আমেরিকায়। মূলত রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও অর্থনৈতিক কারণে লাতিন আমেরিকা থেকে অনেক বছর দূরে ছিল বিশ্বকাপ। ২০০৭ সালে সবকিছু ছাপিয়ে ব্রাজিলে বিশ্বকাপ আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয় ফিফা। যদিও বিশ্বকাপের বছরখানেক আগে ব্রাজিলের রাজনৈতিক সহিংসতা চিন্তার ভাঁজ ফেলেছিল ফিফার কপালে। কিন্তু তা সহজেই কাটিয়ে ওঠে তারা। বিশ্বকাপ ইতিহাসের অন্যতম স্মরণীয় এক বিশ্বকাপ উপহার দেয় বিশ্বকে।
এই বিশ্বকাপে যুক্ত হয় নানা রকম প্রযুক্তি। ২০১০ বিশ্বকাপে ল্যাম্পার্ডের গোল বাতিল বিতর্ক থামাতে যুক্ত হয় গোললাইন টেকনোলজি। যাতে বল গোললাইন পার হলেই ভাইব্রেট করে উঠবে রেফারির ঘড়ি। ফলে গোল মিস হওয়ার আর সুযোগই নেই। অন্যদিকে ব্রাজিলের অতিরিক্ত গরম থামাতে যুক্ত হয় কুলিং ব্রেক। দুই অর্ধের ২৫ মিনিট পর ২ মিনিটের কুলিং ব্রেক পাবেন খেলোয়াড়েরা। এ ছাড়া বিশ্বকাপের আগে প্রতিটি খেলোয়াড়ের ডোপ টেস্ট করা হয়, যা নিয়ে বেশ সমালোচনার মুখেও পড়ে ফিফা।
কিন্তু বিশ্বকাপ শুরু হতে না হতেই সব সমালোচনা থেমে যায় নিমেষেই। প্রথম রাউন্ডেই একের পর এক চমক উপহার দেয় বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপজয়ী স্পেন বাদ পড়ে প্রথম পর্বেই। অন্যদিকে বিশ্বকাপের ‘গ্রুপ অব ডেথ’-এ ছিল ইংল্যান্ড, ইতালি, উরুগুয়ে আর কোস্টারিকা। আর এই গ্রুপেই পৃথিবী সাক্ষী হয় অদ্ভুত এক ঘটনার। ইতালিয়ান ডিফেন্ডার জর্জিও কিয়েলিনিকে কামড় দিয়ে বসেন লুইস সুয়ারেজ। কামড়-কাণ্ডে অবাক হয়ে যায় পুরো বিশ্ব। আরও অবাক হয় যখন ইংল্যান্ড, ইতালিকে সরিয়ে পরের পর্বের টিকিট পায় কোস্টারিকা। রাতারাতি বিশ্বকাপের ডার্ক হর্সে বনে যায় কোস্টারিকা। গোলরক্ষক কেইলর নাভাসের অসাধারণ পারফরম্যান্সের সুবাদে জায়গা করে নেয় বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে। দ্বিতীয় কোয়ার্টারে পেনাল্টি থামিয়ে দিলেও নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে আর পেরে ওঠেনি কোস্টারিকা। কোয়ার্টারে শেষ হয় বিশ্বকাপের ডার্ক হর্সদের যাত্রা।
অন্যদিকে স্বাগতিক ব্রাজিলের বিশ্বজয়ের রাস্তায় কাঁটা হয়ে দাঁড়ায় কলম্বিয়ান ফুটবলার হুয়ান জুনিগা। তাঁর করা ফাউলে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যান নেইমার। আর সেই সঙ্গে ব্রাজিলের আশাও। কিন্তু নিজেদের সেরা খেলোয়াড়কে হারিয়ে এভাবে ভেঙে পড়বে ব্রাজিল, তা হয়তো কল্পনাও করেননি কেউ। সেমিতে ব্রাজিলের প্রতিপক্ষ ছিল জার্মানি। বাকিটা তো সবারই জানা। একে একে ব্রাজিলের জালে মোট ৭ গোল দিয়েছিলেন ক্রুস-মুলাররা। প্রতিটি ব্রাজিলিয়ানের মনে দাগ কেটে রয়েছে সেই স্কোরলাইন। শেষ মিনিটে ব্রাজিলের হয়ে একমাত্র গোল করেন অস্কার। কিন্তু তাতে ক্ষত যা হওয়ার, তা হয়েই গিয়েছিল। মারাকানাজোর পর মিনেরাইজো ট্র্যাজেডি হয়ে রইল ব্রাজিলের বিশ্বকাপ ইতিহাসের অংশ। যে অংশটা আজীবন ভুলে থাকতে চাইবে তারা।
ব্রাজিলের পর জার্মানির শিকারে পরিণত হলো আর্জেন্টিনাও। মারাকানার ফাইনালে লেখা হলো আরেক আর্জেন্টাইন ট্র্যাজেডির গল্পগাথা। বিশ্বকাপজুড়েই দুর্দান্ত ফর্মে ছিল জোয়াকিম লোর জার্মানি। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তারা ছিল জায়ান্ট কিলার মুডে। আর বিশ্বকাপ ফাইনালে উঠলে জার্মানির কাঁধে কী ভূত চাপে, তা নিশ্চয় আর বলে দিতে হবে না। ফাইনালে লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনাকে পেয়ে যেন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল তারা। শেষ মিনিট পর্যন্ত স্নায়ু ধরে রেখে সে ফাইনালটাও নিজেদের করে নিল জার্মানি। দুই দলের লড়াই চলছিল সমানে সমানেই। প্রথম ৯০ মিনিট শেষ হয়েছিল গোলশূন্য অবস্থায়। আর্জেন্টিনার স্ট্রাইকারদের একের পর এক মিস সুযোগ করে দিয়েছিল জার্মানিকে। আর ১১৬ মিনিটে সে সুযোগটা ছাড়েননি মারিও গোটশে। এক ভলিতে আর্জেন্টিনার জালে প্রথম ও শেষ পেরেক ঠুকে দেন গোটশে।
গোটশের এক গোলই যথেষ্ট ছিল জার্মানি ইতিহাসে নিজের নাম লেখানোর জন্য। জার্মানির নামের পাশে তিনটি বিশ্বকাপ থাকলেও সব কটি ছিল বার্লিনের পশ্চিম পাশের অর্জন করা শিরোপা। কিন্তু প্রথমবারের মতো অবিভক্ত জার্মানিকে বিশ্বকাপের স্বাদ এনে দিলেন গোটশে। অন্যদিকে লিওনেল মেসি জায়গা করে নিলেন পুসকাস, ক্রুইস, ম্যারাডোনার সঙ্গে ইতিহাসের ছোট্ট তালিকায়, যে মহাতারকাদের হারিয়ে জার্মানি বাড়ি ফিরেছিল বিশ্বকাপ হাতে।
২০১৮ বিশ্বকাপ: রাশিয়ায় ফরাসি বিপ্লব
ফিফার বিশ্বকাপ রোটেশন পদ্ধতি বাতিল হওয়ায় সবার জন্যই সুযোগ ছিল আয়োজক দেশ হওয়ার। স্পেন, নেদারল্যান্ডস ও বেলজিয়ামকে হারিয়ে বিশ্বকাপ আয়োজনের বিড জিতে নেয় রাশিয়া। বিশ্বকাপের ২১তম আসরের জন্য ভেন্যু ঠিক হয় রাশিয়া।
কিন্তু বিশ্বকাপ যত ঘনিয়ে আসতে থাকে, রাশিয়াকে ঘিরে তৈরি হয় সংকট। ২০১৪ সাল থেকেই ইউক্রেন-রাশিয়ার মতবিরোধ চলতে থাকে। এ অবস্থায় রাজনৈতিকভাবে অস্থির একটি দেশে বিশ্বকাপ আয়োজনের বিপক্ষে ভোট দেয় অনেকে। এমনকি ফিফাও দ্রুতগতিতে বিকল্প আয়োজক দেশকে প্রস্তুত থাকতে বলে। এ ছাড়া রাশিয়ার নামে ভোট চুরির অভিযোগ আনে ইংল্যান্ড। সব মিলিয়ে রাশিয়ার বিশ্বকাপ আয়োজন নিয়ে শঙ্কা দেখা দিলেও বিশ্বকাপ ঘনিয়ে আসতে আসতে কেটে যায় সবকিছু।
প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে আনা হয় ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি বা ভিএআর। রেফারিং নিয়ে যাতে কেউ কোনো অভিযোগ তুলতে না পারে, সেটারই চেষ্টা ছিল ফিফার। সফলও হয়েছে অনেকাংশে।
বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় ধাক্কা আসে বাছাইপর্ব থেকেই। দুই ইউরোপিয়ান জায়ান্ট ইতালি আর নেদারল্যান্ডস বিশ্বকাপে নাম লেখানোর আগেই বাদ যায় বিশ্বকাপ থেকে। অন্যদিকে ‘বিশ্বজয়ের অভিশাপ’ মাথায় নিয়ে ফ্রান্স, স্পেনের পর জার্মানিও বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ড থেকেই পথ ধরে বাড়ির।
সবাইকে অবাক করে বিশ্বকাপের সারপ্রাইজ প্যাকেজ হয়ে ওঠে ক্রোয়েশিয়া। লুকা মদরিচ, ইভান রাকিতিচ, মারিও মানজুকিচ; ক্রোয়েশিয়া দলে প্রতিভার অভাব কোনো দিনও ছিল না। কিন্তু একসঙ্গে ক্লিক করতে পারছিল না কোনোবারই। ২০১৮ বিশ্বকাপটা ক্রোয়েশিয়ার জন্য হয়ে গেল সুবর্ণ সুযোগ। আর্জেন্টিনা, নাইজেরিয়া, ইউরোতে চমকজাগানো আইসল্যান্ড—‘গ্রুপ ডি’ গ্রুপ অব ডেথই ছিল। সেখান থেকে সব ম্যাচ জিতে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে নকআউটে চলে গেল ক্রোয়েশিয়া।
গ্রুপ পর্ব ক্রোয়েশিয়ার জন্য যতটা সহজ ছিল নকআউট পর্ব, ছিল ততটাই কঠিন। প্রতিটি ম্যাচের ফলাফলের জন্য পাড়ি দিতে হয়েছে টাইব্রেকারে। আর সেখানে ক্রোয়েশিয়ার অবিসংবাদিত নায়ক হয়ে উঠেছিলেন ৩৩ বছর বয়সী গোলরক্ষক ড্যানিয়েল সুবাসিচ। পরপর দুই ম্যাচে দলকে টাইব্রেকারে রক্ষা করে শুধু ক্রোয়েশিয়া নয়, পুরো বিশ্বের ফুটবল-ভক্তদের মন জয় করে নিয়েছিলেন তিনি। ডেনমার্কের বিপক্ষে তিনটি, রাশিয়ার বিপক্ষে একটি পেনাল্টি ঠেকিয়ে দলকে তুলেছিলেন সেমিফাইনালে। সেমিফাইনালেও ম্যাচ গেছে অতিরিক্ত সময়ে। সেখানে মারিও মানজুকিচের ১১০ মিনিটের গোলে ফাইনাল নিশ্চিত করে ক্রোয়েশিয়া। আর শেষ মিনিটে হ্যারি কেইনের শট থামাতে গিয়ে ডান পায়ের পেশিতে চোট পান ড্যানিয়েল সুবাসিচ। আর সেটাই হয়ে রইল ক্রোয়েশিয়ার জন্য কাল। অপর পাশ থেকে ফাইনালে ওঠা ফ্রান্স ঠিক সেটাকেই ব্যবহার করল।
ফ্রান্সের বিশ্বকাপের রাস্তাটা ক্রোয়েশিয়ার মতো ছিল না। বরং মসৃণ একটা রাস্তা পার করে ফাইনালে এসেছিল তারা। গ্রুপ পর্বে ২ জয়, ১ ড্র নিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবে দ্বিতীয় পর্বে ওঠে ফরাসিরা। এরপর আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে আর বেলজিয়ামকে হারিয়ে ফাইনালে। নকআউটের প্রতিটি ম্যাচেই প্রতিরোধ গড়ে তুললেও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিলেন ১৯ বছর বয়সী কিলিয়ান এমবাপ্পে। গ্রিজমান, এমবাপ্পে জুটি সামনে যাকেই পেয়েছে, তার ওপর দিয়েই চালিয়েছে স্টিমরোলার। গত বিশ্বকাপের রানার্সআপ আর্জেন্টিনা কিংবা বেলজিয়ামের সোনালি প্রজন্ম কেউই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি দিদিয়ের দেশমের ফ্রান্সের সামনে।
২১ শতকের বিশ্বকাপ ইতিহাসের অন্যতম জমজমাট ফাইনাল হয়েছিল ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপে। দুই দলের আপাতদৃষ্টে ছিল না কোনো দুর্বলতা। কিন্তু সেমিফাইনালে ক্রোয়েশিয়ার গোলরক্ষক ড্যানিয়েল সুবাসিচের চোট হয়ে দাঁড়ায় ক্রোয়েশিয়ার বড় বাধা। পেইনকিলার নিয়ে খেলতে নামলেও ডান পাশে ঠিকমতো ঝাঁপ দিতে পারছিলেন না তিনি। ফ্রান্স সে সুযোগটাই নিয়েছে পুরো ম্যাচে।
তবে ফ্রান্সকে ফাইনালে এগিয়ে নিয়েছিলেন কিন্তু ক্রোয়েশিয়ারই একজন, ক্রোয়েশিয়ান স্ট্রাইকার মারিও মানজুকিচ। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ফাইনালে আত্মঘাতী গোল দেখেছিল বিশ্ব। যদিও তার ১০ মিনিটের মাথাতেই পেরিসিচের গোলে সমতায় ফিরেছিল ক্রোয়েশিয়া। ৩৮ মিনিটে পেনাল্টি পায় ফ্রান্স, সেখানে তাদের এগিয়ে নিয়ে যান গ্রিজমান। ৫৯ মিনিটে পগবা আর ৬৫ মিনিটে এমবাপ্পে ক্রোয়েশিয়ার বিশ্বকাপ-স্বপ্নে শেষ পেরেক ঠুকে দেন। যদিও ৬৯ মিনিটে নিজের গোলের প্রায়শ্চিত্ত করেছিলেন মানজুকিচ, কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। ম্যাচ শেষ হয় এমবাপ্পে-গ্রিজমানদের হাতে শিরোপা দিয়েই। দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ জেতে ফ্রান্স; অন্যদিকে অধিনায়ক ও কোচ হিসেবে দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপ শিরোপা উঁচিয়ে ধরেন দিদিয়ের দেশম।