আর্জেন্টিনা আর নেদারল্যান্ডস ফুটবল দলের মধ্যে সবচেয়ে বড় মিল হলো দুই দলই ফুটবল বিশ্বকাপে তিনবার করে রানার্সআপ। আর সবচেয়ে বড় অমিল হলো আর্জেন্টিনার সেই তিনটি রানার্সআপ ট্রফির সঙ্গে দুটি বিশ্বকাপ জয়ের ট্রফি থাকলেও, নেদারল্যান্ডসের বিশ্বকাপ–ভাগ্য আর খোলেনি।
দুই দলের সবচেয়ে বিখ্যাত লড়াইটা নিঃসন্দেহে ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপ ফাইনাল। টোটাল ফুটবলের আবেশে বিশ্ব মাতিয়ে সেবার ফাইনালে উঠে নেদারল্যান্ডস, মুখোমুখি হয় মারিও কেম্পেসের আর্জেন্টিনার। এর চার বছর আগেই স্বাগতিক জার্মানির কাছে ফাইনালে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল ডাচদের। ১৯৭৮ সালে আবারও ফাইনাল এবং আবারও স্বাগতিক দেশের বিপক্ষে হয়তোবা ভালো কিছুর স্বপ্নই দেখছিল তারা, কিন্তু ১২০ মিনিটের সে ফাইনালে ৩-১ গোলে হেরে আবারও স্বপ্নভঙ্গ তাদের।
মজার ব্যাপার হলো বিশ্বকাপে কিন্তু আর্জেন্টিনা আর নেদারল্যান্ডস অনেকটা নিয়মিত প্রতিপক্ষ। ১৯৭৪ সালে বিশ্বকাপ লড়াইয়ে ৪-০ তে জিতেছিল নেদারল্যান্ডস। ১৯৯৮ বিশ্বকাপে শেষ মিনিটের গোলে আয়ালা, জানেত্তি, বাতিস্তুতাদের বিপক্ষে জয়ী হয় বার্গক্যাম্প, সিডর্ফের নেদারল্যান্ডস। ২০০৬ বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে গোলশূন্য ড্রয়ের পর ২০১৪ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে স্নাইডারের পেনাল্টি মিসে ফাইনালে উঠে যায় আর্জেন্টিনা। অবাক করা ব্যাপার হলো ৯০ মিনিটের মধ্যে কখনোই নেদারল্যান্ডসকে হারাতে পারেনি আর্জেন্টিনা। তবে এতটুকু অন্তত নিশ্চিত করে বলা যায়, কোয়ার্টার ফাইনালের জমজমাট একটি ম্যাচ দেখতে যাচ্ছে বিশ্ববাসী।
এবার নজর দেওয়া যাক দুই দলের দিকে। বিশ্বকাপের আগে ইনজুরিতে দল থেকে ছিটকে যান আর্জেন্টাইন মিডফিল্ডার লো সেলসো। তবে তাঁর বদলে খেলা এনজো ফার্নান্দেজ কিন্তু তাঁর অভাব টের পেতে দেননি আর্জেন্টিনাকে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দুর্ভাগ্যজনক আত্মঘাতী গোল বাদে সারা টুর্নামেন্টে তিনি ছিলেন দুর্দান্ত। সঙ্গে আছেন সিজনের শুরু থেকেই ব্রাইটনের হয়ে প্রিমিয়ার লিগ মাতানো ম্যাক অ্যালিস্টার। তবে সমর্থকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে নেদারল্যান্ডস ম্যাচের আগে রদ্রিগো ডি পল এর সম্ভাব্য ইনজুরির খবর। তিনি না খেললে শুরু করতে পারেন পারেদেস। গোলকিপার হিসেবে এমি মার্টিনেজ আর দুই ফুলব্যাক হিসেবে আকুনা আর মলিনার জায়গাটাও নিশ্চিত। তবে প্রশ্ন আছে দুই সেন্টার ব্যাক হিসেবে কারা খেলবেন, তা নিয়ে। রোমেরো আর ওতামেন্দির ওপরই স্কালোনি ভরসা রাখবেন নাকি লিসান্দ্রো মার্টিনেজ শুরু করবেন, সে প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে আর্জেন্টিনার একাদশ ঘোষণার পর। দি মারিয়া চোট কাটিয়ে ফিরেছেন আর্জেন্টিনার ট্রেনিংয়ে। আক্রমণভাগে মেসির পাশাপাশি জুলিয়ান আলভারেজের খেলাটাও অনেকটা নিশ্চিত। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে লাওতারো মার্টিনেজের শিশুসুলভ মিসের পর আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা নিশ্চয় অপেক্ষা করছিলেন এমন খবরের।
আর্জেন্টিনা দলে দু-তিন জায়গাতে অনিশ্চয়তা থাকলেও নেদারল্যান্ডসের একাদশ অনেকটা নিশ্চিতই বলা চলে। সিজনের শুরু থেকেই সর্বোচ্চ গোল এবং অ্যাসিস্টের লড়াইয়ে আর্লিং হলান্ডের বিপক্ষে সমানতালে লড়ছিলেন কোডি গাকপো। ডাচ লিগে ১৪ ম্যাচে ২১ গোল এবং অ্যাসিস্ট যে নিছক দুর্ঘটনা নয়, সেটার প্রমাণ রেখেছেন এবারের বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডসের সেরা খেলোয়াড় হয়ে। বিশ্বকাপের শুরুতে ছন্দে না থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে গোল করে ছন্দে ফেরার ইঙ্গিত দিয়েছেন মেম্ফিস ডিপেই। এই জুটির পেছনে থাকা ক্লাসেন অথবা তাঁরও পেছনে থাকা ফ্রেংকি ডি জং থেকে বলের জোগানটা আসছে নিয়মিতই। ডাচরা মূলত এই বিশ্বকাপে খেলছেন ৩-৪-১-২ ফরমেশনে। এই ফরমেশনে দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন দুই উইংব্যাক। নেদারল্যান্ডস দল এই উইংব্যাকদের সামর্থ্য নিয়ে একদম নিশ্চিন্ত। দ্বিতীয় রাউন্ডের ম্যাচেই যেমন ডামফ্রাইস করেছেন দুই অ্যাসিস্ট, এক গোল সঙ্গে ব্লিন্ডের এক অ্যাসিস্টে আর এক গোল। বলা যায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভালো খেলা যুক্তরাষ্ট্রের হাত থেকে ম্যাচটা ছিনিয়ে নিয়েছেন মূলত এই দুই উইংব্যাক। তিন সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার হিসেবে থাকবেন ফন ডাইক, জুরিয়ান টিম্বার আর নাথান আকে। এর মধ্যে মেসিকে আটকানোর গুরুদায়িত্বটা নিশ্চয় নিবেন ফন ডাইক। মেসির ফুটবল সক্ষমতার বড় প্রমাণ তাঁর ড্রিবলিং। অন্যদিকে ফন ডাইকের রেকর্ড আছে একটানা ৬৫ ম্যাচ তাঁকে কেউ ড্রিবল করতে পারেননি। এ দুই খেলোয়াড়ের মুখোমুখি হওয়াটা যেন রূপকথার দুই শক্তিশালী চরিত্রের মুখোমুখি হওয়ার মতো ব্যাপার-স্যাপার!
খেলোয়াড়ি অভিজ্ঞতার দিক দিয়ে আর্জেন্টিনা বেশ খানিকটা এগিয়ে থাকলেও কোচিং অভিজ্ঞতায় আবার স্কালোনির চাইতে বেশ খানিকটা এগিয়ে ডাচ কোচ লুই ফন গাল। তিনি যখন আয়াক্সকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতান তখনো খেলোয়াড় হিসেবে অভিষেকই হয়নি স্কালোনির। তবে অনভিজ্ঞ স্কালোনি আর্জেন্টিনাকে ২৮ বছর পর ট্রফির (কোপা আমেরিকা) স্বাদ দিলেও ফন গালের সেই অর্জন এখনো হয়ে উঠেনি। তবে ফন গালের সঙ্গে স্কালোনি বাদেও দ্বৈরথ আছে আরেকজন আর্জেন্টাইনের। ২০১৪ সালে রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে যোগ দেন দি মারিয়া। আর সে সময় দলটির কোচ ছিলেন ফন গাল। শুরুটা দুর্দান্ত হলেও একসময় ফর্ম হারায় দি মারিয়া, কোচের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন বিতর্কে। দি মারিয়া মূলত উইঙ্গার হলেও ইউনাইটেডে তাঁকে বেশ খানিকটা নিচে নেমে খেলতে হতো। যা একদমই পছন্দ হয়নি এ আর্জেন্টাইনের। সেই খারাপ হওয়া সম্পর্কের রেশ আছে এখনো। নিশ্চয়ই তাঁরা চাইবেন বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে একজন আরেকজনের বিপক্ষে প্রতিশোধটা নিতে।
আর্জেন্টিনা অথবা নেদারল্যান্ডস, দুই দলের মধ্যে এই বিশ্বকাপের মিলটা হলো অনেকের মতেই তারা নিজেদের সেরা খেলাটা এখনো খেলতে পারেনি। আর্জেন্টিনার বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়ার শেষ ২০ মিনিট অথবা যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে নেদারল্যান্ডসের পারফরম্যান্স কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল সমর্থকদের মনে। তবে আর্জেন্টিনা অথবা নেদারল্যান্ডস, দুই দলেরই তো সামর্থ্য আছে রাজকীয় পারফরম্যান্সে ফলাফল নিজেদের দিকে নিয়ে আসার। কে জানে, হয়তোবা কোয়ার্টার ফাইনালের মহারণের জন্যই নিজেদের সেরাটা জমিয়ে রেখেছে দুই দল।