বিশ্বের অন্যতম বড় ক্রীড়া আসর ফিফা বিশ্বকাপ। অনেক দলই রং ছড়াচ্ছে কাতারে আয়োজিত বিশ্বকাপের এই আসরে। কিন্তু রঙিন আসরের রং খানিকটা ম্লান করে দিয়েছে অভিবাসী শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা।
একজন কিংবা দুজন শ্রমিকের মৃত্যু হলে হয়তো বিষয়টিকে দুর্ঘটনা হিসেবে দেখা যেত। কিন্তু সংখ্যাটি এক কিংবা দুইয়ে সীমাবদ্ধ নয়। ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য কয়েক বছর ধরে স্টেডিয়ামসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন হাজারো শ্রমিক।
যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম গার্ডিয়ান বলছে, ২০১০ সালে কাতার নিশ্চিত হয় যে ২০২২ সালে তারা বিশ্বকাপ আয়োজন করতে যাচ্ছে। এরপর ২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত শুধু ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা থেকে কাতারে যাওয়া সাড়ে ছয় হাজারের বেশি অভিবাসী শ্রমিক মারা গেছেন। এসব শ্রমিকের একটি বড় অংশ মারা গেছেন ফুটবল বিশ্বকাপের বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের কাজ করতে গিয়ে।
তবে মৃত্যুর সংখ্যাটা শুধু এই সাড়ে ছয় হাজারের মধ্যে সীমাবদ্ধ হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, দক্ষিণ এশিয়ার এসব দেশের বাইরে কাতারে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক যান ফিলিপাইন ও কেনিয়া থেকে। এই দুই দেশ থেকে যাওয়া কত শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন, সেটা জানা যায়নি। আবার এমনও নয় যে কাতারের বিশ্বকাপকেন্দ্রিক স্থাপনা নির্মাণের কাজ ২০২০ সালের পর থেমে গেছে। ২০২০ সালের পরও স্থাপনা নির্মাণে শ্রমিকেরা কাজ করেছেন সেখানে। প্রাণও গেছে অনেকের। সেই সংখ্যাও এই সাড়ে ছয় হাজার শ্রমিকের মধ্যে নেই। অর্থাৎ ঠিক কত শ্রমিক এই কাতার বিশ্বকাপ আয়োজনের পেছনে প্রাণ দিয়েছেন, তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায় না।
এই হিসাব না পাওয়া গেলেও একটা পরিসংখ্যান দাঁড় করানোর যায়। বলা হচ্ছে, কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজনের কাজ শুরুর পর প্রতি সপ্তাহে মারা গেছেন ১২ শ্রমিক। মারা যাওয়া এই ১২ শ্রমিক দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দেশের। তার মানে, বাকি দেশগুলোর শ্রমিকদের তথ্য পাওয়া গেলে এই সংখ্যা নিশ্চয়ই আরও বেশি হবে?
ঠিক তা–ই। এমন তথ্যই তুলে ধরেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক এই সংগঠন বলছে, ২০১০ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কাতারে মারা গেছেন ১৫ হাজারের বেশি মানুষ, যাঁরা কাতারের নাগরিক নন। এই যে ১৫ হাজারের হিসাব দেওয়া হয়েছে, সেটা কিন্তু কাতার সরকারের পরিসংখ্যান থেকে নেওয়া। তবে তাঁরা সবাই যে বিশ্বকাপের স্থাপনা নির্মাণে প্রাণ দিয়েছেন এটাও নয়।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে গার্ডিয়ান যখন ওই সাড়ে ছয় হাজার শ্রমিকের মৃত্যুর খবর প্রকাশ করে, তখন হইচই পড়ে যায় বিশ্বজুড়ে। কিন্তু এতে খুব বেশি তোড়জোড় দেখা যায়নি কাতার সরকারের। গার্ডিয়ানের ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর কাতার সরকারের যোগাযোগ দপ্তরের ওয়েবসাইটে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। শ্রমিকদের মৃত্যুর ঘটনায় দুঃখও প্রকাশ করা হয় ওই বিজ্ঞপ্তিতে। কিন্তু সঠিক সংখ্যাটি তারা প্রকাশ করেনি। বিজ্ঞপ্তিতে তারা বলে, ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত খুব অল্পসংখ্যক শ্রমিক মারা গেছেন। পরে অবশ্য কাতার সরকার শ্রমিকের মৃত্যুর একটি সংখ্যা প্রকাশ করে। সরকারের দেওয়া তথ্য অনুসারে, ২০১৪ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত স্টেডিয়ামে কাজ করতে গিয়ে ৩৭ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে শুধু কাজ করার সময় মারা গেছেন মাত্র তিনজন।
স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য কাতারকে নতুন করে সবকিছু তৈরি করতে হয়েছে। কারণ, যেসব দেশ নিয়মিত ফুটবল খেলে না, সেসব দেশে আসলে এমন স্থাপনা থাকার কথা নয়। ইউরোপ ও আমেরিকার কয়েকটি দেশ বাদ দিলে খুব কম দেশই আছে, যাদের ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজনের সক্ষমতা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম সিএনএন বলছে, এই বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য কাতারকে সাতটি স্টেডিয়াম নির্মাণ করতে হয়েছে। এর সঙ্গে পুরোনো যে স্টেডিয়ামে খেলা হচ্ছে, সংস্কার করতে হয়েছে সেটিরও। আর যেনতেন স্টেডিয়াম হলেও তো হবে না। ফিফার নিয়ম আর মান অনুসারে হতে হবে স্টেডিয়ামগুলো। যেমন ফিফার নিয়ম অনুসারে, আয়োজক দেশের এমন স্টেডিয়াম থাকতে হবে, যেখানে ৮০ হাজার দর্শক একসঙ্গে বসে খেলা দেখতে পারবে। এ ছাড়া থাকতে হবে ৬০ হাজার, ৪০ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতাসম্পন্ন স্টেডিয়ামও। কাতারকে এই শর্ত পূরণ করতে হয়েছে। ৩০ হাজার শ্রমিক কাজ করেছেন শুধু এসব স্টেডিয়াম তৈরির জন্য।
আবার স্টেডিয়াম হলেই তো হবে না। খেলোয়াড়, পর্যটকদের জন্য পর্যাপ্ত হোটেল নির্মাণ করতে হয়েছে। বিবিসি বলছে, দেশি–বিদেশি দর্শকদের থাকার জন্য কাতার তৈরি করেছে ১০০টির বেশি হোটেল। দেশটির বিমানবন্দরের ধারণক্ষমতা বাড়াতে হয়েছে। খেলা উপলক্ষে নতুন হাইওয়ে, নতুন রেলওয়ে নেটওয়ার্কও তৈরি করতে হয়েছে। ব্লুমবার্গের দেওয়া তথ্য অনুসারে, ২০১০ সাল থেকে এসব স্থাপনা নির্মাণ ও সংস্কারে কাতার খরচ করেছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। এত অর্থ খরচ করে আর কোনো দেশই বিশ্বকাপ আয়োজন করেনি।
এই যে এত কর্মযজ্ঞ, এটা করতে তো কম শ্রমিক কাজ করেননি। কাতার সরকারের দেওয়া তথ্য অনুসারে, দক্ষিণ এশিয়ার শুধু পাঁচটি দেশ (ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা) থেকে সেখান কাজ করেন প্রায় ১৫ লাখ অভিবাসী। শ্রমিকেরাই যে শুধু কাজ করেন, এমনটি তো নয়। তাঁদের সঙ্গে কাজ করেন প্রকৌশলীরা। তাঁদের চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকেরা কাজ করেন। এত এত মানুষের মধ্যে অনেকেরই রয়েছে কষ্টের স্মৃতি। রয়েছে ভয়ংকর যন্ত্রণার স্মৃতি। বিভিন্ন গণমাধ্যমে শ্রমিক নির্যাতনের টুকরো টুকরো ঘটনা উঠে এসেছে। অনেক শ্রমিক বলেছেন, কাজের সময় তাদের সুপেয় পানি দেওয়া হতো না। ফলে এমন হয়েছে, ভয়ংকর গরমের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে অনেক শ্রমিক অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন। যে ঘরগুলোয় তাদের থাকতে দেওয়া হতো সেগুলো ছিল নোংরা। গাদাগাদি করে অনেক শ্রমিক এক সঙ্গে থাকতে হতো।
কাতারের নিয়ম অনুসারে, ১৫ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বেলা সাড়ে ১১টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত ঘরের বাইরে যারা কাজ করেন তাদের কাজ বন্ধ থাকবে। কারণ এই সময় ভয়ংকর গরম পড়ে। কিন্তু বিশ্বকাপ সংক্রান্ত স্থাপনা নির্মাণে এ নিয়মের তোয়াক্কা করত না অনেক অনেক প্রতিষ্ঠানই। ফলে প্রচন্ড গরমের মধ্যেও তাঁদের কাজ করতে হতো।
আবার সেই গরমের মধ্যে কাজ কম করে বসে থাকারও উপায় ছিল না। কারণ যারা শ্রমিকদের পরিচালনার কাজ করতেন তারা সব সময় ভয় দেখাতেন, কাজ কম করলে বেতন কমে যাবে। এমনকি ‘ওভার টাইমের’ পয়সাও কেটে রাখা হবে। ভয় দেখানো হত দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়ারও।
এখানেই শেষ নয়। কেউ চাইলেই এসব স্থাপনা নির্মাণের কাজ ছেড়ে অন্য কাজে যেতে পারতেন না। যেসব প্রতিষ্ঠান এসব শ্রমিককে কাতারে নিয়ে যেত তারা ওই শ্রমিকের পাসপোর্ট জব্দ করে রেখে দিত। ফলে কেউ চাইলেও কাজ ছাড়তে পারতেন না।
গরমের মধ্যে অতিরিক্ত সময় ধরে কাজ করা। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকার কারণে শ্রমিকদের এমন মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
নেপাল থেকে গিয়েছিলেন গল সিংহ রায়। পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করতেন এডুকেশন সিটি ওয়ার্ল্ডকাপ স্টেডিয়ামে। কাতারে যাওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে তিনি আত্মহত্যা করেন। বাংলাদেশের বাবু শেখ। কাতারে কাজ করার সময় চার মিটার ওপর থেকে পড়ে গিয়ে দৃষ্টি শক্তি হারিয়েছেন তিনি।
ভারতে মধু বল্লাপাল্লির পরিবার এখনো জানে না, তিনি কীভাবে মারা গেছেন। ৪৩ বছরের একজন সুস্থ মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যু কীভাবে হলো, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে তাঁর পরিবার। জানা গেছে, ডরমেটরির কক্ষের মেঝেতে পড়ে ছিল তাঁর মরদেহ।
কাতার এসব মৃত্যুকে স্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করলেও মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে ভিন্ন কথা। তারা বলছে, এসব শ্রমিক স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সময় ধরে গরমের মধ্যে কাজ করতেন। তাঁদের কাজ করতে বাধ্য করা হতো। অনেক সময় বেতন ঠিকঠাক পেতেন না।
মৃত শ্রমিকদের পরিবার এখনো কাতারের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করছে। আবার অনেকেই শুধু জানতে চাইছেন, স্বজনের আসলে কী হয়েছিলে, যে কারণে তিনি মারা গেলেন।
গার্ডিয়ানের ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর অনেকে কাতারের কঠোর সমালোচনা করেছেন। একটি প্রতিবাদ হয়েছিল জার্মানিতে। সেখানে বায়ার্ন মিউনিখ ক্লাবের ম্যাচ চলাকালে দলটির সমর্থকেরা একটি ব্যানার ঝুলিয়েছিলেন স্টেডিয়ামে। এতে লেখা হয়েছিল, বিশ্বকাপ ফুটবলে ৫ হাজার ৭৬০ মিনিট খেলা হবে। এ জন্য ১৫ হাজার মানুষকে জীবন দিতে হলো। লজ্জা হয় না আপনাদের?
মৃতের সংখ্যা কত? এটা ঠাওর করা কঠিন। সেটা সাড়ে ছয় হাজার হোক আর ১৫ হাজার হোক, মৃত্যু তো মৃত্যুই। একটি একটি করে জীবন প্রদীপ নিভে গেছে। থেমে গেছে একেকটি জীবনের গল্প। এক এক করে, একটি একটি করে জীবনের গল্প ফুরিয়ে গেছে। বিশ্বকাপ শেষ হলেই চ্যাম্পিয়নদের নিয়ে আনন্দে মেতে উঠবে মানুষ। মরুর দেশে হারিয়ে যাওয়া জীবনের গল্প কি কেউ মনে রাখবে? কেউ কি কাতারের কাছে এই হিসাব চাইবে?