ব্রাজিলের এমন ভরাডুবি কেন

ছবি: গোল ডটকম

‘আমরা ২০২৬ বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলব। আমি শতভাগ নিশ্চিত। চাইলে ভিডিও করে রাখতে পারেন।’ নিজ দলের ওপর কোচদের এমন বিশ্বাস থাকাটা খারাপ কিছু নয়; বরং খারাপ সময়ে কোচের অণুপ্রেরণাই হতে পারে শক্তি। কিন্তু কোচ যখন স্বয়ং পাঁচবারের বিশ্বজয়ী দল ব্রাজিলের, তখন তো একটু ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই হয়। বিশ্বকাপে যারা পা রাখে বিশ্বজয়ের লক্ষ্য নিয়ে, তাদের কোচ ওপেন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছেন। তা–ও বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলার কথা বলে? সেটাও আবার কষ্টার্জিত এক জয়ের পর। বিষয়টা চোখে লাগার মতোই বটে।

তবে ব্রাজিলিয়ান কোচের সুখস্মৃতি স্থায়ী হয়নি। এক ম্যাচ পরই তাঁর দল ফিরে গিয়েছে পুরোনো ফর্মে। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে প্যারাগুয়ের কাছে ১-০ গোলে হারতে হয়েছে পাঁচবারের বিশ্বজয়ীদের। ২০০৮ সালের পর এই প্রথম প্যারাগুয়ের কাছে হারতে হলো ব্রাজিলকে। এই হার কোনো অঘটন নয়, দরিভাল জুনিয়র দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার পর থেকেই ব্রাজিলের এই তথৈবচ অবস্থা। ১০ ম্যাচ হয়েছে দায়িত্ব বুঝে নিয়েছেন, ৪ জয়ের পাশাপাশি র‍য়েছে ৪ হার আর ২ ড্র। ২০০৩ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে দক্ষিণ আমেরিকা অঞ্চলের বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ৭১ ম্যাচ খেলে মাত্র ৫টিতে হেরেছিল ব্রাজিল। কিন্তু এবার ২০২৬ বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ৮ ম্যাচ খেলেই ৪ হার!

এমনকি ২০ বছরের মধ্যে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে সবচেয়ে বাজে শুরু করেছে ব্রাজিল। ৮ ম্যাচে মাত্র ১০ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলের পঞ্চমে ব্রাজিল।

মাঠের ভেতরে ও বাইরে ব্রাজিল খুঁজে বেড়াচ্ছে নিজেকে। কোপা আমেরিকায় কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায়, গত পাঁচ ম্যাচে মাত্র ১টি জয়। ব্রাজিলের হলুদ জার্সির সঙ্গে এমন ফর্ম ঠিক খাপ খায় না। হঠাৎ এই ভরাডুবির কারণ কী?

নেইমারের অনুপস্থিতি

চোটের কারণে এক বছরের কাছাকাছি সময় ধরে মাঠে নেই নেইমার
ছবি: এক্স

২০১০ বিশ্বকাপের পর থেকে এখন পর্যন্ত ব্রাজিলের সেরা তারকার নাম নেইমার। মাঠের বাইরে তাঁর বিপক্ষে যত অভিযোগই থাকুক না কেন, মাঠের ভেতরে, বিশেষ করে হলুদ জার্সিতে নেইমারের জুড়ি মেলা ভার। এক বছরের কাছাকাছি সময় ধরে মাঠে অনুপস্থিত তিনি। পিএসজি থেকে সৌদি ক্লাব আল হিলালে যোগ দিয়েছিলেন ২০২৩-২৪ মৌসুমে। ব্রাজিলের হয়ে খেলার সময় বাঁ হাঁটুর এসিএল চোটের কারণে পুরো মৌসুম বিছানায় কাটাতে হয় তাঁকে। এমনকি এখন পর্যন্ত অনুশীলনে ফিরতে পারেননি তিনি। কবে ফিরবেন, তা নিয়েও আছে শঙ্কা।

আরও পড়ুন

তাঁর অনুপস্থিতি বেশ ভালোভাবেই টের পাচ্ছে ব্রাজিল। দেড় দশকের কাছাকাছি সময় ধরে ব্রাজিলের আক্রমণ ও মাঝমাঠ—দুটিই সামলাতে হয়েছে তাঁকে। যদিও ১০ বছরের মধ্যে ব্রাজিলের একমাত্র শিরোপা এসেছিল নেইমারকে ছাড়াই। তবু দলের অবিচ্ছেদ্য অংশকে ছাড়া লম্বা সময় ধরে খেলা বেশ বিপদেই ফেলেছে সেলেসাওদের।

বড় তারকাদের ‘অনুপস্থিতি’

বর্তমান ব্রাজিলের সবচেয়ে বড় তারকা ভিনি, রদ্রিগো আর এনড্রিক
ছবি: এক্স

ব্রাজিল মানেই তারকাবহুল এক দল। ফুটবল ইতিহাসের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ব্রাজিল কখনোই একক তারকার ওপর ভর করে ছিল না। ফুটবলের প্রতিটি পরতে পরতে আছে একাধিক ব্রাজিলিয়ানের উপস্থিতি। এমনকি ব্রাজিলের যে দল আন্তর্জাতিক শিরোপা ছাড়াই ক্যারিয়ার শেষ করেছে, তাদের রোস্টারেও ছিলেন নামীদামি তারকা। কিন্তু কয়েক বছর ধরেই ব্রাজিলিয়ান লাইনআপে তারকা খেলোয়াড়ের বড্ড অভাব। নেইমারকে সরিয়ে রাখলে ম্যাচ ঘুরিয়ে ফেলার মতো বড় তারকা হলুদ জার্সিতে নেই বললেই চলে। ভিনিসিয়ুস জুনিয়র, রদ্রিগো এখনো বয়সে তরুণ। রিয়াল মাদ্রিদের মতো দলকে টেনে নিয়ে গেলেও ব্রাজিলের মাঝমাঠ আর ডিফেন্সে বড় কোনো নাম নেই অনেক দিন ধরেই। যার প্রভাব দেখা যাচ্ছে আধুনিক ব্রাজিল দলে।

জাতীয় দলে এসেই হারিয়ে যাওয়া

রিয়ালের হয়ে যতটা সফল, ব্রাজিলের হয়ে ততটাই ম্লান ভিনি-রদ্রিগো জুটি
ছবি: এক্স

নেইমারবিহীন ব্রাজিল দলে তারকা বলতে আছেন ভিনিসিয়ুস জুনিয়র আর রদ্রিগো। রিয়াল মাদ্রিদে সতীর্থ দুই তারকা জাতীয় দলেও খেলছেন একত্রে। স্বভাবতই তাঁদের মধ্যে বোঝাপড়াটাও বেশ ভালো। অন্তত রিয়াল মাদ্রিদের সাদা জার্সিতে তেমনটাই মনে হয়। কিন্তু ব্রাজিলের হলুদ জার্সি এলেই কোথায় যেন হারিয়ে যান দুজন। রিয়ালের জার্সিতে যতটা না সফল তাঁরা, ব্রাজিলের জার্সিতে ততটাই ম্লান। ভিনিসিয়ুস আর রদ্রিগোর অভিষেক হয়েছে প্রায় একই সময়ে। ২০১৯ সাল থেকে ভিনিসিয়ুর নিয়মিত দলের সঙ্গে থাকলেও রদ্রিগোর দলে জায়গা করে নিতে ২০২২ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। এত দিন পর এসেও জাতীয় দলের জার্সিতে রিয়াল মাদ্রিদের ফর্মটা টেনে আনতে পারছেন না কেউ।

আরও পড়ুন

ব্রাজিলের জার্সিতে ৫ বছরে মোট ৩৫ ম্যাচ খেলেছেন ভিনিসিয়ুস, গোল ৫টি আর অ্যাসিস্টও ৫। অন্যদিকে রদ্রিগো খেলেছেন ২৯ ম্যাচ। ৭ গোলের পাশাপাশি ১ অ্যাসিস্ট। আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে ভিনি গোলের খাতা খুললেও রদ্রিগো এখনো ম্লান। বড় ম্যাচে দলের দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার মতো বয়স তাঁদের হয়েছে। রিয়াল মাদ্রিদের মতো দলে একাই ম্যাচ বের করে এনেছেন, এমন ঘটনা অহরহ। কিন্তু ব্রাজিলের জার্সিতে তাঁদের বড় ম্যাচ জেতানো দূরে থাক, ছোট দলের বিপক্ষেও খেই হারিয়ে ফেলেন তাঁরা। তারকা–সংকটের ব্রাজিলে যে গুটিকয় তারকা আছেন, তাঁরাও যদি অফ ফর্মে থাকেন তাহলে সেলেসাও–ভক্তদের কপালে চিন্তার বলিরেখা পড়াটাই স্বাভাবিক।

সঠিক কোচ নির্বাচন করতে না পারা

তিতের অধীনে অনেকটাই ছন্দে ফিরেছিল ব্রাজিল
ছবি: এক্স

ঘুরেফিরে যতই খেলোয়াড়ের দোষ দেওয়া হোক না কেন, দিন শেষে একজন খেলোয়াড়ের পারফরম্যান্স অনেকটাই নির্ভর করে দলকে কীভাবে সাজানো হচ্ছে, তার ওপর। ভালো কোচের অধীনে একজন সাধারণ খেলোয়াড়ও হয়ে উঠতে পারেন পৃথিবীর সেরা তারকাদের একজন। ভিনিসিয়ুস জুনিয়রের কথাই ধরো, জিনেদিন জিদানের আমলে নিজেকে মাঠে খুঁজে ফিরতেন। কিন্তু কার্লো আনচেলত্তির অধীনে নিজেকে আপাদমস্তক বদলে ফেলেছেন। রিয়াল মাদ্রিদের আক্রমণভাগের মূল ভরসা এখন তিনি। চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে পর্যন্ত গোল করে দলকে জিতিয়েছেন শিরোপা। সেই ভিনিসিয়ুসই আবার ব্রাজিলে এলে যেন খেলাই ভুলে যান। একজন তারকা খেলোয়াড়কে সুপারস্টারে পরিণত করতে কোচের ভূমিকাও কম নয়। ব্রাজিল যেন এই জায়গাতেই ব্যর্থ হয়েছে বারবার।

আরও পড়ুন

তিতের অধীনে ২০২২ বিশ্বকাপের আগপর্যন্ত বেশ ভালোই ছিল ব্রাজিল। ব্রাজিলকে সমীহ করে চলত সবাই। তাঁর হাত ধরে এসেছে শিরোপাও। দুই বিশ্বকাপে হারের পেছনে যতটা না তাঁর বা দলের ব্যর্থতা, তার থেকেও বেশি প্রতিপক্ষের অসাধারণ পারফরম্যান্স। বিশ্বকাপ বাদে কোপা আমেরিকার শিরোপা জিতেছেন, বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ছিলেন অপরাজিত। তিতের অধীনে নেইমারের ওপর থেকে লাইমলাইট সরিয়ে দল হিসেবে খেলতে শুরু করেছিল ব্রাজিল। কিন্তু বিশ্বকাপের পর তিতের বিদায় বদলে দিয়েছে ব্রাজিলকে। নতুন কোচেরা না ট্যাকটিক্যালি সমৃদ্ধ, না ম্যান ম্যানেজমেন্টে ভালো। তিতের বিদায়ের পর কোচ হয়ে এসেছেন তিনজন। র‍্যামোন মেনেজেস আর ফার্নানদো দিনিজ ছিলেন অন্তর্বর্তীকালীন কোচ। আর দরিভাল জুনিয়র এসেছেন পাকাপাকিভাবে।

ব্রাজিলের ইচ্ছা ছিল কার্লো আনচেলত্তিকে কোচ হিসেবে আনার। আনচেলত্তিও মৌখিকভাবে রাজি ছিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে রিয়াল মাদ্রিদের প্রস্তাব ফেলতে পারেননি তিনি। যে কারণে কোচ হিসেবে নিযুক্ত হন দরিভাল জুনিয়র। ২২ বছরের কোচিং অভিজ্ঞতা, কিন্তু কোনো জায়গাতেই থিতু হতে পারেননি; বরং ব্রাজিলিয়ান লিগে ঘুরে বেরিয়েছেন যাযাবরের মতো। ব্রাজিলিয়ান লিগেই ভিন্ন ভিন্ন ১৯টি দলের কোচিং করানোর অভিজ্ঞতা তাঁর। খালি চোখে মনে হতে পারে, অভিজ্ঞতার ফুলঝুরি। কিন্তু বছরের পর বছর এক দলে স্থায়ী হতে না পারার অর্থ একটিই, দল কিংবা খেলোয়াড় কারোর আস্থাই অর্জন করতে পারেননি তিনি। অবশ্য ব্রাজিলিয়ান লিগটাই এ রকম, লম্বা সময় ধরে কাউকে ভরসা করতে চায় না। সে কারণেই কি না, ব্রাজিলের ভেতর থেকে ভালো কোচ তেমন একটা বেরিয়ে আসে না। আর যাঁরাও আসেন, তাঁরাও খুব একটা ট্যাকটিক্যালি দক্ষ হন না। নিজের রিসোর্সকে ঠিকমতো ব্যবহার করতে ব্যর্থ হন। যে কারণেই কি না, মূল দল সামলাতে গেলেই হিমশিম খেতে হয় তাঁদের। যার প্রভাব পড়ে জাতীয় দলে।

২২ বছরের কোচিং অভিজ্ঞতা আছে দরিভালের।
ছবি: এক্স

পাশের দেশ আর্জেন্টিনাতেই যেমন, সীমিত রিসোর্সের মধ্য থেকেই দলকে অপরাজেয় করে তুলেছেন লিওনেল স্কালোনি। জিতিয়েছেন কোপা-বিশ্বকাপ-কোপা ট্রিও। একটি নির্দিষ্ট গঠনে দলকে এমনভাবে তৈরি করেছেন, যাতে দলের তারকা খেলোয়াড়রা না থাকলেও দল তেমন হিমশিম খায় না। ব্রাজিলিয়ান কোচরা কৌশল দূরে থাক, মূল খেলোয়াড়দের নিয়ে কীভাবে দলকে পরিণত করবেন, সেই দিশাই খুঁজে পাচ্ছেন না। ফলাফল এই ভরাডুবি।

আরও পড়ুন

আরও পড়ুন