১৯৩০ বিশ্বকাপের জন্য আগ্রহ দেখিয়েছিল মোট চারটি ইউরোপিয়ান দেশ। কিন্তু ইতালি ও স্পেনের মতো হেভিওয়েটদের পাশে রেখে প্রথম ফুটবল বিশ্বকাপের ভেন্যু ঠিক করা হলো উরুগুয়েকে। পরপর দুই অলিম্পিক জয়, সেই সঙ্গে স্বাধীনতার শতবর্ষ উদ্যাপন, সব মিলিয়ে উরুগুয়ে ছিল বিশ্বকাপের জন্য মোক্ষম মঞ্চ। কিন্তু বেঁকে বসল ব্রিটিশরা। ইউরোপের বাইরে বিশ্বকাপ আয়োজনের কথা শুনে ফিফা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন এফএ সভাপতি। তাঁর মতে, ফিফার নতুন টুর্নামেন্টে বাচ্চাকাচ্চাদের সঙ্গে খেলার কোনো অর্থই হয় না।
ইংল্যান্ডের পিছু হটা ছিল বিশ্বকাপের জন্য অশনিসংকেত। তাদের দেখাদেখি মুখ ঘুরিয়ে নিতে শুরু করল অন্য ইউরোপিয়ান দলগুলো। আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে দক্ষিণ আমেরিকায় ফুটবল খেলতে যাওয়াটা অনেকের কাছেই ছিল বিলাসিতা। যতই দিন ঘনিয়ে আসতে লাগল, ততই কমতে থাকল দলের সংখ্যা। শেষ পর্যন্ত ইউরোপিয়ান দেশগুলোকে আটলান্টিক ভ্রমণে রাজি করতে মাঠে নামলেন স্বয়ং ফিফা সভাপতি জুলে রিমে। নিজের দেশ ফ্রান্স তো আগে থেকেই রাজি। রোমানিয়ান রাজা ছিলেন ফুটবলের বিশাল ভক্ত, এক কথাতে তিনিও রাজি। বিশাল শর্তসহকারে রাজি করলেন বেলজিয়াম আর তৎকালীন যুগোস্লাভিয়াকে। শর্ত হলো আটলান্টিক পাড়ি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে ফিফাকে।
সে শর্তে রাজি হলেন জুলে রিমে। বিশাল এক জাহাজে চেপে বসল চার ইউরোপিয়ান দেশ। সেই সঙ্গে রেফারি, রোমানিয়ার রাজা আর ফিফা অফিশিয়ালরা। অনিশ্চিত এক যাত্রা; যার এক পাশে হাতছানি দিচ্ছে মৃত্যু, অন্যপাশে ইতিহাস। তিন সপ্তাহের সমুদ্রযাত্রা শেষে উরুগুয়ের মন্টেভিডেওতে পৌঁছাল চার দল। দক্ষিণ আমেরিকার ৭, উত্তর আমেরিকার ২ আর ইউরোপের ৪ দেশ মিলে মোট ১৩ দল নিয়ে শুরু হলো বিশ্বকাপ। ১৩ দলকে ভাগ করা হলো চারটি আলাদা গ্রুপে। চার গ্রুপের শীর্ষ চার দল খেলবে সেমি। এই নিয়মে ১৯৩০ সালের ১৩ জুলাই পর্দা ওঠে বিশ্বকাপের। মাত্র দুই হাজার দর্শকের সামনে ফ্রান্স-মেক্সিকো ম্যাচ দিয়ে শুরু হলো প্রথম বিশ্বকাপের যাত্রা। মেক্সিকোকে ৪-১ গোলে হারিয়ে বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ জিতে নেয় ফ্রান্স। বিশ্বকাপ ইতিহাসের প্রথম গোলদাতা লুসিয়েন্ট লঁরে।
অদ্ভুত সব ঘটনায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল প্রথম বিশ্বকাপ। গ্রুপ পর্বে ৮৪ মিনিটের এক ফুটবল ম্যাচ দেখার সৌভাগ্য (পড়ো দুর্ভাগ্য) হয় দর্শকদের। ঘড়ির গন্ডগোলে ম্যাচের ৬ মিনিট বাকি থাকতেই শেষ বাঁশি বাজিয়ে দেন রেফারি। কয়েকজন খেলোয়াড়ের মনে সন্দেহ জেগেছিল। কিন্তু রেফারির ওপরে কিছু বলার সাহস পাননি কেউ। রেফারির ভুল ধরা পড়ে ম্যাচ রিপোর্ট লিখতে গিয়ে। ফিফা অফিশিয়াল বুঝতে পারেন, ছয় মিনিট আগেই শেষ বাঁশি বাজিয়ে দিয়েছেন রেফারি। তড়িঘড়ি করে ডেকে আনা হয় রেফারিকে। নিয়ম অনুযায়ী ম্যাচের বাকি সময় ওই দিনেই শেষ না হলে বাতিল হয়ে যাবে ফলাফল, তাই আবারও মাঠে নামতে হবে দুই দলকে। দর্শকেরা মাঠ ছেড়েছেন অনেক আগেই। দুই দলের খেলোয়াড়েরা যখন ফ্রেশ হয়ে হোটেলের উদ্দেশে রওনা দেবেন, এমন সময় ডেকে পাঠানো হয় দুই দলকে। শেষ ছয় মিনিট ফুটবল খেলে ফ্রান্সকে ১-০ গোলে হারিয়ে সেমির পথে পা বাড়ায় আর্জেন্টিনা।
অন্যদিকে গ্রুপ পর্বেরই আরেক ম্যাচে যুক্তরাষ্ট্রের এক খেলোয়াড়ের সেবাশুশ্রূষায় মাঠে নেমে পড়েন স্বয়ং কোচ। মেডিকেল বক্স থেকে ব্যথানাশক স্প্রের বদলে ক্লোরোফর্ম বের করে স্প্রে করতে থাকেন খেলোয়াড়ের পায়ে। তাতে খেলোয়াড়ের ব্যথা ঠিক হওয়া দূরে থাক, উল্টো কোচ নিজেই অজ্ঞান হয়ে পড়েন মাঠে। সাহায্য করতে এসে তাঁকেই মাঠ ছাড়তে হয় অন্যের সাহায্য নিয়ে।
বহু হাস্যকর ঘটনার পরও উরুগুয়ের বিশ্বকাপ ছিল এককথায় সফল। বাইরের কোনো সাহায্য ছাড়া একটা ফুটবল আসর আয়োজন করা সহজ কথা নয়। কিন্তু সেটাই করে দেখিয়েছিল ফিফা। সব বাধাবিপত্তি শেষে ফাইনালে ওঠে দক্ষিণ আমেরিকার দুই দল—আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়ে। ১৯৩০ সালের ৩০ জুলাই উরুগুয়ের এস্তাদিও সেন্তেনারিও স্টেডিয়ামে পর্দা উঠে প্রথম বিশ্বকাপ ফাইনালের।
কিন্তু বিপত্তি বাধে ফাইনালেই। নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে ফাইনালের বল নিয়ে। দুই দলই দাবি করে, ফাইনাল খেলা হবে তাদের বল দিয়ে। যেহেতু বিশ্বকাপের কোনো অফিশিয়াল বল ছিল না, তাই উরুগুয়ের বল দিয়েই খেলা হয়ে আসছিল এত দিন। কিন্তু ফাইনালে পক্ষপাতিত্ব হতে পারে—এ অভিযোগে বল পাল্টানোর দাবি করে আর্জেন্টিনা। বল নিয়ে জটিলতার উদ্ভট এক সমাধান বের করে ফিফা। ম্যাচের দুই অর্ধ খেলা হবে দুই দলের বলে, প্রথমার্ধ খেলা হবে আর্জেন্টিনার ‘টিয়েন্টো’ বল দিয়ে আর দ্বিতীয়ার্ধ হবে উরুগুয়ের ‘টি-মডেল’ বলে। শুধু তা–ই নয়, উত্তেজিত জনতার হাত থেকে বাঁচার জন্য মাঠের পাশে তৈরি ছিল নৌকা। যদি কোনোভাবে খেলার ফলাফল স্বাগতিকদের বিপক্ষে যায়, তবে উত্তেজিত জনতার হাত থেকে রেফারির সুরক্ষার সব ব্যবস্থা করে রেখেছিল ফিফা।
প্রথমার্ধে ২-১ গোলে এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে ঘুরে দাঁড়ায় উরুগুয়ে। ৪-২ গোলে শেষ হয় ম্যাচ। স্বাগতিক দল হিসেবে প্রথম বিশ্বকাপ জিতে নেয় উরুগুয়ে। ৬৮ হাজার দর্শকের সামনে নিজেদের জন্মশতবার্ষিকী রাঙিয়ে তোলেন উরুগুয়ের খেলোয়াড়েরা। উরুগুয়ে ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান পল জুডের হাতে ‘দ্য ভিক্টোরি’ (পরবর্তী সময়ে জুলে রিমে ট্রফি) তুলে দেন ফিফা প্রেসিডেন্ট জুলে রিমে। ফরাসি স্থপতি অ্যাবেল লাফলারের বানানো সেই ট্রফিতে ছিল গ্রিক দেবী ‘নাইকি’র প্রতিকৃতি। ৩ দশমিক ৭৮ কেজি ওজনের শিরোপা চার বছরের জন্য হয়ে যায় উরুগুয়ের। সেই সঙ্গে নিয়ম করা হয়, তিনবার এই শিরোপা যারা জয় করে নেবে, তাদের কাছে পাকাপাকিভাবে চলে যাবে এই শিরোপা। আর সেই লড়াইয়ে একধাপ এগিয়ে ছিল উরুগুয়ে।