কাতারের আল থুমামা স্টেডিয়াম আর খলিফা ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়ামের মধ্যে দূরত্ব ১৪ কিলোমিটার। কিন্তু এই দূরত্বটুকুও গতকাল বৃহস্পতিবার এক বিন্দুতে এসে মিলিত হলো। ক্রোয়েশিয়া-বেলজিয়ামকে হটিয়ে মরক্কো গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মাত্র চার ঘণ্টা পর ‘গ্রুপ অব ডেথ’ থেকে স্পেন-জার্মানিকে ছাড়িয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন যে জাপান!
একই সঙ্গে হওয়া দুই গ্রুপ ম্যাচের পরতে পরতে ছিল রোমাঞ্চ। ম্যাচ দুটি চলার সময় চার দলই কোনো না কোনো সময় দ্বিতীয় রাউন্ডে কোয়ালিফাই করছিল, চার দলই কোনো না কোনো সময় গ্রুপ থেকে বাদও পড়ছিল! শেষ পর্যন্ত শেষ বাঁশি বাজার পর নিশ্চিত হলো, গ্রুপ ‘ই’ থেকে দ্বিতীয় রাউন্ডে যাচ্ছে জাপান আর স্পেন। আর টানা দ্বিতীয়বারের মতো প্রথম রাউন্ড থেকেই বাড়ি ফিরছে চারবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন জার্মানি। তাদের সঙ্গী হচ্ছে জাপানকে হারানো কোস্টারিকা।
ম্যাচের প্রথমার্ধ শেষের বাঁশি বাজার সময় ছিল না কোনো চমক। ১-০ গোলে এগিয়ে থেকে এই গ্রুপ থেকে দ্বিতীয় রাউন্ডে যাচ্ছে স্পেন আর জার্মানি। দ্বিতীয় রাউন্ড শুরু হতেই শুরু হয় নাটক। বদলি হিসেবে নেমে জার্মানির বিপক্ষে জয়ের নায়ক ছিলেন রিতসু দোন। গতকাল এ রকম কিছুর আশাতেই হয়তোবা জাপান কোচ তাঁকে নামিয়ে দেন দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই। ৪৮ মিনিটে ইতোর পাসে গোল করে খেলার স্কোরলাইন সমান করেন তিনি। যদিও সেটি আসলেই গোল ছিল নাকি ইতো পাস দেওয়ার আগেই বল মাঠের বাইরে চলে গিয়েছিল, তা নিয়ে বিতর্ক চলছে বেশ। ম্যাচের এই মুহূর্তে ‘ই’ গ্রুপ থেকে তখন দ্বিতীয় রাউন্ডে স্পেন আর জাপান। ৫১ মিনিটে তানাকার বাঁ পায়ের দুর্দান্ত শটে ম্যাচে এগিয়ে যায় তারা। তবে নাটক চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায় অন্য ম্যাচের ৫৮ মিনিটে তেজাদার পর ৭০ মিনিটে কোস্টারিকার ভার্গাস গোল করলে। কারণ, তখন যে গ্রুপ থেকে দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠা দুই দল জাপান আর কোস্টারিকা! কোস্টারিকার ৬ পয়েন্টের বিপক্ষে তাদেরকেই সাত গোল দেওয়া স্পেন তখন বিশ্বকাপ থেকে বাদ! তবে স্পেনের জানে পানি ফেরে জার্মানি ম্যাচে বদলি হিসেবে নেমে ৭৩ আর ৮৫ মিনিটে কাই হাভার্টজ পরপর দুই গোল দিলে। জার্মান ফ্যানরা ততক্ষণে বসে গেছেন স্পেনের গোলের প্রার্থনায়। কারণ, স্পেন আর এক গোল দিলেই যে বেশি গোল দেওয়ার হিসেবে জার্মানি চলে যাবে সেকেন্ড রাউন্ডে। কিন্তু গ্রুপ রানার্সআপ হলে দ্বিতীয় রাউন্ডে প্রতিপক্ষ হিসেবে মরক্কোকে পাওয়া যাবে, এমন সমীকরণের সামনে দাঁড়িয়ে বাকিটা সময় কি একটু গা বাঁচিয়ে খেলল স্পেন, যাতে কপাল পুড়ল জার্মানদের?
এবারের বিশ্বকাপের শুরু থেকেই রোমাঞ্চের পসরা সাজিয়ে বসেছিল গ্রুপ ‘ই’। প্রথম ম্যাচে জাপানের কাছে হারলেও দ্বিতীয় ম্যাচে স্পেনের সঙ্গে ড্র করে তারা। লেরয় সানে খেলার একদম শেষ মুহূর্তে স্পেন গোলকিপার উনাই সিমোনকে না কাটিয়ে গোলপোস্টের দিকে শটটা মারলে হয়তোবা খেলার ফলাফল অন্য রকম হতে পারত। অন্যদিকে স্পেনের কাছে ৭ গোল খাওয়া কোস্টারিকা হারিয়ে দেয় জাপানকে। ফলে প্রথম রাউন্ডের শেষ ম্যাচে যে কেউ বাদ পড়তে পারে, এমন সমীকরণের সামনে এসে দাঁড়ায় চার দল। তারপর তো গত রাতের সেই রূপকথা।
স্পেন বনাম জাপান ম্যাচে স্পেনের ৯৬৯ পাসের বিপরীতে জাপান সফল পাস দিয়েছে মাত্র ১৫৩টি, সফল পাসের হার মাত্র ৬৭ ভাগ। অর্থাৎ জাপানের প্রতি ৩ পাসের মধ্যে ১টি ছিল ভুল পাস। শুনে মনে হতে পারে জাপান কী খারাপটাই না খেলেছে! অথচ জাপানের বিশ্বকাপের ট্যাকটিকসটাই ছিল এমন। একের পর এক লম্বা পাস দিতে থাকবে, অ্যাটাকে থাকা খেলোয়াড়েরা সেই পাস ধরতে পারলে তো হলোই, না পারলে আবার একই চেষ্টা। এ কারণেই হয়তোবা গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন জাপানের সফল পাসের হার এত কম। এ রকম ট্যাকটিকসের ভালো দিক হচ্ছে অনেক ওপরে উঠে ‘ডিফেন্ড’ করা যায়, অর্থাৎ ‘হাই লাইন ডিফেন্স’-এর বিপক্ষে এ রকম ট্যাকটিকস অনেক কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। বিশ্বকাপে কিন্তু সেটাই হলো। জার্মানি আর স্পেনের ‘হাই লাইন ডিফেন্স’ ভেঙে দিল জাপান। কিন্তু কোস্টারিয়ার ‘লো ব্লক ডিফেন্স’ কিন্তু ভাঙতে পারেনি তারা। অবশ্য প্রথম ম্যাচেই ৭ গোল হজম করা কোস্টারিকার চোখমুখ বুজে ডিফেন্ড করা ছাড়া আর কী-ইবা উপায় ছিল!
লুইস এনরিক স্পেনকে খেলিয়েছেন ২০১৪-১৫ মৌসুমের বার্সেলোনার মতো। ট্রেবল-জয়ী সেই বার্সা টিমের পজেশন ধরে রেখে দ্রুতগামী পাস খেলার ছাপ স্পষ্ট ছিল স্পেনের খেলায়। তবে বার্সার কোচ হওয়ার পর তৃতীয় মৌসুম যেমন ব্যর্থতায় কেটেছিল এনরিকের, বিশ্বকাপের তৃতীয় ম্যাচ কাটল তেমনি হতাশায়। অন্যদিকে জার্মান কোচ হ্যান্সি ফ্লিকের বিশ্বকাপের প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল জার্মানির সেরা একাদশটা নির্বাচন করা। বলা যায় জার্মানির ব্যর্থতার মূল কারণ সেরা একাদশ নির্বাচনে ব্যর্থতা। জার্মানির বিপক্ষে ম্যাচে জাপান যেখানে বদলি খেলোয়াড় দিয়ে ম্যাচ বের করে ফেলল, সেখানে ফ্লিক কিনা ম্যাচের সেরা দুই পারফর্মার গুন্দোগান আর জামাল মুসিয়ালাকে মাঠ থেকে তুলে নিলেন। বিশ্বকাপের তিন ম্যাচেই তিনি সমালোচিত হয়েছেন স্ট্রাইকার ফুল্ক্রগের বদলে অফ ফর্মের মুলারকে বারবার শুরুর একাদশে খেলানোর জন্য। বিশ্বকাপে সর্বমোট মাত্র ৬৬ মিনিট খেলে ফুল্ক্রগের অবদান ২ গোল আর ১ অ্যাসিস্ট, অর্থাৎ প্রতি ২২ মিনিটে তিনি একটি করে গোলে অবদান রেখেছেন! ইনফর্ম খেলোয়াড় রেখে বারবার নিজের প্রিয় শিষ্যকে খেলানোর জন্য নিজের চাকরিটাই না এবার খোয়াতে হয় তাঁর!