এমন বাংলাদেশকেই তো দেখতে চায় সবাই
দুটো দলের মধ্যে পার্থক্য যোজন যোজন। ফর্মের দিক দিয়ে বলো আর শক্তিমত্তায়—নিউজিল্যান্ডের মুখোমুখি হওয়ার আগে বাংলাদেশকে লজ্জায় পড়তে হয় কি না, সে নিয়ে ভাবনা ছিল অনেকের মনে। কেনই–বা হবে না? একবার দলটার দিকে তাকিয়ে দেখো।
দলের নিয়মিত অধিনায়ক ইনজুরির কারণে মাঠের বাইরে। মাঠের ভেতরে-বাইরে নানা রকম ঝামেলার জেরে দলে নেই অভিজ্ঞ তামিম ইকবাল। পিতৃত্বকালীন ছুটিতে দলে নেই লিটন। ইনজুরির কারণে দলের বাইরে তাসকিন আহমেদ, এবাদত হোসেন। আর ফর্মের কথা তো যত কম বলা যায়, ততই ভালো। একরাশ স্বপ্ন নিয়ে লজ্জাজনক এক বিশ্বকাপ শেষে দেশে ফিরেছে বাংলাদেশ। শুধু হতাশা আর স্বপ্নভঙ্গ নয়, একগাদা চোট নিয়ে দেশে ফিরেছে বাংলাদেশ দল।
অন্যদিকে কিউইদের দিকে তাকিয়ে দেখো, যদিও তাদের মান অনুযায়ী বিশ্বকাপটা তেমন ভালো যায়নি তাদের। বিশ্বকাপ জয়ের আশা নিয়েই দেশ ছেড়েছিল তারা। চোট নিয়েও দলের সঙ্গে থেকেছেন অধিনায়ক কেইন উইলিয়ামসন। নিজের, দলের প্রয়োজনে হাল ধরেছেন। তবু ভারতের কাছে হেরে সেমিফাইনালেই কাটা পড়েছে তাদের স্বপ্ন। তবে ফর্মের দিক থেকে বাংলাদেশের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে কিউইরা। সমর্থকেরা তাই অপেক্ষায় ছিলেন একটা একপেশে টেস্ট ম্যাচ দেখার।
ম্যাচটা একপেশেই হয়েছে। তবে সেটা কিউইদের পক্ষে নয়। বরং বাংলাদেশের পক্ষে। নিউজিল্যান্ডকে ১৫০ রানে হারিয়ে সিরিজের প্রথম ম্যাচটা নিজেদের করে নিয়েছে টাইগার বাহিনী। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমর্থকও বোধ হয় এমন জয় আশা করেনি। কেনই–বা করবে? নতুন অধিনায়কের অধীন সিলেটে দেশবাসী যেন এক নতুন বাংলাদেশের সন্ধান পেল।
বাংলাদেশের নতুন অধিনায়ক নাজমুল হাসান শান্ত শুরুটা করলেন স্বপ্নের মতো। সাকিব-লিটনের অনুপস্থিতিতে শান্তর হাতেই অধিনায়কের আর্মব্যান্ড তুলে দেয় বিসিবি। এর আগেও বহুবার টস করতে নেমেছেন শান্ত। অনূর্ধ্ব-১৯, বিপিএল, এমনকি বিশ্বকাপের মাটিতেও। কিন্তু দেশের হয়ে ব্লেজার গায়ে সাদা জার্সিতে অধিনায়কত্ব করা, তার সঙ্গে তুলনা হয় না কিছুরই। ক্রিকেটের সবচেয়ে প্রাচীন ফরমেটের অধিনায়কত্ব করার যে অনুভূতিই অন্য রকম, সেটা একবাক্যেই মেনে নিলেন তিনি।
টসে জিতে প্রথমে ব্যাটিং নিয়েছিল বাংলাদেশ। জার্সির কোনায় কোনায় স্পনসরের নাম লেপটে দেওয়ার যুগে বাংলাদেশ নেমেছিল কোনো স্পনসর ছাড়া এক সাদা জার্সিতে। সাদা জার্সিতে একটুকরা বাঘের লোগো দেখে পুরোনো খেলার হাইলাইট মনে করলেও ভুল হবে না। ক্রিকেটের প্রাচীন ফরমেটটাও যে এখন রংচং মেখে একাকার। শুরুটা দারুণ হয়েছিল বাংলাদেশের। ওপেনার মাহমুদুল হাসান জয় ৮৬ রান করলেও ব্যাটিং–ধসে বাংলাদেশকে থামতে হয় ৩১০ রানে। জবাবে নিউজিল্যান্ড ব্যাটিংয়ে নেমেই মুখোমুখি হয় বাংলাদেশের চিরাচরিত ক্যাচ মিস আর রিভিউ ভুলের মহড়ায়। কেন উইলিয়ামসন তুলে নেন নিজের ২৯তম সেঞ্চুরি! তাইজুল ইসলামের ৪ উইকেট ও পার্টটাইম বোলার মুমিনুল হকের চমকে বেশি দূর এগোতে পারেনি কিউইরা। ৭ রানের লিড নিয়ে তারা থামে ৩১৭ রানে।
দ্বিতীয় ইনিংসের বাংলাদেশের রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়ান অধিনায়ক শান্ত। যদিও তাঁর শুরুটা হয়েছিল বেশ অধিনায়কসুলভ। প্রথমে মাহমুদুল হাসান জয়, অতঃপর মুমিনুল হক—পরপর দুই ইনফর্ম ব্যাটসম্যানকে রানআউটের কবলে পড়ায় বেশ চাপে পড়ে যান শান্ত। রানআউটগুলোও ছিল বেশ দৃষ্টিকটু। আপাতদৃষ্টে মনেই হচ্ছিল, টেস্ট ক্রিকেটে অধিনায়কের পাল্লাটা একটু বেশিই ভারী হয়ে যাচ্ছে শান্তর জন্য। কিন্তু শান্ত আদাজল খেয়ে নামলেন নিন্দুকদের ভুল প্রমাণ করতে। নিজেকে প্রমাণ করলেন ব্যাট হাতে।
যত সময় যাচ্ছিল, ব্যাটিংয়ের জন্য তত কঠিন হচ্ছিল পিচ। কিন্তু নিজের নামের মতোই শান্ত ছিলেন শান্ত। ধৈর্য ধরে একের পর এক বলের মুখোমুখি হয়েছেন, তুলে নিয়েছেন ক্যারিয়ারের সপ্তম সেঞ্চুরি। টেস্ট ইতিহাসের ৩৪তম অধিনায়ক হিসেবে নিজের প্রথম ম্যাচেই সেঞ্চুরি তুলে নিলেন শান্ত। তার সেঞ্চুরি আর মুশফিক-মিরাজের হাফ সেঞ্চুরির ওপর ভর করেই নিউজিল্যান্ডকে ৩৩২ রানের টার্গেট দেয় বাংলাদেশ।
ম্যাচ জিততে কিউইদের প্রয়োজন ১৪৫ ওভারে ৩৩২ রান। সমীকরণের হিসেবে বড্ড সহজ মনে হলেও কাজটা সহজ নয়। সিলেটে ভঙ্গুর পিচে সময় যত গড়াচ্ছে, স্পিন তত ধরছে। রান তোলা এখানে চাট্টিখানি কথা নয়। তার প্রমাণ পেল কিউইরা প্রথম ওভারেই। টম লাথাম ফিরলেন ০ রানে, শরীফুলের বলে উইকেট কিপারের কাছে ক্যাচ দিয়ে। এক সেশনেই ঘরে ফিরলেন তিনজন। দিনের শেষে ৭ জন। বাকি ছিল মাত্র তিন উইকেট। বাধা হয়ে দাঁড়ানো ড্যারিল মিচেল উইকেটে থাকলেও জয়টা আসলে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল ৪র্থ দিনের শেষ দিকেই। সকালে লাঞ্চের আগেই নিউজিল্যান্ডকে অলআউট করে দেয় বাংলাদেশ। ৬ উইকেট তুলে নেন বাঁহাতি স্পিনার তাইজুল ইসলাম। ম্যাচে পেলেন ১০ উইকেট। অধিনায়ক হিসেবে অভিষেকেই জয় তুলে নিলেন নাজমুল হাসান শান্ত। প্রথমবারের মতো দেশের মাটিতে নিউজিল্যান্ডকে হারাল বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের এই টেস্ট জয় অবিস্মরণীয়। না, অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডকে হারানো কিংবা নিউজিল্যান্ডকে নিজেদের মাটিতে হারানোর মতো বড় ঘটনা না হলেও সিলেটের টেস্ট জয় বাংলাদেশের কাছে অবিস্মরণীয় হয়ে রইবে ভিন্ন একটি কারণে। নতুন বাংলাদেশের সূচনালগ্ন হয়তো এই টেস্ট সিরিজই। মুশফিকুর রহিম ছাড়া সিনিয়র ক্রিকেটারদের কেউই ছিলেন না দলে। বলা যায়, সিনিয়র ক্রিকেটারবিহীন বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয়।
এ ম্যাচে দলগতভাবেই ভালো খেলেছে বাংলাদেশ। যতবারই পথ বিচ্যুত হয়েছে, একজন নয়, এগিয়ে এসেছে পুরো দল। অধিনায়ক হিসেবে শান্ত ভুল করেছেন; ফিল্ডিংও যে খুব একটা ভালো ছিল, ব্যাপারটা তা নয়। কিন্তু সিদ্ধান্তগুলো ভালোই নিয়েছেন শান্ত। চাপে ভেঙে পড়েননি। মনেই হয়নি, অধিনায়ক হিসেবে এটা তাঁর প্রথম টেস্ট। তবে একটা ব্যাপারে সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছেন শান্ত। অনেক দিন পর যেন বাংলাদেশকে একটা দল হিসেবে উপস্থাপন করতে পেরেছেন তিনি। হার–জিত যা-ই হোক না কেন, একসঙ্গেই লড়ব—এমন মনোভাব দলে আনতে পেরেছেন তিনি।
বেশ অনেক দিন ধরেই এই মানসিকতার অভাব ছিল বাংলাদেশ দলে। সাকিব-তামিম দ্বন্দ্ব, হাথুরুসিংহের অন্তর্ভুক্তিতে কোন্দল—মাঠের বাইরের এসব ঘটনা বেশ বাজে প্রভাব ফেলছিল মাঠে। শান্ত যেন এক তুড়িতেই তা ভুলিয়ে নতুন এক দল হাজির করলেন দেশবাসীর সামনে। এমন দলই তো সবার প্রতীক্ষা। যেখানে থাকবে না কোন্দল, দেশের হয়ে এক হয়ে মাঠে নামবে বাংলাদেশ। এমনটাই তো আমাদের চাওয়া, পুরো দেশবাসীর চাওয়া।